• ফুটবল

শৈশবের কাছে লেখা বুফনের চিঠি

পোস্টটি ৩২৬১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

প্রিয়, ১৭ বছর বয়সী জিয়ানলুইজি!

৪১ বছর বয়সী এমন একজন মানুষ আজ রাতে তোমায় এই চিঠি লিখছে যিনি কিনা জীবনে অনেক অভিজ্ঞতার মাঝে দিয়ে বড় হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা হয়তো কিছু সুখের, কিছু কস্টের। এই চিঠি হয়তো আজ তোমায় কস্ট দিবে আবার কিছু সুখানুভূতি'ও দিবে; কিন্তু সত্যটা হলো আজ আমি তোমায় তোমারই গল্প শুনাবো! হ্যা, তোমারই গল্প! হয়তো বিশ্বাস হবে, হয়তোবা না; কিন্তু এ গল্প শুধুই তোমার!  

চলো একটা দুঃসংবাদ দিয়ে গল্পটা শুরু করি! তোমার তখন ১৭ বছর বয়স, তুমি সত্যিকারের একজন ফুটবলার হওয়ার পথে, ঠিক যেমনটা তোমার স্বপ্ন ছিলো। তুমি ভেবেছো, তুমি সব জানো? তুমি আসলে কিছুই জানোনা। কিছুদিনের মাঝেই তুমি সিরি আ'তে পারমা'র হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলার সুযোগ পেতে যাচ্ছো! তোমার অনেক ভয়ে থাকা উচিত, বিছানার এক কোনায় বসে গরম দুধ পান করা উচিত। কিন্তু তুমি কি করলে? তুমি তোমার বন্ধুর সাথে নাইটক্লাবে গেলে! আচ্ছা তোমার কি কেবল অল্পটুকু বিয়ার খাওয়া ঠিক ছিলোনা? কিন্তু তুমি কি করলে? তুমি নেশায় মাতলামি করা শুরু করলে! প্লীজ, যথেষ্ট হয়েছে! রাস্তায় বের হয়ে অন্তত পুলিশের সামনে পড়োনা; তোমার স্বপ্ন ধুলিশ্যাৎ হওয়ার জন্যে ঐটুকুই যথেষ্ট। প্লীজ এমনটি আর করোনা। এটি তোমাকে কেবলই ভুলের দিকে ধাবিত করবে, লাঞ্চিত করবে।

কিছুদিনের মাঝেই তুমি জীবনে তিনটি মুল্যবান উপহার পেতে যাচ্ছো; যা তোমায় দিবে উন্মাদনার সুখী পরশ, আবার পাশাপাশি তা অনেক ভয়ানক’ও বটে!

"অর্থের প্রাচুর্য, যশ খ্যাতি এবং তোমার স্বপ্নের পেশা!"

এখন তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো যে এখানে ভয়ংকর কিছুর সম্ভাবনা কই? হ্যা, প্যারাডক্সটা ঠিক এখানেই!

এটি সত্য যে একজন কিপারের অনেক আত্মবিশ্বাসী হতে হয়ে, তাকে ভয়ডরহীন হতে হয়। একজন কোচ'কে যদি দুজনের একজন কে বেছে নিতে বলা হয়, যাদের একজন সর্বোচ্চ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন গোলকিপার আর অন্যজন ভয়ডরহীন গোলকিপার, তবে এই কথা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় যে কোচ প্রতি মুহুর্তে ঐ ভয়ডরহীন গোলকিপারটাকেই বেছে নিবে। আবার এটিও সত্য যে, যেই ব্যাক্তি ভয়ডরহীন সে মাঝে মাঝেই নিজ স্বত্তাকেও ভুলতে বসে। তুমি যদি সবকিছু ভুলে কেবলই ফুটবল নিয়ে বাঁচা শুরু করো তবে একটা সময় তোমার সত্তা নির্জীব হয়ে যাবে, প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলবে। যা তোমাকে ধীরে ধীরে হতাশাগ্রস্ত করে তুলবে।

তুমি এসব শুনে হাসতে পারো, কিন্তু তোমার সাথে ঠিক এমনটাই ঘটবে; এমনটা ঘটবে যখন তুমি তোমার ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ এক সময় পাড় করছো। তখন তোমার ২৬ বছর বয়স, ইতালি এবং জুভেন্টাসের গোলবারের দায়িত্ব তোমার কাঁধে, তোমার এখন অনেক টাকা একই সাথে সম্মান। মানুষ তোমায় "সুপারম্যান" ডাকা শুরু করেছে। কিন্তু সত্যটা হলো তুমি কোন সুপারহিরো নয়, তুমি আর সবার মতই রক্তে মাংসে গড়া একজন সাধারণ মানুষ।

