• ফুটবল

আ জেন্টলম্যান অব ফুটবল

পোস্টটি ৩২২৬ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১৯৭৫ সালের ২রা মে। লন্ডনের লেটোনস্টোনের ডেভিড এডওয়ার্ড অ্যালান "টেড" বেকহাম ও স্যান্ড্রা জর্জিনার ঘরে জন্ম নেয় এক সন্তান। অসাধারণ সুন্দর ও মায়াবী ছেলেটির মুখাবয়ব। বাবা খুশি হয়ে সন্তানের নাম রাখেন দাদার নামে, ডেভিড রবার্ট জোসেফ বেকহাম, ডাক নাম ডেভ।

সুন্দরই বটে। বিশ্বের ইতিহাসে সন্দেহাতীত ভাবে সবচেয়ে সুন্দরতম খেলোয়াড়। বিশ্বের সুন্দরতম পুরুষের অন্যতম তিনি। সে যাই হোক, বেকহামের সৌন্দর্য নিয়ে আজ কিছু বলতে আসিনি।

খুব সচ্ছল পরিবার ছিলোনা তাদের। টেড ছিলেন একজন কিচেন ফিটার। আর তার স্ত্রী করতেন হেয়ার ড্রেসিং এর কাজ।

ডেভের ছিলো দুই বোন। বড় ও ছোট বোনের মাঝে বেড়ে উঠছিলেন তিনি।

পরিবারের সবাই ছিলেন ফুটবলের প্রতি আগ্রহী। একদম খাঁটি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সমর্থক এক পরিবার। সেই সূত্রে, তিনিও ফুটবল ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের প্রতি ভালোবাসার বুকে ধারণ করেই বেড়ে উঠতে থাকেন।

বাল্যকালে চেজ লেন প্রাইমারি স্কুল ও চিংফোর্ড কাউন্টি হাই স্কুলে পড়াশুনা করেন। সেই সময়টাতেই চিংফোর্ডের রিজওয়ে পার্কে নিয়মিত ফুটবল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি খেলাধুলা করতেন।

ছোটবেলা থেকেই তার তীব্র ইচ্ছা ছিলো ফুটবলার হওয়ার। একবার এক সাক্ষাৎকারে বেকহাম বলেন, "স্কুলে যখনই শিক্ষকেরা জিজ্ঞেস করতো, 'বড় হয়ে কি করতে চাও?' আমি বলতাম, 'আমি ফুটবলার হতে চাই' তখন তারা বলতেন, 'না, চাকরির জন্য তুমি কি করতে চাও?' কিন্তু এটাই একমাত্র কাজ যেটা আমি করতে চেয়েছিলাম।"

অল্প বয়সেই তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন। ফুটবল ভালোবাসতেন তীব্র ভাবে। এই ভালোবাসা থেকেই ভর্তি হন স্যার ববি চার্লটনের এক ফুটবল স্কুলে। সেখানেই সুযোগ মেলে বার্সেলোনার একটি ট্রেইনিং সেশনে অংশগ্রহণ করার। কিন্তু বার্সা তাকে চিনতে ব্যর্থ হয়। সেই সময় তিনি খেলতেন স্থানীয় একটা দল রিজওয়ে রোভার্সের হয়ে, যেখানকার অন্যতম কোচ ছিলেন তার বাবা।

এরপর স্থানীয় ক্লাব লেটন অরিয়েন্ট, নরউইচ সিটির হয়ে ট্রায়াল দেওয়ার পর যোগদান করেন টটেনহ্যাম হটসপারে। বালক বেকহ্যাম স্পার্সদের হয়েই প্রথম কোনো বড় কোনো ম্যাচ খেলেন।

১৯৯০ সালে অনূর্ধ্ব-১৫ প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন। এতেই তার ওপর নজর পড়ে তার স্বপ্নের ও ভালোবাসার ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের। ১৯৯১ সালে রেড ডেভিলদের ইয়ুথ একাডেমি তে যোগদান করেন ডেভ।

তখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের উজ্জ্বল সময় শুরু হয়েছে। তাদের দায়িত্বে তখন কিংবদন্তি কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। তার আন্ডারে মাঠ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন রায়ান গিগস-পল স্কোলস রা। তাই ১৯৯৩ সালে প্রফেশনাল প্লেয়ার হিসেবে সাইন করলেও একাদশে সুযোগ পাওয়াটা তার জন্য সহজ ছিলোনা। তাই ইউনাইটেড তাকে একবছরের জন্য লোনে পাঠায় প্রেস্টন নর্থ এন্ডে।

