• ফুটবল

দ্বৈরথ, নাকি তারচেয়েও বেশি কিছু?

পোস্টটি ২৮৮২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ব্রিটিশ ফুটবলে সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনাপূর্ণ রাইভালরি কোনটা? নাহ, সেটা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড লিভারপুলের নর্থ ওয়েস্ট ডার্বি না। নাতো সেটা মার্সিসাইড, ম্যানচেস্টার বা নর্থ লন্ডন ডার্বি। এমনকি সেটা ইপিএলের কোন রাইভালরি না। ভাবতে অবাক লাগলেও সত্য যে ব্রিটেনে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় স্কটিশ প্রিমিয়ার লিগে, সেটা ওল্ড ফার্ম, যার আরেক নাম গ্ল্যাসগো ডার্বি। ফুটবলের গন্ডি ছাড়িয়ে যে দ্বৈরথ সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি তে বিস্তৃত।

ইতিহাস টা শুরু ক্লাব দুটি সৃষ্টির পর পরই। ক্লাব দুটির জন্ম ব্রিটিশ ফুটবলের শুরুর দিকেই। আজ থেকে ১৪৭ বছর পূর্বে ১৮৭২ সালের ফেব্রুয়ারি তে জন্ম নেয় রেঞ্জার্স। আর সেল্টিকের জন্ম এর ১৫ বছর পর, ১৮৮৭ সালের নভেম্বরে। রেঞ্জার্সের জন্ম হয়েছিলো খাঁটি স্কটিশদের হাত ধরে, যারা ধর্মীয় দিক থেকে ছিলো প্রটিস্ট্যান্ট। অপরপক্ষে স্কটিশ ক্লাব হলেও সেল্টিক মূলত স্কটিশদের হাতে গড়ে ওঠেনি। এইটা সেই সময়ের কথা, যখন নর্দান আয়ারল্যান্ড কে ব্রিটিশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। দূর্দশাগ্রস্ত আয়ারল্যান্ড থেকে তখন জীবিকার সন্ধানে প্রচুর মানুষ আসতে শুরু করে গ্রেট ব্রিটেনে, স্কটল্যান্ডে। গ্রেট ব্রিটেন প্রটিস্ট্যান্ট অধ্যুষিত হলেও আয়ারল্যান্ড কিন্তু তেমন ছিলোনা। সেখানে সিংহভাগ লোক রোমান ক্যাথলিক। তাই আয়ারল্যান্ড থেকে যারা আসছিলো, তাদের অধিকাংশই ছিলো ক্যাথলিক। আইরিশরা যখন স্কটল্যান্ডে আসে, তখন তারাও জড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশ ফুটবলের সাথে। এবং মূলত তাদের হাত ধরেই জন্ম নেয় সেল্টিক।

বরাবরই ক্যাথলিক এবং আইরিশদের প্রতি কট্টর বিরোধী ছিলো রেঞ্জার্স। তারা ছিলো রক্ষণশীল স্কটিশ এবং ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। আর মূলত সমাজের উচ্চশ্রেণির লোকজন রেঞ্জার্স কে সমর্থন করতো। অপরপক্ষে সেল্টিক ছিলো উদারপন্থী, কিছুটা আইরিশ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ। এ ক্লাব টি হয়ে উঠেছিলো সমাজের শ্রমিক শ্রেণির ক্লাব।

দুই দলের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ হয় সেল্টিক সৃষ্টির পরের বছর, ১৮৮৮ তে। সে প্রীতি ম্যাচটিতে নব্য সেল্টিকের কাছে ৫-২ গোলে পরাজিত হয় রেঞ্জার্স। সেই হলো সূচনা। তারপর যত দিন গেছে উত্তেজনা ক্রমান্বয়ে বেড়েই গেছে।

received_2401915740127907

এ রাইভালরি ভয়াবহ আকার ধারণ করে ত্রিশের দশকে এসে। আইরিশ ক্যাথলিকদের সবদিক থেকে আলাদা করে দেয় প্রটিস্ট্যান্টরা। চাকরি বাকরি, কাজ কর্ম, শিক্ষা, চিকিৎসা সবকিছুতে তাদের থেকে সরিয়ে দেয় ক্যাথলিকদের।

একসময় রেঞ্জার্স একটা নিয়ম চালু করে। সেটি হলো, তারা কোনো ক্যাথলিক প্লেয়ার সাইন করাবেনা। কোনোভাবেই না। বিরাট একটা সময় এ নিয়ম ধরে রাখে তারা। তবে একসময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও মিডিয়ার চাপে পড়ে এই নিয়ম বন্ধ করতে বাধ্য হয় তারা। তবে এখনও অনেক সমর্থক ও দলের লোকজন সেই নিয়ম কে সমর্থন করে।