সবচেয়ে কঠিন সত্যটা হলো, তোমার প্রফেশনে মানুষের এই প্রত্যাশার চাপ তোমায় রোবট বানিয়ে দিবে। অনেকটা জেলখানার মতো চলবে তোমার জীবনযাপন। ট্রেনিংয়ে যাও, বাসায় ফিরে টিভি দেখো, ঘুমাও। পরেরদিন ঘুম থেকে জেগে আবারও ট্রেনিংয়ে যাও, বাসায় ফিরে টিভি দেখো, ঘুমাও। তুমি জিতো, কিংবা হারো, তোমার প্রাত্যহিক রুটিন ঠিক এভাবেই আবর্তিত হতে থাকবে।

আপাতত, গল্পে একটু বিরতি দেই; কি বলো? কেনোনা, আমি জানি ১৭ বছর বয়সী তুমি এই গল্প পড়ে ঠিক কি চিন্তা করছো!

তুমি ভাবছো, "এটি কিভাবে সম্ভব? আমি একজন সুখী মানুষ। আমি জন্মগত ভাবেই একজন নেতৃত্বগুণাবলী সম্পন্ন মানুষ। আমি যদি জুভেন্টাসের গোলকিপার হই, তবে আমার অনেক অনেক টাকা থাকবে, আমি অবশ্যই সুখী হবো। হতাশাগ্রস্ত হওয়ার কোন সুযোগই তো নেই।" আচ্ছা, তবে তোমায় একটা প্রশ্ন করি। জিজি, ঠিক কি কারণে তুমি নিজের জীবন ফুটবলের প্রতি বিলিয়ে দিলে? তোমার মনে আছে কি? প্লীজ, এটি বলিওনা যে, তা কেবলই একজন ক্যামেরুনীয় থমাস এনকুনো'র কারণে। এর উত্তরে তোমাকে আরো গভীরে ভাবতে হবে, তোমার শৈশবের সবটুকু স্মরণ করতে হবে!

তোমার তখন ১২ বছর বয়স, ঠিক?
ইতালিতে তখন '৯০ বিশ্বকাপ চলছিলো, ঠিক?
মনে পড়ে, সানসিরো তে আর্জেন্টিনা বনাম ক্যামেরুনের ম্যাচ চলছিলো?
কিন্তু ঐ ম্যাচ চলাকালীন তুমি কি করছিলে?
চোখ'দুটো বন্ধ করো! তুমি ছিলে তোমার শোবার ঘরে, একদম একা! সবসময়ের মতো তোমার বন্ধুরা সেদিন তোমার সাথে নেই কেনো? তুমি হয়তো স্মরণ করতে পারছোনা। তোমার দাদী ছিলো রান্নাঘরে, দুপুরের খাবার তৈরি করছিলো, দিনটা এতই উত্তপ্ত ছিলো যে তোমার দাদী দরজা জানালাগুলো বন্ধ করে রেখেছিলো, রোদ থেকে বাঁচতে। তোমার ঘর পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিলো, কেবল টেলিভিশনের হলুদাভ আলো ছাড়া! হঠাৎ করেই একটা নাম তোমার অদ্ভুতুড়ে লাগলো! "ক্যা মে রু ন"! তোমার কোন ধারণাই নেই, এই ক্যামেরুন কোথায়; এই নামে কিছুর অস্তিত্ব আছে তুমি আগে তা জানতেও না। তবে তুমি আর্জেন্টিনা আর ম্যারাডোনা কে জানতে। কিন্তু ক্যামেরুন দল'টায় তুমি জাদুকরী কিছু উপলব্ধি করলে, সাথে লক্ষ্য করলে এই তীব্র রোদের মাঝেও ক্যামেরুনের গোলকিপার ফুলহাতা জার্সি পরিহিত অবস্থা গোলবারের নিচে দাঁড়িয়ে, সাথে লম্বা কালো প্যান্ট, জার্সিটা ছিলো সবুজ আর গোলাপির মিশেল। তার দাঁড়িয়ে থাকা, তার মুভমেন্ট, তার সুন্দর গোঁফ তোমার হৃদয় ছুঁয়ে গেলো! কিভাবে যেনো এক জাদুকরী মায়ায় মানুষ'টা তোমার মনে গেঁথে গেলো, যা তুমি বর্ননা করতে পারবেনা!