ওল্ড ট্রাফোর্ডে আবার ফিরে আসেন ১৯৯৫ সালে৷ কিন্তু এবারও তার একাদশে যায়গা হতোই না বলা চলে। পুরো মৌসুমে সুযোগ পান মাত্র চার ম্যাচে। ইউনাইটেডের ভাগ্যও সেবার ছিলো একদমই প্রতিকূলে। ৬ মৌসুম পর সেবার কোনো ট্রফি জিততে পারেনি তারা৷ এতে কোচ বুঝতে পারেন, কিছু পরিবর্তন দরকার। তাই দলের তরুণ দের নজরে আনেন তিনি। প্রাধান্য দিতে থাকেন তাদের। এটাই দারুণ একটা সুযোগ হয়ে আসে ডেভিড বেকহামের জন্য।

image_search_1572173209961

বেকহাম ম্যাজিকের শুরুটা সেখানেই বলা যায়। তার অসাধারণ পারফর্মেন্সে ভর করেই ঘুরে দাঁড়ায় ইউনাইটেড, জিতে নেয় লীগ শিরোপা। তার পারফর্মেন্স নজর কেড়ে নেয় সবার। সেই সূত্রে ডাক পেয়ে যান জাতীয় দলে।

ইউনাইটেডের আরেক কিংবদন্তি এরিক ক্যান্টোনা বিদায় নেন ১৯৯৭ সালে। তার রেখে যাওয়া জনপ্রিয় ৭ নাম্বার জার্সিটা গায়ে চড়ান ডেভ। এরপর এই জার্সিতেই নিজেই হয়ে ওঠেন আরেক কিংবদন্তি।

সব সাফল্য যেন নিজেই এসে ধরা দিতে শুরু করলো বেকহামের কাছে। ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে জিতে নিলেন ট্রেবল। নিজের সাফল্যে নিজেই মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়ে যেতেন।

২০০০-০১ মৌসুমে টানা তৃতীয়বারের মতো লীগ জেতে ইউনাইটেড। যেমন ঘটনা এর আগে ঘটেছিলো মাত্র তিনবার।

স্বপ্নের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়েন ২০০৩ এ। রিয়াল মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট পেরেজের নজরে পড়ে যান ডেভ। যেকোনো মূল্যে তাকে দলে ভেড়ানোর প্রত্যয় করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ৩৫ মিলিয়ন ট্রান্সফার ফির বিনিময়ে তাকে নিয়ে আসেন সান্টিয়াগো বার্নাব্যু তে।

image_search_1572173285723

রিয়ালে এসে শুরুতেই জিতে নেন স্প্যানিশ সুপারকাপ। তার আগমনে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে লস গ্যালাক্টিকোস রা। জিদান, রোনালদো, রাউল, ফিগো, ক্যাসিয়াস, কার্লোস আগে থেকেই ছিলো, সাথে যুক্ত হন বেকহাম। স্বপ্নের মতোই একটা দল ছিলো সেটা।

রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে জেতেন একটা লীগ শিরোপা। কিন্তু সেখানে খুব ভালো সময় কাটেনি তার। শেষ পর্যন্ত ২০০৭ এ রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়েন ডেভিড বেকহাম।

এরপর ইউরোপ ছেড়ে পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে। এল এ গ্যালাক্সির হয়ে খেলেন মেজর লিগ সকারে। কিন্তু সেখানেও থিতু হতে পারেন নি ডেভ। ২০০৮ এ লোনে আসেন মিলানে। সেখান থেকে আবার ২০০৯ এ ফেরেন গ্যালাক্সি তে। কিন্তু কয়েকটা ম্যাচ মাত্র খেলেন তাদের হয়ে। সে বছরই আবারও ফিরে আসেন মিলানে। পরের বছর আবারও ফিরে যান গ্যালাক্সি তে। অবশেষে তার এ চক্রটা থামে। এবার ২০১২ পর্যন্ত লস এঞ্জেলেসে কাটান ডেভ। এর মধ্যে ২০১০ এ জেতেন সাপোর্টারস শিল্ড। ২০১১ আবারও এই ট্রফি জেতেন, এইবার সাথে যোগ হয় এমএলএস কাপও। ২০১২ তে আবারও এমএলএস কাপ হাতে ওঠে তার।

