বিশ্বকাপে বাংলাদেশ: তামিম পর্ব।
পোস্টটি ৩৯৫৩ বার পঠিত হয়েছেতামিম ইকবাল খান। চট্টগ্রামের খান পরিবারের অন্যতম সদস্য। চাচা আকরাম খান ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সোনালি যুগের সেরা খেলোয়াড় ও বাংলাদেশ দলের কাপ্তান। বর্তমানে বিসিবি পরিচালক ও ক্রিকেট অপারেশন্স চেয়ারম্যান। বড় ভাই নাফিস ইকবালও বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক তারকা খেলোয়াড়। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তামিম ইকবালও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন। তবে সাফল্য, অর্জনে আর খ্যাতিতে চাচা, ভাইকে পিছনে ফেলে তামিম বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বের সেরাদের কাতারে নিজের নাম লিখিয়েছেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডব দের একজন তামিম ইকবাল খানের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা এক যুগের। ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টগবগে এক যুবকের অভিষেক হয় বাংলাদেশ দলে। কে জানতো এই যুবকই হয়ে উঠবে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান।
২০০৭ সালেই পঞ্চপাণ্ডবের অন্য দুই সদস্য, সাকিব মুশফিকের সাথে বিশ্বকাপ অভিষেক হয়ে যায় তামিমের। আর অভিষেক ম্যাচেই বাজিমাত করেছিলেন তামিম। ভারতের বিপক্ষে সে ম্যাচে তার ফিফটি শুধু প্রশংসিতই হয়নি, জহির খানের বিরুদ্ধে তার ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছক্কা হাকানো, আগামীর ড্যাশিং ওপেনারের আভাস দিয়েছিল ভালভাবেই।
২০০৭ থেকে ২০১৯ সাল, ওপেনিংয়ে এক প্রান্তে বাংলাদেশের একমাত্র ভরসার পাত্র তামিম। দেশের জন্য খেলে যাচ্ছেন অবিরত। তামিমের ব্যাটিং ক্যারিয়ার কে দুটো যুগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি ২০০৭ থেকে ২০১৫ বিশ্বকাপ পূর্ব যুগ। ২য় টি ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে বর্তমানে চলমান যুগ।
১ম যুগেও তামিম দেশের সেরা ওপেনার ছিলেন আর বর্তমানে চলমান যুগে তো আছেনই। তবে তফাত হচ্ছে তামিমের প্রথম যুগে, তামিম সেরা ওপেনার থাকলেও সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন না বাংলাদেশের। কিন্তু বর্তমানে তামিম ইকবাল দেশের তো বটেই ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। বর্তমানে যুগে বাংলাদেশের সেরা ওপেনার তামিম ইকবাল খান বিশ্ব ক্রিকেটেরও সেরা ওপেনার। ভারতের রোহিত শর্মা কে পিছনে ফেলে এখন তামিমই বিশ্বের সেরা ওপেবার।
এসব কিন্তু এক দিনে হয়ে যায়নি। এসবই তামিমের কঠোর সাধনা আর পরিশ্রমের ফসল। প্রথম যুগেও তামিমের ব্যাটে রান আসতো, কিন্তু সেটা ধারাবাহিক ছিল না। আগে তামিম ব্যাটিং করতে নামলে সমর্থক রা টেনশনে থাকতো, এই বুঝি তামিম আউট হয়ে গেল, এই বুঝি ছক্কা মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিল, এই বুঝি ডাউন দ্য উইকেটে এসে খেলতে গিয়ে স্ট্যাম্পিং হয়ে গেল! এসব ভীতির মধ্যে থাকতে হতো সাধারণ দর্শকদের। আর এখন.....
এখন তামিম খেলতে নামলে বাংলাদেশ নির্ভার থাকে যে তামিম কে ভাল সঙ্গ দিলে ভাল একটা ভীত গড়ে দিবে ব্যাটিংয়ের শুরুতে। তামিম খেলতে নামলেই এখন আমরা আশা করি তামিম সেঞ্চুরি করবে, সেঞ্চুরি না করলেও হাফ সেঞ্চুরি তো করবেই.।
২০১৫ বিশ্বকাপের পর তামিমের মানসিকতায় দারুণ পরিবর্তন সাধিত হয়। যে তামিম খেলতে নামলেই বলে বলে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে পড়তো সে এখন বল বুঝে তবেই শট খেলতে আগ্রহী হয়। যায়গায় দাঁড়িয়েও তামিম এখন ৯০-১০০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করতে পারদর্শী। এখনো তামিমের ব্যাটে ছক্কার ফুলঝুরি দেখতে পায় ক্রিকেট প্রেমীরা, এখনো তামিম ডান্সিং ডাউন দ্য উইকেটে এসে মন শীতল করা দৃষ্টিনন্দন শট খেলে, কিন্তু পূর্ব যুগের তামিমের সহিত এই তামিমের তফাৎ হল আগের তামিম ৬ বল খেললে ৫ টাতেই বড় শট খেলার জন্য আগ্রহী থাকতো আর এখন...। এখনতো দেখতেই পাচ্ছেন তামিমের ক্যারিয়ার স্টেট।