তবে সাধারণত কোনো ফ্যানবেজই মাঠে স্কটিশ পতাকা উড়ায়না। ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদী রেঞ্জার্স ফ্যান রা তাদের মাঠে উড়ায় ইউনিয়ন জ্যাক, যেখানে সেল্টিক ফ্যান রা প্রদর্শন করে আইরিশ ট্রাইকালার।

ফ্যানবেজের কথা তো না বললেই নয়। এমন শক্তিশালী প্রাণবন্ত ফ্যানবেজ পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। যখন দুইদল মাঠে নামে, পুরো স্টেডিয়াম কাঁপতে থাকে, সেটা ইবরক্সই হোক, আর সেল্টিক পার্কই হোক। এমন ফ্যানবেজই একটা দলকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। দেখলে মনেই হয়না এটা কোনো খেলার মাঠ, মনে হয় যেন রণক্ষেত্র, এখনই শুরু হয়ে যাবে বিধ্বংসী এক মহাযুদ্ধ।

আর যুদ্ধ তো হতোই। দুইদলের ফ্যানদের মধ্যে মারামারি ধস্তাধস্তি ছিলো স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে ১৯৮০ সালে, স্কটিশ কাপ ফাইনালে। ম্যাচটিতে ১-০ গোলে জয়লাভ করে সেল্টিক। এরপর উন্মত্ত রেঞ্জার্স ফ্যান রা শুরু করে ভাংচুর মারামারি। আহত হয় অসংখ্য।

এসব উন্মত্ততা শুধু ফ্যানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলোনা। এর সাথে জড়িয়ে পড়তো খেলোয়াড়েরা, অনেক সময় কোচরা পর্যন্ত। পল ল্যাম্বার্ট আর স্টিফেন ক্লসের মতো স্বনামধন্য কোচ এই ম্যাচে সাধারণ একটা পেনাল্টি কে কেন্দ্র করে মাঠের মধ্যে মারামারি করেছেন, গড়াগড়ি করেছেন মাটিতে।

received_406703513349182

প্রায় সবকটি স্কটিশ লিগই ভাগাভাগি হয়েছে এই দুই ক্লাবের মধ্যেই। দুই ক্লাব মিলে জিতেছে মোট ১০৪ টি লিগ টাইটেল, যার মধ্যে ৫৪ টি জিতেছে রেঞ্জার্স, বাকি ৫০ টি হাতে উঠেছে সেল্টিকের। দল দুইটি জিতেছে মোট ৭২ টি স্কটিশ কাপ ও ৪৫ টি লিগ কাপ। দুই দলের মধ্যে শিরোপা বিভাজন কিছুটা স্থবির হয়েছিলো আশির দশকে। তখন আবেরদিন ও ডান্ডি ইউনাইটেড চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় ধারাবাহিক চলে আসা দুই ঘোড়ার লড়াইয়ে। কিন্তু খুব বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারেনি সেই চ্যালেঞ্জ।

কিন্তু ফিনান্সিয়াল কারণে ২০১২ তে রেঞ্জার্স কে চতুর্থ বিভাগে নামিয়ে দেওয়া হয়। তবে চার মৌসুম পরেই আবারও টপ টায়ারে ফিরে আসে তারা। এইদিকে গত আট টা লিগ শিরোপা টানা জয়লাভ করে সেল্টিক।

মুখোমুখি লড়াইতেও দুই দলের পরিসংখ্যান প্রায় সমানে সমান। ৪১৮ বারের দেখায় রেঞ্জার্স জয় পেয়েছে ১৬১ ম্যাচ, ১৫৮ টি জিতেছে সেল্টিক। বাকি ৯৯ টি শেষ হয়েছে ড্র তে।

২০১৫ সালে সাবেক রেঞ্জার্স প্লেয়ার ব্রায়ান লড্রাপ বলেন, তার খেলা দ্বৈরথ গুলোর মধ্যে ওল্ড ফার্ম এর অবস্থান নিঃসন্দেহে সবচেয়ে শীর্ষে। উল্লেখ্য, তিনি ইতালিতে মিলান ডার্বি ও জুভেন্টাস-ফিওরেন্টিনা ম্যাচ খেলে এসেছেন। স্পেনে এল ক্লাসিকো ও নেদারল্যান্ডসে ডি ক্লাসিকার খেলে আসা সাবেক সেল্টিক স্ট্রাইকার হেনরিক লারসনও একই রকম মত প্রকাশ করেন।

এখনো সেল্টিক রেঞ্জার্স ম্যাচ মানেই যেন অন্য কিছু। ফ্যানদের কাছে নিজ দলের জয় ও প্রতিপক্ষের পরাজয়ের চেয়ে আনন্দের অনূভুতি আর কিছুতে নেই। তেমনি ভাবে প্রতি পক্ষের জয়ই হলো সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত। এমনিতেই তো আর বিশ্বের সেরা রাইভালরির অন্যতম হিসেবে স্থান করে নেয়নি।

একটা রাইভালরিই বটে!