সে ছিলো তোমার দেখে সবচেয়ে স্মার্ট, ঠান্ডা মাথার একজন মানুষ, যে সহজেই তোমার মনে জায়গা করে নিলো! ধারাভাষ্যকারের মুখে তার নাম জানলে, থমাস এনকুনো।

খেলার মাঝখানে আর্জেন্টিনা একটি কর্নার পেলো, থমাস নিজের জায়গা থেকে দৌড়ে গিয়ে এক লাফ দিয়ে বল'টাকে ঘুষি দিয়ে ৩০ গজ বাতাসে ভাসিয়ে দিলেন! কি যেনো এক জাদু ছিলো, ঐ মুহুর্তটাতে; আমি সেদিনই জেনে গেলাম আমার লক্ষ্য কি, আমি আমার জীবনটাকে ঠিক কোথায় নিয়ে যেতে চাই, আমি আমাকে কোথায় দেখতে চাই!

তুমি সাধারণ কোন গোলকিপার হতে চাওনি, তুমি চেয়েছিলে ঠিক এমন গোলকিপার হতে, যে কিনা অকর্ষিত, যে কিনা ঝঞ্জার মতো, যে নির্ভীক, যে মুক্তহস্তের মতো উদ্ধত!

ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চললো, ম্যাচ দেখতে দেখতেই তুমি তোমার গন্তব্য লিখে ফেললে। ম্যাচের ৬৭ তম মিনিটে ক্যামেরুন গোল দেয়, তুমি যেনো ক্যামেরুনের হয়ে স্নায়ুচাপে ভুগতে লাগলে, তুমি উত্তেজনায় স্থির থাকতে পারছিলেনা, ম্যাচের শেষ ভাগ টিভির ভলিউম কমিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলে! ক্যামেরুন জিতে গেলো! পাশের বাসার বাচ্চাগুলোও দৌড়ে বের হয়ে চিৎকার করছিলো - "ক্যামেরুন কে দেখলে তোমরা? ক্যামেরুন কে দেখলে?"!

সেদিন তোমার মাঝে একটা অগ্নিমূর্তির জন্ম হয়, যেই হৃদয়ে স্থান নেয় ক্যামেরুন, হৃদয়ে স্থান একজন থমাস এনকুনো! হৃদয়ে স্বপ্ন বুনে গেলো, একদিন সকলের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে হবে, পুরো পৃথিবীকে একজন বুফনের অস্তিত্ব জানাতে হবে!

তুমি ঠিক এই কারণে ফুটবলার হয়েছিলে; টাকার জন্যে নয়, খ্যাতি'র জন্যে নয়! তুমি ফুটবলার হতে চেয়েছিলে একজন থমাসের শৈল্পিক কারুকার্যে মুগ্ধ হয়ে, একজন থমাস এনকুনো'তে মুগ্ধ হয়ে! তোমাকে এটি স্মরণ রাখতে হবে, টাকা কিংবা যশ খ্যাতি তোমার অভিপ্রায় ছিলোনা!

জিজি, তুমি যদি তোমার সত্তার যত্ন না নিতে পারো, যদি ফুটবলের বাহিরে কোনকিছুতে অনুপ্রেরণা না খুঁজে পাও তবে তুমি ধ্বসে পড়বে। যদি আমার কাছে একটা উপদেশ চাও, তবে বলে রাখি পৃথিবীটাকে নিয়ে ভাবো, তোমার চারপাশ নিয়ে ভাবো, তা তোমার কিংবা তোমার পরিবারের জন্যেই মঙ্গল। গোলকিপার হতে হলে তোমাকে সাহসী হতে হবে, এটাই সত্য। কিন্তু সাহসী হওয়া মানেই জ্ঞানহীন হওয়া নয়, জিজি।

তোমার গভীর হতাশাগ্রস্থ জীবনে হুট করে কিছু আশ্চর্যজনক এবং সুন্দর ব্যাপার ঘটে গেলো! এক সকালে তুমি ক্লাবের নিয়ম ভেঙে তুরিনের অন্যে এক রেস্টুরেন্টে নাস্তা করার সিদ্ধান্ত নিলে, তুমি হাঁটছিলে একটা জাদুঘরের পাশ দিয়ে, যেখানে দেয়ালে একটি পেইন্টিং দেখতে পেলে, যেখানে লেখা ছিলো ছাগাল্ল (ছাগাল, ফ্রেঞ্চ আর্টিস্ট)!  তুমি এই নামটি আগে শুনেছো কিন্তু ঐ আর্টওয়ার্ক সম্পর্কে তোমার কোন ধারণাই ছিলোনা।

তুমি বুফন! কিন্তু বুফন কে? তুমি আসলেই কে? তুমি কি আদৌ তা জানো?