৩০ বছর বয়সী বামহাতি ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল এখন দেশসেরা ব্যাটসম্যান। দেশের হয়ে ক্রিকেটের সব ফর্মেটেই সর্বোচ্চ রানের মালিক তামিম ইকবাল খান। সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি ও হাফ সেঞ্চুরি করার রেকর্ডও তামিমের অর্জনের খাতায় যুক্ত।
এখনো অবধি তামিম ১৯৩ ওডিয়াই ম্যাচ খেলেছে। তারমধ্যে ১৯১ ইনিংসে ব্যাট করে ৩৬.২৬ গড়ে দেশের হয়ে ওডিয়াইতে সর্বোচ্চ ৬৬৩৬ রান করেছে। ক্যারিয়ারে শতক রয়েছে ১১টি আর অর্ধশতক ৪৬টি। তামিমের স্ট্রাইক রেটও যথেষ্ট ভাল, একজন আদর্শ ওডিয়াই ব্যাটসম্যান এর মতোই, ৭৮.১৫। তামিমের ওডিয়াইতে সেরা ইনিংস জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে, ১৫৪ রানের ইনিংস । ওডিয়াই তে বাংলাদেশের পক্ষে এখনো অবধি সর্বোচ্চ ছক্কা হাকানো ব্যাটসম্যানও তামিম (৮২টি)। তামিমের ওডিয়াই ক্যারিয়ারের অর্জন বিবেচনা করলে দেখা যাবে লাস্ট ৪ বছরে কতটা সফল তামিম।
২০০৭ থেকে ২০১৫ বিশ্বকাপ পর্যন্ত তামিমের ওডিয়াই রান ছিল ৪ হাজার। আর এখন ৬৬৩৬। তারমানে ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে গত ৪ বছরে তামিম ইকবাল রান করেছে প্রায় ৩ হাজার! ২০১৫ বিশ্বকাপ পর্যন্ত তামিমের শতক ছিল মাত্র ৪টি। এখন ১১টি। মানে গত চার বছরে তামিম শতক করেছে ৭টি! এটাই বর্তমান তামিম। যার সাথে পূর্বের তামিমের বিস্তর ফারাক।
বিশ্বকাপে তামিমের পথচলা ২০০৭ বিশ্বকাপ থেকে। এরপর খেলে ফেলেছেন ৩টি বিশ্বকাপ। সাকিব মুশফিকের সাথে তামিমও বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২১টি ম্যাচ খেলেছেন। ১ম ম্যাচে খেলতে নেমেই তামিমের দারুণ ইনিংস দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। ভারতের বিপক্ষে ২০০৭ সালে ৫৩ বলে ৫১ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলেছিল তরুণ তামিম ইকবাল। গত ৩ বিশ্বকাপে ২১ ম্যাচ খেলে তামিম দেশের হয়ে সাকিব মুশফিকের পর ৩য় সর্বোচ্চ রানের মালিক। ২৩.৩০ গড়ে ৪৮৩ রান করেছে চট্টগ্রামের ছোট খান সাহেব। কোনো সেঞ্চুরি না থাকলেও ৩টি হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে তামিমের। সর্বোচ্চ ৯৫ রান, ২০১৫ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের সাথে।
তামিমের এতো অর্জনের পাশে একটা অপূর্ণতা তো থেকেই গেল, বিশ্বকাপের আসরে কোনো সেঞ্চুরির দেখা যে পায়নি এখনো দেশসেরা ওপেনার। তবে আইসিসির ইভেন্টে তামিমের শতক রয়েছে। ২০১৬ সালে আইসিসি টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপে দেশের হয়ে টি টুয়েন্টিতে প্রথম শতকের দেখা পান তামিম। এছাড়াও আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ইংল্যান্ডের সাথে তামিম সেঞ্চুরি করে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও সেঞ্চুরি করার অর্জন নিজের সমৃদ্ধ অর্জনের খাতায় যুক্ত করেছে। কিন্তু বিশ্বকাপের আসরে তামিম শতক না পাওয়ায় দর্শক ভক্তকুল দারুণ ভাবে হতাশ। তবে এই হতাশা আনন্দে রূপ নিবে এবারের বিশ্বকাপে সেটাই প্রত্যাশা দেশসেরা ব্যাটসম্যান এর কাছে। এবারের বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করতে পারলে আইসিসির সব গুলো ইভেন্টেই সেঞ্চুরি করার অনন্য মাইলস্টোন ছুঁয়ে ফেলবে তামিম। ভক্তদের বিশ্বাস তামিম সেটা অবশ্যই করবে।
বিশ্বকাপের আগের আসর গুলো বর্তমান তামিম সুলভ না হলেও এবারের বিশ্বকাপ তামিমসুলভ হবে এটা বলাই যায়। তামিমের ব্যাট হাসলে বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে দারুণ সূচনা ও শক্ত ভিত গড়ে দিবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এবারের বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে সেরা ফর্ম ও সময়ে আছে তামিম। আর এটাই আমাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে বিশ্বজয়ের। তামিমের ব্যাটে ভর করে বিশ্বজয় করুক বাংলাদেশ সেটাই চাওয়া পাওয়া। ওডিয়াইতে ৭ হাজার রানের মাইলফলক ছোঁয়ার হাতছানি তামিমের সামনে, আর সেটা বিশ্বকাপে ছুঁয়ে ফেললে তার মাহাত্ম্য অনেক গুণ বেড়ে যাবে। অনেক অনেক শুভ কামনা তামিম ইকবালের জন্য। ভাল খেলুক সে, ভাল খেলুক বাংলাদেশ। বিশ্ব জয়ের মঞ্চ সাজানো, এবার শুধু পারফর্ম করা বাকি।
- 0 মন্তব্য