• ফুটবল

বাংলার ফুটবল

পোস্টটি ৩৮২৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ফুটবল, যে নামের সাথে মিশে আছে কত আবেগ, কত ভালোবাসা, কত গল্প। কত ইতিহাস, কত জীবন জড়িয়ে আছে এই খেলাটির সাথে। হয়তো এটি শুধু ৯০ মিনিটের একটি খেলা, মাঠে ২২ জন খেলোয়াড়ের ছোটাছুটি। কিন্তু কালক্রমে এটি হয়ে গেছে কোটি কোটি ভক্তদের আনন্দ বেদনা উত্তেজনা আবেগ ভালোবাসার উৎস।
যে খেলাটির সাথে জড়িয়ে আছে এতকিছু, সেই খেলার সাথে বাঙালির কি সম্পর্ক? বাংলায় ফুটবল এলোই বা কিভাবে?
তুলনামূলক ভাবে দেখলে দেখতে পাওয়া যায়, ফুটবলে বহির্বিশ্বের তুলনায় বাঙ্গালিরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিন্তু ফুটবলের প্রতি ভালোবাসার দিক দিয়ে বাঙ্গালিরা অন্যদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে, এইটা হলপ করেই বলা যায়।
বাংলায় ফুটবলের সূচনা নিয়ে যে কাহিনী শোনা যায়, সেটা অনেকটা গল্পের মতো। শুরুটা হয় কলকাতায়। ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের অধীন। অন্যান্য বিদেশি খেলার মতো ফুটবল খেলারও এদেশে আগমন ইংরেজদের হাত ধরে। বৃটিশ ভারতের তখন ক্লাইম্যাক্স চলছে৷ তাদের বিভিন্ন ঐতিহ্য বাঙ্গালিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া শুরু করেছে। অন্যান্য সংস্কৃতির মতো পশ্চিমা খেলাধুলারও প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। ফুটবল, ক্রিকেট, রাগবি প্রভৃতি খেলার সাথে ভারতীয় রা পরিচিত হতে শুরু করেছে৷ তবে তখনও এসব খেলা সাধারণদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েনি।
তখন নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী নামে এক ছেলে কলকাতা হেয়ার স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সে এবং তার বন্ধুরা মিলে কিছু চাঁদা তুলে কিনে ফেললো একটি বল। তারপর সবাই মিলে নামলো মাঠে। কিন্তু সেদিন যে খেলা হলো, সেটা কে আর যাই হোক, ফুটবল বলা যায়না। যে যেদিকে পারে, এলোপাথাড়ি লাথি, ছোটাছুটি, যে যেখানে খুশি মারছিলো। কীয়েক্টা অবস্থা! প্রেসিডেন্সি কলেজ আর হিন্দু স্কুলের ছেলেরাও জয়েন করলো খেলায়। কিছু মানুষ আবার দর্শক হিসেবেও দাঁড়িয়ে গেল অদ্ভুত এ খেলা দেখতে।
কিছুদিন পর প্রেসিডেন্সি কলেজের ব্রিটিশ অধ্যাপক বি ভি স্ট্যাক দেখলেন এ কিম্ভুতকিমাকার খেলা। তিনি তো পুরোই হতবাক। এরপর তিনি নিজেই উদ্যোগ নিলেন। নিয়ে আসলেন এক চমৎকার বল। সব আইন কানুন শিখিয়ে দিলেন। ছাত্রদের দুই দলে ভাগ করে তিনি নিজেই বাঁশি মুখে নেমে গেলেন রেফারি হিসেবে। এভাবেই বাংলায় শুরু হলো ফুটবল।
এরপর বাংলায় চলতে থাকলো হলো ফুটবলের অগ্রযাত্রা। এখানেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন সেই নগেন্দ্র। কলকাতায় তাঁর হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হলো ওয়েলিংটন ক্লাব, যেটি নাম পালটে পরে হলো টাউন ক্লাব। তারপর প্রতিষ্ঠিত হলো শোভাবাজার ক্লাব। এটার প্রতিষ্ঠাও তাঁর হাতেই। আস্তে আস্তে এখান থেকে পুরো ভারতবর্ষেই জনপ্রিয় হতে থাকলো ফুটবল, যার শুরুটা হলো বাংলাতেই।
কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হলো মোহনবাগান, ইস্ট বেঙ্গল, মোহামেডান এর মতো সব নামি দামি ক্লাব। এগিয়ে যেতে থাকলো বাংলার ফুটবল।
