• ক্রিকেট

বিশ্বকাপে বাংলাদেশ: মোস্তাফিজ পর্ব।

পোস্টটি ২৭০৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
সহজ সরল, শুকনো শরীরের অচেনা এক পেসারের আগমন ঘটে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে। যারমধ্যে এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু আছে বলে কেউ মনে করেনি। স্বল্পভাষী, চিকনা গড়নের সেই অচেনা বালকই হয়ে উঠলেন বিস্ময় বালক। সেই ২০১৫ সালেই, যার নাম ডাক ছড়িয়ে পড়লো চতুর্দিকে। যিনি হয়ে গেলেন পুরো বিশ্ব ক্রিকেটের এক বিস্ময় পেসার। যার বল খেলা তো দূরে থাক, বুঝতে পারাই ছিল ব্যাটসম্যান দের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বলছি মোস্তাফিজের কথা। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিস্ময় বালক হয়ে আবির্ভাব সাতক্ষীরার এই পেসারের। মোস্তাফিজের অভিষেক ছিল স্বপ্নিল অভিষেক। ভারতের মতো ওয়ার্ল্ড ক্লাস ব্যাটিং লাইন আপের বিপক্ষে কোথাকার এক অচেনা মিডিয়াম ফাস্ট বোলারের আন্তর্জাতিক ওডিয়াইতে অভিষেক! দর্শকরা হতাশই ছিল বলা যায়। তবে মোস্তাফিজের ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটে আবির্ভাব তার আগের সিরিজে পাকিস্তানের সাথে টি টুয়েন্টি ইন্টারন্যানালে। সে ম্যাচেই সে ২ উইকেট নিয়ে তার আগমনী বার্তা দিয়ে রেখেছিল বিশ্ব ক্রিকেট কে। তারপর যা হল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না "দ্য মাইটি" ভারতীয় ক্রিকেট দল। এর আগে ২০১৪ সালের খর্ব শক্তির ভারতীয় দল বাংলাদেশে খেলতে আসলেও ২০১৫ বিশ্বকাপের পর পূর্ণ শক্তির ভারতীয় দলই আসে বাংলাদেশ সফরে। অচেনা, অজানা চিকনা চাকনা গড়নের মোস্তাফিজ অভিষেকেই নিলেন ৫ উইকেট। ভারতীয় শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপকে বিধ্বস্ত করে স্বপ্নিল অভিষেক হল ক্রিকেটের বিস্ময় বালক মোস্তাফিজের। ফিজের বোলিং ক্যারিশমায় বাংলাদেশ সে ম্যাচ জিতে ভারত কে ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড কাপে কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ কে প্রশ্নবিদ্ধ ম্যাচে হারানোর নিদারুণ প্রতিশোধ নেয়। বিশ্ব ক্রিকেটের এমন অনেক ক্রিকেটারই আছেন যারা অভিষেকে চোখ রাঙানো পারফর্মেন্স দিয়ে নজর কাড়লেও পরের ম্যাচেই হারিয়ে যায়। কিন্তু না, মোস্তাফিজ ভারতের বিপক্ষে সিরিজের ২য় ম্যাচে আরো ভয়ংকর বোলিং দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন হারিয়ে যেতে নয় ক্রিকেট বিশ্ব কে শাসন করতে তার আবির্ভাব। ২য় ম্যাচে, ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপকে দুমড়েমুচরে দিয়ে ফিজ শিকার করলেন ৬ উইকেট। মোস্তাফিজের কাটার, স্লোয়ারের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ ভারতীয় ক্রিকেট দলের। মোস্তাফিজের যাদুকরী বোলিং ক্যারিশমায় ১ম বারের মতো ভারতকে হারিয়ে ওডিয়াইতে সিরিজ জিতে বাংলাদেশ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মহাচুরির সেই ম্যাচের কড়া জবাব দেয় ভারতকে। আর বিশ্ব ক্রিকেটেও আবির্ভাব ঘটে "দ্য কাটার মাস্টার" খ্যাত ওয়ান্ডার বয় "প্রিন্স অব সাতক্ষীরা"র মোস্তাফিজের। মাইটি ভারতের বিপক্ষে এমন স্মরণীয় বোলিংয়ের পর পুরো বিশ্ব ক্রিকেটে দারুণ নাড়া দিতে সমর্থ হয় মোস্তাফিজ। চারদিকে মোস্তাফিজ কে নিয়েই আলোচনার ঝড় বইতে থাকে। