• ক্রিকেট

ব্যর্থতা, ফর্মহীনতা, দায় কার? কোন পথে দেশের ক্রিকেট? কোথায় ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট?

পোস্টটি ৫০৩৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

লজ্জার তো বটেই। একে তো হোয়াইট ওয়াশ তার উপর এমন বড় ব্যবধানে হার। সিরিজে একটি ম্যাচেও কোনো প্রকার প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারেনি তামিম বাহিনী। সাকিব মাশরাফি বিহীন এ কোন বাংলাদেশ! এই বাংলাদেশের সাথে ক্রিকেট প্রেমীদের সর্বশেষ দেখা হয়েছিল ২০১৪ সালে, যখন ঘরের মাটিতে ভারতের বি গ্রেডের দলের সাথেও হোয়াইট ওয়াশ হয়েছিল টাইগারবাহিনী। এর পর থেকে বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশের দেখা পেয়েছিল ক্রিকেটপ্রেমীরা। মাশরাফির নেতৃত্বে আমূল বদলে যায় এদেশের ক্রিকেট খেলার ধরণ। যারা ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে একের পর এক ক্রিকেটীয় রথীমহারথীদের হারিয়ে সগৌরবে এগিয়ে চলছিল সামনের দিকে। সেই দলের সাথে সদ্য শ্রীলঙ্কার সাথে হারা বাংলাদেশ দলের কোনো মিল খুজে পাওয়া যায় কি? অদম্য মানসিকতার বাংলাদেশ দল, হারলেও বুক চিতিয়ে লড়াই করে তবেই হারতো, অথচ শ্রীলঙ্কার মতো দলের সাথে টাইগারদের এমন অসহায় আত্মসমর্পণ করে হারার স্বাদ টাইগারপ্রেমীরা ২০১৪ এর পর আর পায় নি। ২০১৪ সালের পর টিম টাইগার্স কখনোই টানা ৫ ওয়ানডেতে হারেনি। অথচ বিশ্বকাপের শেষ দু ম্যাচ ও শ্রীলঙ্কা সফরের তিন ম্যাচে টাইগাররা সামান্যতম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বকাপে ভারতের সাথে ম্যাচে তাও কিছুটা ম্যাচে ছিল। কিন্তু বাকী চার ম্যাচে কোনো প্রকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা দূরে থাক দাড়াতেই ব্যর্থ হয়েছে টাইগাররা। তবে সবচেয়ে সেকি লেগেছে শ্রীলঙ্কার সাথে এমন এক পেশে হারাটা। ৩ ম্যাচের কোনোটাতেই দাড়াতে পারলো না বাংলাদেশ ক্রিকেট দল! দলে সাকিব, মাশরাফি ছিল না, কিন্তু তাই বলে আমরা এমন অসহায় আত্মসমর্পণ করবো! তাও আবার শ্রীলঙ্কার মতো দলের সাথে! যাদের সাথে কিনা আমরা গত কয়েক বছরে খুব সহজেই জিতে যেতাম। শ্রীলঙ্কার সাথে এমন হারের দায় কি কেবল প্লেয়ারদের? চলুন কিছুটা পিছনে যাওয়া যাক.... ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটের পথচলা ছিল স্বপ্নের মতো। ২০১৮ সালের দুবাই এশিয়া কাপ আর শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত নিদাহাস ট্রফির কথাই চিন্তা করুন না, এছাড়া সে বছর ঘরের মাটিতে ট্রাই নেশন সিরিজের কথাই ভাবুন। কি অসাধারণ খেলেছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে ফিরে যান, সেবারও কি দুর্দান্তই না খেলেছিল! প্রথম বারের মতো চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমি ফাইনাল খেলা, ২০১৬ সালেও সাফল্যের গ্রোথ ঊর্ধ্বগামীই