নতুন ভোরের পাখি
পোস্টটি ৩৯২৫ বার পঠিত হয়েছেআজ থেকে প্রায় দেড় যুগ আগের কথা। ২০০২ সালের দিকে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে চল্লিশ জন খেলোয়াড় নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসে পশ্চিমবঙ্গের মহিলা ফুটবল দল। ঢাকায় তাদের বিপক্ষে খেলবে বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল। অথচ বাংলাদেশের তখনো প্রমীলা ফুটবল দলই নেই! ফলে এগারজনের দল গড়তেই হিমশিম খেল আয়োজকরা। অন্য খেলার সাথে সম্পৃক্ত খেলোয়াড়দের এনে দল গড়ার চেষ্টা; তবু দলে তখনো তিনজন খেলোয়াড় কম। শেষমেশ পশ্চিমবঙ্গের দল থেকে তিনজন ধার নিয়ে খেলা হলো সেই ম্যাচ। বাংলাদেশের নারীদের প্রথম ফুটবল ম্যাচটা হেরেছিল ১-০ গোলে। ধর্মের দোহাই দিয়ে মেয়েদের চার দেয়ালের মাঝে বন্দী করে রাখা মৌলবাদীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেদিনই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের নারীদের ফুটবল যাত্রা।
তবে আমাদের সমাজে ফুটবল খেলতে যাওয়া মেয়েদের প্রতি নিচু দৃষ্টি থামে নি এখনো। আজও কোনো মেয়ে খেলতে নামলে ধর্মের নামে তার দিকে ছোড়া হয় হাজারো সমালোচনার তীর। মৌলবাদের মারপ্যাঁচ শুরুতেই ছিটকে যায় অগণিত নারী প্রতিভা। ধর্মের দোহাইতে হয়ত থেমে যেতে পারতো ময়মনসিংহের নারী ফুটবলার তহুরা খাতুনের স্বপ্নও। তহুরার স্কুল শিক্ষকগণ অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করায় তার বাবাকে। বাবার অনুমতি পেয়ে সেই তহুরা খাতুন আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে ফুটবলের মাঠে। আলো এসেছে তার গ্রামেও। তার অনুরোধেই ময়মনসিংহের অজপাড়া গাঁ কলসিন্দুরের ৮০০ বাড়িতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী।
যাত্রা সেই ২০০২ সালে শুরু হলেও বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দল প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ২০১০ সালের দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে। ছেলদের ফুটবল যাত্রার প্রায় ৩২ বছর পর আন্তর্জাতিক ফুটবলে পদার্পন করে মেয়েরা। শুরুতে মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে নাক ছিটকিয়েছেন অনেকেই; হাসি-তামাশাও কম হয়নি। অথচ সময়ের ব্যবধানে এই মেয়েরাই নিজেদের নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। তাদের খেলা দেখেই এখন দেশের মানুষ মুগ্ধ হয়, করতালি দেয়, গর্ব করে। এমনকি বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল দলটিকে বিশ্বে প্রমীলা ফুটবলের উন্নতির 'রোল মডেল' হিসেবে মর্যাদা দেয় বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিফা।
বাংলাদেশের প্রমীলা ফুটবল জাগরণের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ড কাপ। ২০১১ সালে শুরু হওয়া টুর্ণামেন্টটিতে এখন প্রতি বছর ৬৪ হাজার স্কুলের প্রায় ১০ লাখের উপরে মেয়ে ফুটবলার অংশ নিচ্ছে। বাংলাদেশের যেকোনো বয়স ভিত্তিক দলের প্রায় সব খেলোয়াড়ই এসেছে এই ফুটবল প্রতিযোগিতা থেকে। অথচ একটা সময় শুধুমাত্র দেশের পার্বত্য অঞ্চলের মেয়েদের দিয়েই চালাতে হতো প্রমীলা ফুটবল। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাদে কেবল সাতক্ষীরা, যশোর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে উঠে এসেছে হাতেগোনা কয়েকজন ফুটবলার।
আমাদের নারী ফুটবলের এই দশা পরিবর্তনে সমাজের বেড়াজাল ভেঙে নিরলস অবদান রেখে গেছেন পর্দার আড়ালে থাকা কিছু মানুষ। সাতক্ষীরার আকবর আলী, নারায়ণগঞ্জের বিদ্যুৎ কিংবা যশোরের সাচ্চু নিজ নিজ এলাকায় ফুটবল খেলতে সাহায্য করেছেন মেয়েদের। নিজ উদ্যোগে শিখিয়েছেন ফুটবল এবং দেখিয়েছেন ঢাকার পথ। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুন ফুটবল শিখেছেন কোচ আকবরের কাছেই। সেই আকবরের দুই মেয়ে মুক্তা ও রিক্তা খেলছে বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের হয়ে।