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই অচেনা অজানা এক তরুণ পেয়ে যায় তারকা খ্যাতি। এরপরের ইতিহাস মোস্তাফিজের "ফিজ" হয়ে উঠার গল্প। ভারতের সাথে ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের পর সাউথ আফ্রিকা আসে বাংলাদেশে। আফ্রিকার সাথেও মোস্তাফিজের ক্যারিশম্যাটিক বোলিং চলতে থাকে। আফ্রিকার বিরুদ্ধেও ৫ উইকেট নেন কাটার, স্লোয়ারের যাদুকরী বোলার মোস্তাফিজ। সৌম্য, তামিম, মোস্তাফিজের ক্যারিশমায় আফ্রিকাকেও প্রথম বারের মতো ওডিয়াইতে সিরিজ হারের তিতা স্বাদ দেয় বাংলাদেশ। ২০১৫-২০১৬ সাল ছিল মোস্যাফিজের জন্য স্বপ্নিল কিছু সনয়। ঠিক মতো কথা বলতে না পারা, শুকনো গড়নের এই বোলার কথা বলান তার বোলিং দিয়ে। তার বল তারপক্ষে কথা বলে। এরমধ্যেই অনেক গুলো রেকর্ডের পাশে নিজের নাম জড়ান মোস্তাফিজ। বিশ্বের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক ওডিয়াই ও টেস্টে "ম্যান অব দ্যা ম্যাচ" জেতার বিরল রেকর্ড গড়েন বিস্ময় বালক খ্যাত মোস্তাফিজ। সাফল্যে ভরে উঠে তার ছোট্ট ক্যারিয়ার। এরই মাঝে ডাক পান "ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ", আইপিএলের দল হায়দ্রাবাদের হয়ে খেলার। আর প্রথম বারের মতো খেলতে গিয়ে রীতিমতো সকলের মন জয় করে নেন ইংরেজি না জানা, ঠিক মতো কথা বলতে না পারা ফিজ। আইপিএলেও চলতে থাকে মোস্তাফিজের যাদুকরী বোলিং ক্যারিশমা। বিশ্বের বাঘা বাঘা প্লেয়ার রা তার বল কোনো রকম ভাবে খেলতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাছতো। অধিকাংশ ব্যাটসম্যানই তার স্লোয়ার, কাটার গুলো বুঝতেই পারতো না। ইংরেজি বলতে না পারা মোস্তাফিজের ভাষা, বাংলা বুঝতে হায়দ্রাবাদের টিম ম্যানেজমেন্ট ও কোচের রীতিমত বাংলা শিখতে দেখা যায় সেবার আইপিএলে। আসরে ১৭ উইকেট নিয়ে মোস্তাফিজ সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের খেতাব নিয়ে দেশে ফেরেন। সেই সাথে দলকেও চ্যাম্পিয়ন করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আর সেই থেকেই মোস্তাফিজ হয়ে উঠেন "ফিজ, দ্য কাটার মাস্টার"। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও আইপিএলে ধারাবাহিক সাফল্যে মোস্তাফিজ খেলার সুযোগ পেয়ে যান ক্রিকেটের পুরানো ও মর্যাদাকর ঘরোয়া আসর কাউন্টিতে খেলার। সাসেক্সের হয়ে প্রথম ম্যাচে দারুণ অভিষেকও হয় ফিজের। ৪ উইকেট শিকার করে ম্যান অব দ্য ম্যাচও নির্বাচিত হোন ফিজ। কিন্তু........ কিন্তু তারপরই আসে ফিজের ২য় ইনিংসে পথ চলার। সাফল্যে সাফল্যে উড়তে থাকা দুর্দমনীয় ফিজ কে যেখানে কোনো ব্যাটসম্যানই দমাতে পারছিল না, সেখানে ফিজ "দ্য কাটার মাস্টার" কে দমিয়ে দেয় ইনজুরি নামক ভয়াল সে শত্রু। আর এই ইনজুরিই কেড়ে নেয় মোস্তাফিজের সাফল্যমণ্ডিত মোমেন্টাম। এরপর বার কয়েক ইনজুরিতে পড়েন মোস্তাফিজ। তারপর নিজের চিরচেনা সেই ছন্দ হারিয়ে ফেলেন ফিজ। গড়পড়তা হয়ে যায় তার পারফর্মেন্স। ২০১৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশের ট্রামকার্ড বিবেচনা করা হলেও ফিজের অর্জনের খাতা ছিল শূন্য সেই টুর্নামেন্টে। ২০১৮ সালও কেটেছে ইনজুরি ,আবার ইনজুরি থেকে রিকোভার করে খেলা, এই ভাবেই। এর মধ্যে সেই ২০১৫-১৬ সালের মোস্তাফিজ কে দেখা না গেলেও নোস্তাফিজের পারফর্মেন্স খারাপ ছিল না। সাম্প্রতিক সময়েও মোস্তাফিজ দারুণ ছন্দে আছেন। আর তার সাম্প্রতিক ফর্ম বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পরে অভিষেক হয় ফিজের। ১৫ বিশ্বকাপে মোস্তাফিজের অভিষেক হলে অন্যরকম কিছু ঘটে যেতে পারতো বিশ্ব ক্রিকেটে। যাইহোক, এবারের বিশ্বকাপই প্রথম বিশ্বকাপ ২৩ বছর বয়সী মোস্তাফিজের। বামহাতি এই পেসারের জাদুকরী সময়টা ফিরে আসুক এই বিশ্বকাপে, সেটাই ১৭ কোটি বাংলাদেশী ক্রিকেট প্রেমীর চাওয়া পাওয়া। ৪ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে মোস্তাফিজ অনেক অর্জনের পাশে নিজেকে যুক্ত করেছেন। এরই মধ্যে জাতীয় দলের হয়ে ৪৬টি ওডিয়াই ম্যাচ খেলে ফেলেছেন কাটার মাস্টার। ৪৫ ইনিংসে বল করে মোস্তাফিজের শিকার ৮৩ উইকেট। ৪৩ রানে ৬ উইকেট তার সেরা বোলিং ফিগার, যা ভারতের বিপক্ষে করেছিল ফিজ। ক্যারিয়ারে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৩ বার। তার ইকনোমিও যথেষ্ট ভাল, ৪.৮৮। যদিও কয়েকটা ম্যাচে মোস্তাফিজ ৮০+ রান দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন, তবুও উইকেট শিকারে সে-ই বাংলাদেশের সেরা বোলার। এখনো অবধি মোস্তাফিজ একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২২৭৩ টি বল করে রান দিয়েছেন ১৮৪৯। সুতরাং রান আটকানোতে তার ক্যাপাবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন থাকার অবকাশ নেই। বিশ্বকাপ হল নিজের সাথে নিজের লড়াই করে নিজের সেরাটা উপহার দেওয়ার সেরা মঞ্চ। আর মোস্তাফিজ যদি তার পুরানো ছন্দে ফিরতে পারে তাহলে এবারের বিশ্বকাপ যে মোস্তাফিজের জন্য সাফল্যমণ্ডিত হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।অনেক অনেক শুভ কামনা মোস্তাফিজের জন্য। ভাল খেলুক। আর দেশের সম্মান বয়ে আনুক সেটাই কাম্য। বিশ্ব জয়ে নেতৃত্ব দাও তোমার জাদুকরী বোলিং দিয়ে,বাংলাদেশের অনেক দিনের বপন করা স্বপ্ন কে বাস্তবে রূপ দিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন কর, সেটাই প্রত্যাশা তোমার কাছে হাজারো ক্রিকেট ভক্তের। শুভ কামনা প্রিয় ফিজ। শুভ কামনা বাংলাদেশ।।