ছিল। এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলা, টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচ সহ আরো কয়েকটি ম্যাচে ক্লোজলি হারা কিন্তু জয়ের সম্ভাবনা ধরে রাখা। ২০১৫ সাল তো ছিল এসব সাফল্য গাথা তৈরির বছর, বদলে যাওয়া বাংলাদেশের বিশ্বকে চমকে দেওয়ার শুরুর বছর। মাশরাফি নামক পরশ পাথরের ছোয়ায় টিম টাইগার্সের নতুন শুরুর বছর। বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা, ঘরের মাঠে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান কে বাংলাওয়াশ করা, আরেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত কে হারিয়ে প্রথম ওডিয়াই সিরিজ জয়, সাউথ আফ্রিকার মতো ক্রিকেট পরাশক্তি কে হারিয়ে প্রথম সিরিজ জয়। সব মিলিয়ে স্বপ্নের মতো বছর কাটিয়ে নতুন বাংলাদেশের শুরু হয় ২০১৫ সালে। যাদের পথচলা ছিল অবিরাম ২০১৯ সালের শুরু অবধি। এই সময়ে বাংলাদেশ দলে আসে কিছু নতুন তারকা, যারা পুরো বিশ্বের দৃষ্টি কাড়তে সামর্থ্য হয়। ২০১৫ সালে মোস্তাফিজ আর সৌম্যের আবির্ভাব হয়, আর তাদের কিছু আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটে গতির ঝড় তুলতে আবির্ভাব হয় তাসকিনের। ২০১৬ সালে টেস্ট ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে মেহেদী মিরাজেরও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাথে পথচলা শুরু হয়। তরুণ এসব প্লেয়ারের অন্তর্ভুক্তি তে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুনত্বের সূচনা হলেও টিম টাইগার্সের মূল পারফর্মার ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডব খ্যাত "ফেভুলাস ফাইভ"ঃ মাশরাফি, মুশফিকুর সাকিব, তামিম, মাহমুদউল্লাহই। হয়তো কোনো ম্যাচে এক দুজন নতুন পারফর্মার থাকতো কিন্তু সামগ্রিক পারফর্মার কিন্তু এই ফ্যান্টাস্টিক ফাইভই ছিল। গত ৪-৫ বছরে তারাই বাংলাদেশ ক্রিকেটকে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম শক্তিধর দল হিসেবে নিয়ে যেতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আর তাদের মূল সহযোগী ছিল তিন তরুণ প্লেয়ার, মোস্তাফিজ, সৌম্য ও তাসকিন। মাঝে এরা প্রত্যকেই ইনজুরিতে পড়েছে তখন বাংলাদেশ দল খেই হারিয়ে ফেলেছিল। বস্তুত পঞ্চপাণ্ডব আর এই তিন ক্রিকেটার ব্যাতীত বাংলাদেশ ওডিয়াই দলের আর কোনো প্লেয়ার কি এমন আছে যারা গত এই কয়েক বছরে একাই কোনো ম্যাচ জিতিয়েছে? বা কোনো প্রভাব ফেলার মতো পারফর্মেন্স করেছে? এখানেই আমাদের মূল ঘাটতি। এবার কিছু ব্যক্তিগত প্লেয়ার নিয়ে কথা বলি, প্রথমেই আসি তামিম কে নিয়ে। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তামিম অসাধারণ বললেও বোধহয় কম বলা হয়ে যাবে, স্বপ্নের মতো ব্যাটিং পারফর্ম করেছে সে। ২০১৮ সালেও তার গড় ছিল (ওডিয়াইতে) ৮০+। অথচ এই তামিমই সর্বশেষ শ্রীলঙ্কা সফরে ৩ ম্যাচ মিলিয়ে ২৫ রানও করতে পারেনি! বিশ্বকাপেও ছিল দারুণ ব্যর্থ এক ওপেনার। গত বছরে যার ওডিয়াই গড় ছিল ৮০+ এবছর তার গড় ২৫! ভাবা যায়! তামিমের আউট অব ফর্মটা শুরু এবছরের বিপিএল থেকেই, যদিও সে ফাইনালে আউটস্ট্যান্ডিং এক শতক হাকিয়ে পুরো টুর্নামেন্টের ব্যর্থতা ঢেকে দেন। কিন্তু এর পর থেকেই তামিমের অধঃপতন শুরু হয়। তামিমের উচিৎ ছিল সময় নেওয়া, নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য জাতীয় দল থেকে ব্রেক নেওয়া। বিসিবিরও উচিৎ ছিল তামিম কে যথাযথ গাইড করা। কিন্তু একের পর এক ব্যর্থ হওয়ার পরেও তাকে দিয়েই ওপেন করানো হয়েছে। কেন???? ইমরুল কায়েস, জাতীয় দলের হতভাগ্য এক প্লেয়ার। যখন যেভাবে ইচ্ছে তাকে দলে নেয়, আবার বিনা কারণে দল থেকে ছেটে ফেলে দেয়, এভাবেই হয়ে আসছে ইমরুলের সাথে। ২০১৮ সালে ইমরুল তার ৮-৯ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করেছে। সবচেয়ে বেশি রান সে-বছরই করেছে সে। অথচ এই ইমরুল কে ২০১৯ সালের নিউজিল্যান্ড সফরে বিনা কারণে দল থেকে বাদ দেওয়া হল, সেই বাদ যে দিল, আর দলেই নিল না, অথচ তাকে বাদ দেওয়ার কারণ হিসেবে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি বিসিবির নির্বাচক প্যানেল। ২০১৮ সালে এতো ভাল পারফর্ম করার পরেও তাকে এবছর বিশ্বকাপ সহ কোনো সিরিজেই আর স্কোয়াড পর্যন্ত রাখা হল না। কেন??? তাসকিন আহমেদ, আগেই বলছিলাম, জাতীয় দলের স্বর্ণালি সময়ে পঞ্চপাণ্ডবের সহযোগী তিন প্লেয়ায়ারের একজন তাসকিন। নিয়মিত একাদশে খেলতো সে এবং পারফর্মও করতো। কিন্তু হঠাৎ ইনজুরির কারণে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ে যায়, এরপর লম্বা সময় আর তাকে দলে নেওয়া হয়নি। এবছর বিপিএল ও ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ খেলার পর সবাই যখন ভেবেছিল তাসকিন বিশ্বকাপ একাদশে থাকছে তখন তাকে বাদ দেওয়া হল কি বলে, ফিটনেস নাকি তার ১০০% ওকে না! শ্রীলঙ্কা সফরেও সেম কারণ বশত কি স্কোয়াডে রেখেও তাকে একাদশে রাখেনি? যদি তা-ই না হবে, তাহলে স্কোয়াডে রেখেও নামায়নি কেন তাকে? কেন??? মিরাজ, নিঃসন্দেহে অনেক ভাল মানের একজন খেলোয়াড়। ভবিষ্যতে হয়তো সাকিবের যায়গাটা সে-ই দখল করবে। হয়তো সাকিবের মতোই বিশ্বসেরা হবে। কেননা তার মধ্যে বিশ্বসেরা হওয়ার সকল গুণাবলিই বিদ্যমান। মিরাজের আবির্ভাব টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে। এবং টেস্টে সে অপরিহার্য ক্রিকেটার। কারণ তার যত সাফল্য সব টেস্ট কেন্দ্রীক। অভিষেক টেস্ট সিরিজেই ১৯ উইকেট নিয়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দেওয়া মিরাজের ওডিয়াই তে ভূমিকাটা কি? হ্যা সে মাঝেমধ্যে ভাল বল করে বটে, কিন্তু তার এমন কি কোনো পারফর্মেন্স আছে, যেখানে পুরো ম্যাচের আলো সে কেড়ে নিতে সামর্থ্য হয়েছে? কিংবা এমন কোনো ম্যাচ জয়ী