ঢাকার ফুটবল ও মোহামেডান
পোস্টটি ৬৯৫০ বার পঠিত হয়েছেতখন আমি অনেক ছোট। স্কুলেও ভর্তি হইনি। বয়স হবে হয়তো চার। মনে পড়ে, তখন আব্বুর মুখে ছড়ার মতো করে কিছু কথা শুনতাম। কথা গুলো ছিলো, "জয় আবাহনী, জয় মোহামেডান; কেউ কারে ছাড়েনা সমান সমান।"
তখন আমার বিশ্ব ফুটবল সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলোনা। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা... কিংবা বার্সা, মাদ্রিদ... এসব কিছুই চিনতাম না। কিন্তু ছড়াটা শুনে বেশ কৌতুহল হয়। আব্বুর কাছে জানতে চাই, এটার অর্থ কি। আবাহনী মোহামেডানই বা কি। আব্বুর মুখে শুনে যা বুঝলাম, আবাহনী ও মোহামেডান হলো খুব শক্তিশালী দুইটি ফুটবল দল। আর এ দুদলের মধ্যে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
এরপরে একদিন একটা ম্যাচ দেখেছিলাম টিভিতে। সম্ভবত আমার জীবনে দেখা প্রথম ফুটবল ম্যাচ। একদলের পোশাক ছিল আকাশী-নীল, আপরটির সাদা-কালো। জানিনা কেন, আমি মনে মনে চাচ্ছিলাম সাদা-কালোরা জিতে যাক। অবশেষে চরম লড়াইয়ের পর শেষ দিকের একটি গোলে জিতে গেল সাদা-কালোরা। মোহামেডানের প্রতি ভালোবাসার শুরু বলা যায় সেখান থেকেই।
তারপরে বড় হয়েছি। মোহামেডান সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জেনেছি। বাংলাদেশের ফুটবলের বেহাল দশা দেখতে হয়েছে এবং হচ্ছে। আর সেখানে মোহামেডানের দশাটা আরো করুণ।
মোহামেডানের ইতিহাস আর বর্তমান অবস্থা টা মিলিয়ে দেখলে অবাক হতে হয়। যে মোহামেডান একসময় বাংলাদেশ, শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের ফুটবলে আধিপত্য বিস্তার করেছে, তারা আজ নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
মোহামেডানের ইতিহাস টা কিন্তু সত্যিকার অর্থেই গৌরবময়। ইতিহাস টা শুরু হয় ১৯২৭ সালে, ব্রিটিশ শাসনামলে। ঢাকার হাজারীবাগে এক নবাব পরিবার ছিল ফুটবল অনুরাগী। তাদের হাত ধরেই প্রথম গড়ে ওঠে মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাব। ১৯৩৬ সালে ক্লাবটির নাম পরিবর্তন করে মুসলিমদের ধর্মপ্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নামানুসারে ক্লাবের নাম রাখা হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব।
আস্তে আস্তে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যেতে থাকে ক্লাব। তখন পূর্ব বাংলায় ফুটবল ততটা ছড়িয়ে পড়েনি, অবকাঠামো বেশ দূর্বল। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয়। ঢাকার ফুটবল টা আরো বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এরপর কলকাতা মোহামেডান থেকে বিখ্যাত খেলোয়াড় শাহজাহান ঢাকায় এসে মোহামেডানের হাল ধরেন। তারপরও ক্লাবে তেমন কোনো সফলতা আসেনি।
তখন পূর্ব বাংলার ফুটবলে একক অধিপত্য বিস্তার করেছিলো ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। ১৯৫৬ সালে এ ক্লাব থেকেই কিছু খেলোয়াড় ও প্রতিনিধি এসে যোগ দেয় মোহামেডানে। এবার ফল টা একদম হাতে নাতে। সকলের প্রচেষ্টায় পরের বছরই প্রথমবারের মত ঢাকা লিগ জিতে নেয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। শুরু হয় ঢাকার ফুটবলে মোহামেডান রাজত্য।
এরপর পরপর ১৯৫৯, ১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৫ সালে ঢাকা লিগের শিরোপা ঘরে তোলে সাদা-কালো রা। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে তারা পাঁচবার জিতে নেয় স্বাধীনতা কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট।
শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও রাজত্ব শুরু হয় মোহামেডানের। ১৯৫৯ সালে তারা জয় করে আগা খান গোল্ড কাপ। এটিই ছিলো তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জয়। এরপর ১৯৬৪ ও ১৯৬৮, আরো দুইবার এ শিরোপা ঘরে তোলে মোহামেডান। ১৯৬৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৬ সালে হয় রানারআপ। ১৯৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত আশিস জব্বার শিল্ড টুর্নামেন্ট এ হয় চ্যাম্পিয়ন। ষাট, সত্তর, আশি - টানা তিন দশক ধরে চলতে থাকে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অধিপত্য। এসময় তারা জিতে নেয় ১১টি লিগ শিরোপা।
মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামালের হাত ধরে উত্থান ঘটে ঢাকা আবাহনীর। আর প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে আকর্ষণীয় রাইভালরি মোহামেডান বনাম আবাহনী। যার অন্যনাম ঢাকা ডার্বি। নতুন এ প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে ১৯৭৪ ও ১৯৭৭ সালে লিগ শিরোপা হারায় মোহামেডান। কিন্তু ১৯৭৫, ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮০ সালে লিগ জিতে নিজেদের অধিপত্য বজায় রাখে সাদা-কালো শিবির।
ঢাকা ডার্বি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায় নব্বইয়ের দশকে। সে সময় আবাহনীর পাঁচটি লিগ শিরোপার বিপরীতে মোহামেডান জিতে চারটি। পরের দশকে দুই দলই সমান তিনটি করে শিরোপা ঘরে তোলে। সর্বশেষ ২০০২ সালে রেকর্ড ১৯ বারের মতো লিগ জিতে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব।
এছাড়া ঘরোয়া ফেডারেশন কাপও মোহামেডান ১০ বার হাতে তুলেছে। তার মধ্যে ছয়বারই আবাহনী কে হারিয়ে। তাছাড়া প্রথম ফেডারেশন কাপও যৌথভাবে জিতে মোহামেডান। সর্বশেষ এ শিরোপা ঘরে এসেছে ২০০৯ সালে।
তাছাড়াও পতনের দ্বারপ্রান্তে থেকেও ২০০৯ ও ২০১৩ সালে তারা জিতে নেয় সুপার কাপ। ১৯৭২, ১৯৯১ ও ২০১৪ - তিনবার তারা হাতে তুলেছে ইনডিপেনডেন্স কাপ। ২০১৪ সালের ইনডিপেনডেন্স কাপ টি ছিল মোহামেডানের জেতা সর্বশেষ শিরোপা।
এদেশীয় ক্লাব গুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্লাব ছিল মোহামেডান। দেশের প্রথম ক্লাব হিসেবে ১৯৮৮ সালে এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগে দেশের প্রথম ক্লাব হিসেবে জায়গা করে নেয় তারা। বাংলাদেশের ক্লাবগুলোর মধ্যে এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগে রেকর্ড ছয়বার অংশগ্রহণ করেছে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব।
কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলের অধিপতি মোহামেডানের একসময় শুরু হয় পতন। ২০০২ সালে সর্বশেষ লিগ শিরোপা জয়ের পরেই এই পতনের সূচনা। ২০০৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত শিরোপাশূন্য মৌসুম কাটায় তারা। এরপর ২০০৮ ও ২০০৯ সালে পরপর দুটি ফেডারেশন কাপ জিতে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেয় মোহামেডান। কিন্তু সেটা ইঙ্গিতই থেকে যায়। লিগের নাম পালটে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত শিরোপার মুখ দেখেনি তারা। যেখানে নতুন নাম হওয়ার পর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর নামের পাশে যুক্ত হয়েছে ছয়টি লিগ শিরোপা, সেখানে মোহামেডানের নামের পাশে শুধুই শূন্যতা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলের যে দশা, বাংলাদেশে মোহামেডানেরও একই দশা। তবে লিভারপুল আন্তর্জাতিক সবচেয়ে বড় শিরোপা টা জিতেছে, মোহামেডান আন্তর্জাতিক কোনো সাফল্যও পায়নি।
এখন বাংলাদেশের লিগে যুক্ত হয়েছে আরো নতুন নতুন পাকাপোক্ত ক্লাব। আবাহনী ছাড়াও এখন আরো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইফ স্পোর্টিং, বসুন্ধরা কিংস, শেখ জামাল, শেখ রাসেল প্রভৃতি ক্লাব। এতসব ক্লাবের ভীড়ে মোহামেডান অনেকটা চোখের আড়ালেই চলে গেছে এবং যাচ্ছে। সবচেয়ে কষ্ট হয় তখন, যখন দেখি মোহামেডান কে অবনমন এড়াতে লড়তে হয়। মোহামেডানের মতো ক্লাবের জন্য এর চেয়ে যন্ত্রণার আর কি হতে পারে!
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এখন অবধি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মোহামেডানের মতো হয়ে উঠতে পারেনি আর কোনো ক্লাব। বাংলাদেশের ফুটবলের প্রতিনিধি যেন হয়ে উঠেছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। মোহামেডানের সেই কীর্তি শুধু শিরোপাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাঙ্গালী ফুটবল আবেগের সাথে মিশে আছে মোহামেডান। প্রার্থনা করি খুব দ্রুতই মোহামেডান তার আগের রূপ ফিরে পাবে, ফিরে পাবে তার সেই পুরোনো জৌলুশ।
- 0 মন্তব্য