প্রিয় জিজি, এই চিঠির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটি! সেদিন তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা! যদি তুমি ঐ জাদুঘরে না প্রবেশ করো, তুমি যদি পৃথিবীটাকে না জেনে কেবল একজন ফুটবলার হয়েই বাঁচতে চাও, তবে তোমার সব অনুভূতিকে কারাবন্দী করে ফেলবে আর তোমার সত্তাকে ধ্বংস করে ফেলবে।

কিন্তু তুমি যদি ভিতরে প্রবেশ করো, তবে তুমি ছাগালের একশ'র উপরে পেইন্টিং দেখতে পাবে, যেগুলো তোমার হৃদয় কে আলোড়িত করবে। কিছু পেইন্টিং হয়তো ভালো, কিছু চমকপ্রদ। কিন্তু একটা পেইন্টিং রয়েছে, যেইটা তোমার হৃদয়কে আঘাত করবে বজ্রপাতের মতো।

এই পেইন্টিংটির নাম হলো The Walk!

দেখতে খুবই সরল প্রকৃতির অংকনচিত্র! একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে, একটি পার্কে অবস্থানরত, কিন্তু মেয়েটি আকাশে উড়ছে, ঠিক যেনো পরীর মতো, আর ছেলেটি মাটিতে দাড়িয়ে, শক্ত করে মেয়েটির হাত ধরে আছে, আর হাসছে! ঠিক যেনো স্বপ্নের মতোন!

এই ছবিটা যেনো অন্য এক পৃথিবী থেকে কিছু সুখের পরশ নিয়ে আসার মতো! এটি তোমায় দিবে শৈশবের স্বপ্নলোকের অনুভূতি! এটি তোমায় জানান দিবে অনাড়ম্বরতার বা সাধাসিধে জীবনের সুখ! এটি তোমায় স্মরণ করিয়ে দিবে থমাস এনকুনো'র সেই মুষ্ট্যাঘাতে গোল ঠেকিয়ে দেওয়ার অনুভূতি! এটি তোমায় মনে করিয়ে দিবে টেলিভিশনের পিছনে বসে ক্যামেরুনের জন্যে প্রার্থনারত থাকার শৈশবের সেই আঁকুতি! সত্যিই, বয়স বাড়ার সাথে সাথে যেনো আমরা আমাদের শৈশবের স্মৃতিগুলো ভুলতে থাকি!

তোমাকে পরের দিন আবারো ঐ জাদুঘরে যেতে হবে, যাওয়াটা খুবই জরুরি! টিকেট বুথে থাকা মহিলাটি হেসে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি না গতকালই এসেছিলে! ভেবোনা। ভিতরে প্রবেশ করো। কেবলমাত্র ঐ চিত্রের নিপুণতাই তোমার সকল হতাশা দূর করতে পারে, যা তোমার হৃদয়কে প্রসারিত করতে পারে! ঠিক যেনো ছাগালের ঐ মেয়েটার মতো, যে কিনা মন খুলে ডানা মেলে আকাশে উড়ছে, যার কোন দুঃখ নেই, কোন হতাশা নেই!

তোমার জীবনে তুমি বর্ণনাতীত এবং অভাবনীয় সুন্দর মুহুর্তের সাক্ষী হবে, যখন তোমার মনে হবে তুমি জন্মই নিয়েছো বুঝি এই মুহূর্তটার জন্যে; এই পেইন্টিং তোমার মাঝে যে সুখানুভূতি জুগিয়েছে তা যেনো সেই মুহুর্তগুলোর একটি!

তোমার মনে আছে, তুমি যখন পারমা'র তরুণ তুর্কী ছিলে, তোমাকে কিছু করতে হতো যা সবাইকে তোমার নাম জানান দিবে। কোন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে তুমি ভাবতে ম্যাচে এমন কিছু করতে যাতে করে নিজেকে নতুন করে চেনানো যায়, দলের বাকী সবাইকে বুঝাতে পারে তুমি একজন নেতা, তুমি একজন নির্ভীক সৈনিক, তোমার গল্পে তুমি অনেক বড় একজন চরিত্র! 