দেশের নারী ফুটবলের খনি খ্যাত কলসিন্দুরে কিশোরীদের ফুটবল মাঠে নেয়ার অসম্ভব কাজটাই সাধন করেছেন কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মফিজ উদ্দিন। বাবা-মায়েদের বুঝিয়ে তাদের কন্যা সন্তানকে ফুটবল খেলানোর অনুমতি নেয়ার কাজটা মোটেই সহজ ছিল না তার জন্য। তবে শিক্ষক মফিজ উদ্দিন যখন বুঝাতে সক্ষম হলেন যে ফুটবল খেলে তারা পরিবারকে কিছু টাকা এনে দিতে পারবেন, তখনই রাজি হলেন তহুরা, মারিয়াদের বাবা-মায়েরা। দেশের শেষ প্রান্তে অবস্থিত এক অজপাড়া গাঁয়ের পরিবারগুলো তখন দারিদ্র্যের আঘাতে জর্জরিত। প্রায় সবারই অভাবের সংসার। কার মা কাজ করেন রাস্তায়। কারো বাবা রিকশা চালান। আবার কারো পরিবারের সদস্য মজুরিখাটা শ্রমিক। কিছু টাকার আশায় মেয়েকে তাই ফুটবল খেলতে পাঠালেন তারা। এরপরের গল্পটা স্বপ্নের মতই। কলসিন্দুরের সেই মেয়েদের অবদানেই গ্রামে এসেছে বিদ্যুৎ, সরকারি অনুদানে টিনের ঘর সরিয়ে স্কুলে উঠেছে ইটের দালান।
কলসিন্দুরের পাশপাশি নারী ফুটবলের একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবদান। খাগড়াছড়ির অম্রা চিং মারমা ও রাঙামাটির সুইনু প্রু মারমা লাল-সবুজ জার্সিতে দেশের একের পর এক অর্জনে রেখে যাচ্ছেন অনবদ্য অবদান। বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলা এটাকিং মিডফিল্ডার মনিকা, ডিফেন্ডার আনাই মগিনি আর তার বোন আনুচিং মগিনির জন্যেই আজ বাংলাদেশ জেনেছে খাগড়াছড়ির গহীনে অবস্থিত সাতভাই পাড়া কিংবা সুমন্তপাড়ার নাম। এই কিশোরীদের জন্য কেবল বাংলাদেশের কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের নামই পরিচিতি পায়নি, ফুটবল বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশের নামও।
দুই বছর আগের একটি ঘটনা। ঈদের সময় অনূর্ধ্ব-১৬ দলের ক্যাম্প চলছিল ঢাকায়। সেই ক্যাম্পে থাকা মেয়েদের কাউকেই ঈদের ছুটি দেয় নি ক্যাম্প পরিচালক। ঈদের পরপরই টুর্নামেন্ট তাই খেলোয়াড়দের ফিটনেস খারাপ হওয়ার ভয়েই ছুটি দেন নি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ঈদে রুটিনছাড়া তেলযুক্ত খাবার খেয়েই হয়ত নিজেদের ফিটনেস নষ্ট করবে সবাই। তবে ক্যাম্প পরিচালক পরে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে খাবারের অভাবে না খেয়ে তাদের ফিটনেস খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেই দলের ক্যাম্প পরিচালক এমনটা ভেবেছিলেন কারন আমাদের জাতীয় দলের প্রায় বেশিরভাগ ফুটবলারই উঠে এসেছেন দারিদ্রসীমার একেবারে নিম্নস্তর থেকে। জন্ম থেকেই জীবনের সাথে লড়াই করে বড় হয়েছে তারা। জীবনভর দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করা এই মেয়েগুলো ফুটবল পায়ে তাই হয়ে উঠেছেন অদম্য। এখানে তার লড়াই সমাজের সাথে, দারিদ্র্যের সাথে। আর সেই লড়াইয়ে প্রতিনিয়তই বিজয়ীর বেশে শিরোপা হাতে ফিরছে এদেশের মেয়েরা।
গত কয়েক বছরেই বাংলাদেশের কিশোরীরা ফুটবল মাঠে অর্জন করেছে অসংখ্য সাফল্য। ইরান, ভারত, উজবেকিস্তানের মত দলগুলোকে হারিয়ে এশিয়ার সেরা আট দলের টুর্নামেন্ট খেলেছে আমাদের মেয়েরা। গত বছর সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়লাভ করে মেয়েরা। তাছাড়া ২০১৫ ও ২০১৬ সালে এএফসি অনুর্ধ-১৪ বালিকাদের আঞ্চলিক আসরে টানা দু’বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। আমাদের প্রমীলা ফুটবল দল এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ আসরের আঞ্চলিক বাছাইপর্বেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ২০১৬ সালে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতেছে কোচ ছোটনের অধীনে থাকা বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দল। এছাড়া তার অধীনেই সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে একবার রানার্সআপ (২০১৬), দু’বার সেমিফাইনাল খেলে মেয়েরা। অন্যদিকে এসএ গেমস ফুটবলে দু’বার ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেছে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল।
বাংলাদেশের ছেলেদের ফুটবল যেখানে নিম্নমুখী, মেয়েদের ফুটবল সেখানে আশার আলো দেখিয়ে যাচ্ছে। সঠিক যত্ন নিলে বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে আরো বড় সাফল্য হয়ত এই মেয়েদের হাতে ধরেই অর্জন করা সম্ভব। এদেশের সমাজ, লোকচক্ষু আর দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করা মেয়েগুলোর কাছে ফুটবলটা যে অনেক সহজ কাজই মনে হয়। বংলাদেশের নারী ফুটবল দলের অদম্য ইচ্ছাশক্তি দেখেই হয়ত কবি বলেছিলেন- “শোনো নারী, তুমি চাইলেই পারো সব!”
- 0 মন্তব্য