বোলিং ফিগার কি আছে তার? উত্তর, নেই। ব্যাটসম্যান হিসেবে মিরাজ কে খেলালে কিছু বোলার থাকবে না, কারণ ব্যাটসম্যান হিসেবে মিরাজ কিছু করে দেখাতে পারবে, যদি তাকে সঠিক পজিশনে ব্যাট করানো হয়। কিন্তু বোলার হিসেবে নিলে তার ঠিক কি দেখে তাকে জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য করে রেখেছে টিম ম্যানেজমেন্ট? এখনো কিসের ভিত্তিতে বা কেন খেলতে পারছে সে? কেন?? একই কথা মোহাম্মদ মিঠুনের ক্ষেত্রেও বলা যেতে পারে। আচ্ছা বিসিবির কাছে এত্তসব কেন'র কোনো সদুত্তর আছে কি? এই কেন'র উত্তর খুজলেই আমাদের ব্যর্থতার কারণ অনেকখানি ধরে ফেলতে পারবো আমরা। আমাদের ক্রিকেট ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। যোগ্যদের সুযোগ দিতে হবে। আপনি সুযোগ দিবেন এক ম্যাচের জন্য। খারাপ খেললে আবার বাদ দিয়ে দিবেন। অথচ যারা নিয়মিত অফ ফর্মার তাদের দিয়ে দীর্ঘদিন খেলিয়েই যাবেন, এর মধ্যে তারা এক দু ম্যাচ ভাল খেলে ফেললে তো কোনো কথাই নাই। আর তাদের বাদ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এটা এক ধরণের মহামারী আমাদের টিম ম্যানেজমেন্টের। তাইজুলের কথাই ভাবুন, অভিষেক ওডিয়াই তে হ্যাট্রিক করে বিশ্ব রেকর্ড করার পরেও মাত্র ৪টি ওডিয়াইতে তাকে সুযোগ দিয়েছে খেলার (শ্রীলঙ্কা সিরিজের পূর্ব পর্যন্ত) ইমরুল তার ক্যারিয়ারের সেরা বছর কাটানোর পরেও পরের বছর কোনো কারণ ছাড়াই তাকে দল থেকে বাদ দিয়ে দিল। আল আমিন নামক একজন পেস বোলার ছিল, কি ভাল বোলারই না ছিল, তাকেও বাতিলের খাতায় ফেলে দিল। সোহাগ গাজী, এক সময় জাতীয় দলের নিয়মিত পারফর্মার। তাকেও বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে বিসিবি, কোনো কারণ ছাড়া। অথচ যাদের বাদ দেওয়ার পিছনে কারণের অভাব নাই, তাদের কে বাদ দিতে পারছে না আমাদের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এই বাদ দেওয়া মানে কিন্তু ছেটে ফেলা বুঝাচ্ছি না, অফ ফর্মে তাই বাদ দিয়ে তাদের কে পুরোপুরি তৈরি করার জন্যই বাদ দেওয়ার কথা বলছি। এসময়ে অন্য যারা সুযোগ পাচ্ছে না তাদের সুযোগ দিয়ে দেখুন, ব্যর্থ হলে না হয় আবার বাদ দিয়ে দিবেন, কিন্তু সুযোগ তো দিবেন! পরিশেষে আমাদের পঞ্চপাণ্ডবদের মতো ক্রিকেটার তৈরি করতে হবে। যারা নিয়মিত পারফর্ম করে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যাবে। দলগত পারফরম্যান্স দিয়ে সর্বদা জয়ের ট্র‍্যাকেই থাকবে। তবে এটা খেয়াল রাখতে হবে, খারাপ সময় যে কোনো প্লেয়ারেরই আসতে পারে। তাই তাকে রিকোভার করার সুযোগ দিতে হবে। তবে আনলিমিটেড যদি কাউকে সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে সেটা দলের জন্যই হানীকারক হবে। শুভ কামনা টিম টাইগার্সের জন্য। পুরানো টিম টাইগার্সকেই আবারো নতুন ভাবে চাই। যারা শুধু সামনে এগিয়ে যেতে জানে পিছপা হলেও পিছনে পড়ে যায় না।