কিন্তু তুমি তোমার জার্সিতে এমনকিছু লিখে ফেললে যা তোমার উচিত ছিলোনা। স্কুলের বেঞ্চে দেখা সেই লেখাটা ছিলো "Death to Cowards.” তুমি ভেবেছিলে এটি মোটিভেশনাল কোন বাণী হবে। কিন্তু এটি ছিলো ফ্যাসিবাদের স্লোগান! এটি এমন একটি ভুল ছিলো যা তোমার পরিবারকে অনেক ভুগিয়েছিলো। তবে এই ভুল গুলোই গুরুত্বপূর্ণ, কেনোনা ভুলগুলো তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিবে যে তুমিও মানুষ! ভুলগুলো তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিবে তোমার সীমাবদ্ধতা, বারেবারে।

ফুটবল এমন একটি খেলা যেটি তোমার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিবে যে তুমি সবার চেয়ে আলাদা, অসাধারণ।  কিন্তু বাস্তবে তোমার সাথে একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান কিংবা মদের দোকানদারের কোন পার্থক্য নেই! সবার মতো তুমিও কেবলই মানুষ। কখনো ভেবোনা তুমি অসাধারণ, ভাবো তুমি আর আট দশজনের মতই সাধারণ! তাহলেই তুমি হতাশা থেকে দূরে থাকতে পারবে। নিজেকে রোবোট মনে হবেনা! মাত্র ১৭ বছর বয়সে তুমি এটি বুঝতে পারবেনা, কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি একদিন তুমি বুঝবে! আজ আমি তোমায় এসব বলতে পারছি, সাহস নিয়েই বলছি। আসলে দুর্বলতার কথা অন্যকে জানানো কোন লজ্জাজনক ব্যাপার নয়, বরং সাহসীকতার! জীবনের এই ব্যাপারগুলো অনেক জটিল।

তুমি এখনও ছোট, সাধাসিধে। আমার একটাই অনুতাপের বিষয়, তুমি তোমার চিন্তাচেতনাকে বয়সের সাথে ডানা মেলাতে পারোনি। ৪১ বছর বয়সেও তোমার ভিতরটাকে এই ভাবনাটাই পোড়াবে, ক্ষতবিক্ষত করবে। একজন ফুটবলারের পরম পাওয়া বিশ্বকাপ ট্রফিটাকে বাহুডোরে রেখেও তুমি পরিতুষ্ট হতে পারবেনা, তুমি সত্যিকারের সুখানুভব পাবেনা। জীবনের কোথায় যেনো তুমি কিছু একটার অভাববোধ করবে!

তোমার মনে আছে, উদিনে তোমার চাচার বাসায় শীতকালীন ছুটি কাটাতে যাওয়ার কথা? হয়তো না। তখন তুমি মাত্র ৪ বছর বয়সী। বাহিরে তুষার পড়ছিলো। ঘুম থেকে জেগে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়েই তোমার মনে হয়েছিলো তুমি যেনো স্বপ্ন দেখছো! পুরো দেশটা যেনো স্বপ্নপুরীর মতো সাদা হয়ে গেছে। তুমি দৌড়ে বাহিরে গেলে! তোমার কোন ধারণাই নেই, তুষারপাত কি! কিন্তু তুমি কি করেছিলে? চমকে গিয়েছিলে? ভয় পেয়েছিলে? না! তুমি দৌড়ে গিয়ে বরফে ঝাপ দিয়েছিলে! লাফিয়েছিলে! ভয়ডরহীন ভাবে। অথচ তোমার দাদী ভয় পাচ্ছিলো, আর চিৎকার করছিলো-  "জিয়ানলুইজি, জিয়ানলুইজি! না! না! না!" আর তুমি দাঁত কেলিয়ে হাসছিলে! পরে তোমার জ্বর এসেছিলো, ১ সপ্তাহ মারাত্মক জ্বরে ভুগেছিলে! দাদী বকছিলো! এরপরেও তুমি কখনো তুষারে ঝাপ দিতে ভয় পাওনি, একটুও দ্বিধায় ভুগোনি। এইটাই আসল তুমি! তুমি বুফন! তোমাকে পৃথিবীকে পৃথিবীর মানুষকে বুফনের অস্তিত্ব জানান দিতে হবে!

- জিয়ানলুইজি বুফন!

ফুটনোট: লেখাটি  ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে "লেটার টু মাই ইয়ঙ্গার মাইসেলফ" নামে ইংরেজি ভাষায় পাবলিশ করা আর্টিকেল হতে অনুদিত!