এবার আসি পূর্ব বাংলায়। ফুটবলে এপারের ঐতিহ্যও কিন্তু কম নয়। ঢাকাই ফুটবলের শুরুটা ঢাকা কলেজের হাতে ধরে। একে একে শহর ও মফস্বলে গড়ে ওঠে বেশ কিছু ক্লাব। এগুলোর মধ্যে ঢাকার ওয়েলিংটন ক্লাব অনেক পুরোনো। পরে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ওয়ারী ক্লাব।
তখন ইংল্যান্ডের ক্লাব করিন্থিয়ান ছিলো বিখ্যাত একটি ক্লাব। এরা সারা বিশ্বে ভ্রমণ করতো ফুটবল জনপ্রিয় করার জন্য। এরা ঢাকায় এসে সেসময় ঢাকা স্পোর্টিং এসোসিয়েশন (ডিএসএ) এর সাথে মুখোমুখি হয়। সে ম্যাচে অসাধারণ খেলে ডিএসএ। এবং অবশেষে করিন্থিয়ান কে হারায় ১-০ গোলে। তাদের সে কি উল্লাস! আসলে উল্লাসের ঘটনাই বটে। দূর প্রাচ্যে এর আগে করিন্থিয়ান কোনো ম্যাচ হারেনি। কলকাতাতেও মোহামেডানের সাথে করেছে ড্র, বাকি সব ম্যাচে জয়। আর তারাই পরাজিত হলো বাংলার টাইগার দের কাছে। পরে করিন্থিয়ানের অধিনায়ক ক্লার্ক বলেছিলেন, "রয়েল বেঙ্গল টাইগারের নাম শুনেছিলাম, এইবার চোখে দেখলাম।"photo-1427280212
১৯৫০ এর দশকে ঢাকাই ফুটবল জমে ওঠে। তখন জনপ্রিয় ছিলো প্রধানত চারটি ক্লাব। মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স, ওয়ারী ও আজা স্পোর্টিং। মোহামেডান ও ওয়ান্ডারার্সের মধ্যেকার দ্বৈরথ তখন ছিলো তুমুল জনপ্রিয়। আর আজা স্পোর্টিং বিখ্যাত ছিলো ছিমছাম সাজানো সুন্দর ফুটবলের জন্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ কামাল প্রতিষ্ঠা করেন আবাহনী লিমিটেড। এবং তার পরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা দ্বৈরথ আবাহনী-মোহামেডান। এই দ্বৈরথ এখনো অব্যাহত। এখনো আবাহনী বনাম মোহামেডান মানেই যেন বিশেষ কিছু। আরো পরে প্রতিষ্ঠিত হয় শেখ জামাল, শেখ রাসেল প্রভৃতি ক্লাব, বর্তমানে যাদের দাপট দেখার মতো। তার সাথে ব্রাদার্স ইউনিয়ন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আরামবাগ রাও প্রতিযোগিতাপূর্ণ ফুটবল খেলে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত বসুন্ধরা কিংস ও সাইফ স্পোর্টিং এর মতো ক্লাব গুলোও আমাদের সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় ফুটবল উপহার দিচ্ছে, যেটা না বললেই নয়। কিছুদিন আগে অনেকটা রঙ হারিয়ে ফেললেও সম্প্রতি ঢাকাই ফুটবল বেশ জাকজমক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যেটা আমাদের জন্য বেশ আশার কথা।
আর বাংলাদেশের ফুটবল ফ্যান দের কথা তো আলাদা করেই বলতে হবে। যেকোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেই বাংলাদেশের পথ ঘাট চারিদিকে ভরে ওঠে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা প্রভৃতি দেশের পতাকায়। তার মাঝে মাঝে জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড, পর্তুগালের পতাকাও দেখা যায় কোথাও কোথাও। এসব মৌসুমে চারিদিকে শুধু চলতে থাকে ফুটবল নিয়ে কথা বার্তা, বিতর্ক। অন্যরকম একটা পরিবেশ বিরাজ করে চারিদিকে। বিশ্বকাপের ম্যাচ গুলোতে, সমর্থিত দলের জয় পরাজয়ে বাঙালির আনন্দ, উত্তেজনা, আবেগ একদমই অকৃত্রিম। বাঙালির এ ফুটবল উন্মাদনা একদমই বিস্ময়কর।
বাংলার ফুটবলে উন্নতি হোক, এটাই আশা করি। ইনশাল্লাহ বাংলাদেশও একদিন ফুটবলে অনেক উন্নতি করবে, বাংলাদেশ কে দেখবো ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চ, "দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ" ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপে; এটাই কামনা করি।
(ইনফরমেশন সোর্সঃ প্রথম আলো)