image_search_1572173341069

সবশেষে শেষ বয়সে ২০১২ তে আসেন ফ্রান্সে। পিএসজির জার্সি গায়ে জড়ান ডেভ। প্যারিসিয়ানদের হয়ে ২০১৩ তে হাতে তোলেন লিগ ওয়ান শিরোপা। অবশেষে সে বছরই প্যারিসে বিদায় জানান ফুটবল কে।

image_search_1572173382529

দীর্ঘ ২০ বছরের ক্লাব ক্যারিয়ারে ম্যাচ খেলেছেন ৫৯৭ টি, গোল করেছেন মোট ৯৭ টি। প্রথম ব্রিটিশ ফুটবলার হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগে ১০০টি ম্যাচ খেলার গৌরব অর্জন করেন ডেভ। প্রথম ইংলিশ খেলোয়াড় হিসেবে চারটি দেশে লিগ শিরোপা জয়ের গৌরবও অর্জন করেন।

জীবনে অসংখ্য ইনডিভিজুয়াল ট্রফিও লাভ করেছেন। ১৯৯৯ সালে ব্যালন ডি অরও প্রায় হাতে চলে এসেছিলো, শেষ পর্যন্ত একটুর জন্য ছোঁয়া হয়নি সেটা। হন রানারআপ। ১৯৯৯ ও ২০০১, দুইবার ফিফা প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ার এর রানারআপ হিসেবে সিলভার অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেন।

এবার আসি জাতীয় দলে। ইংল্যান্ড দলের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছেন, প্রতিনিধিত্ব করেছেন ১১৫ টি ম্যাচে। ২০০০ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত লম্বা একটা সময় অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। মোট ৫৮ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেন তিনি। অবশেষে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে দলের বাজে পারফর্মেন্সে হতাশ হয়ে পড়েন এবং অধিনায়কের আর্মব্যান্ড ত্যাগ করেন চিরতরে।

image_search_1572174136614

তিনি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পান তার জাদুকরী ফ্রি কিকের জন্য। তার বাঁকানো শটের অসাধারণ সব ফ্রি কিক গুলো তাকে অমর করে রেখেছে।

শুধু ফুটবল নয়, তার এর বাইরের কার্যক্রম গুলোও প্রশংসার দাবিদার। প্রায় দশ বছর কাজ করেছেন ইউনিসেফের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে।

ফ্যাশন জগতেও বেকহাম ছিলেন একজন রোল মডেল। অনেক বড় বড় ব্র‍্যান্ডের দারুণ সব বিজ্ঞাপন দিয়ে ফ্যাশন জগতেও তিনি ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। সারা শরীরে দারুণ সব ট্যাটু দিয়ে মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ডেভ। বিভিন্ন সময় তার বিভিন্ন হেয়ারস্টাইল ছিলো আলোচিত। ২০১৫ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পিপল ম্যাগাজিনের বিশ্বের সবচেয়ে যৌনাবেদনময় পুরুষ।

image_search_1572173423685

মানুষ হিসেবেও বেকহাম অতুলনীয়। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম শান্ত শিষ্ট ভদ্র খেলোয়াড় তিনি৷ যেকোনো মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারতেন। তিনি কারো সাথে কোনো বিবাদে জড়িয়েছেন, এমন কোনো ইতিহাস নেই বললেই চলে।

১৯৯৯ সালে বিখ্যাত পপ গ্রুপ "স্পাইস গার্লস" এর "পোশ স্পাইস" নামে পরিচিত ভিক্টোরিয়া অ্যাডাম কে বিয়ে করেন ডেভ। চার সন্তান নিয়ে এখন অবধি সুখে ঘর করছে এ দম্পতি।

সর্বপরি, শুধু একজন খেলোয়াড় নয়, একজন পরিপূর্ণ মানুষ ডেভিড বেকহাম। বিশ্ব ফুটবল ও ফ্যাশন দুনিয়ায় তার মুখরিত পদচারণা ভোলা যাবেনা কখনো। হাজারো ভক্ত সমর্থকদের কাছে এখনো বেকহাম এক উন্মাদনার নাম, যা অমলিন রয়ে যাবে চিরকাল।