• অন্যান্য

তবে তোমায় নিয়েই গল্প হোক…

পোস্টটি ৩৯২১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

গল্পটা শুরু করতে চাই সাহিত্যে নোবেল জয়ী আইরিশ নাট্যকার ও সাহিত্যিক জর্জ বার্নার্ড শ'কে নিয়ে। ডাব্লিনের এই ভদ্রলোক প্রারম্ভিক জীবনে কাজ করতেন সরকারি এক অফিসের সামান্য কেরানি হিসেবে। দীর্ঘদিন কলমের কারিগরি করতে করতে যখন জীবনটা নিঃসাড়, প্রাণহীন ও একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছিলো; বার্নার্ড সাহেব ভাবলেন- হায়, তবে কি এভাবেই কেটে যাবে আমার পুরোটা জীবন! ছেড়ে দিলেন কেরানির কাজ। ভাবলেন ভিন্ন কিছু শুরু করা যাক তবে৷ যেই ভাবা সেই কাজ; ঢুকে পড়লেন সাহিত্যের জগতে। সাহিত্য লিখে বই বিক্রি করে পরবর্তী ৯ বছরে তিনি যে পরিমান টাকা আয় করেছিলেন, তা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছিনা। বার্নার্ড সাহেবের আয় হয়েছিলো বাংলাদেশী টাকায় মাত্র ৩০০ টাকা!

তবে তিনি ক্ষান্ত দেননি। চালিয়ে গেছেন সাহিত্যচর্চা। ফলস্বরূপ মৃত্যুপূর্বে রেখে গেছেন মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি। উঁহ, প্রিয় পাঠক শ্রোতা; আমি এখানে জর্জ বার্নার্ড শ' সাহেবের জীবনবৃত্তান্ত লিখতে বসিনি। লিখতে বসেছি অন্য এক মুখরোচক গল্প; যার কাজ সাহিত্যে লিখা নয়; বরং ফুটবল ধারাভাষ্য দেয়া! তবে বার্নার্ড সাহেবের সাথে এই ভদ্রলোকের জীবনের গল্পে মিল আছে বলে-ই উপরের কাহিনির অবতারণা করা।

ইংল্যান্ডের সেন্ট জোনস স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও 'ইউনিভার্সিটি অব হাল' থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি গ্রহণ করে ভদ্রলোক চাকরি জীবন শুরু করলেন একাউন্টেন্ট হিসেবে। তবে জীবনের সঠিক হিসাব খুঁজে পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরোও কয়েক বসন্ত! যখন সে কাঙ্ক্ষিত বসন্ত এলো- তিনি মনে মনে ভাবলেন, 'এও কি সম্ভব! আমি তো এই লাইনের মানুষ-ই না! সুযোগ যখন এসেছে, তা গ্রহণ করাই শ্রেয় হবে।' অত:পর, তিনি লেগে পড়লেন এই কাজে। এটাইকেই পেশা হিসেবে নিলেন। সাফল্য পেতে থাকলেন। একে একে জীবনের সব পূর্ণতার দ্বার উন্মোচিত হতে থাকলো। আর ফুটবলে আত্মপ্রকাশ হতে থাকলো এক কিংবদন্তির৷

গল্পের এই পর্যায়ে আপনাদের নিয়ে যেতে চাই কোনো এক ফুটবল ম্যাচে। আপনি টিভি স্ক্রিনের সামনে বসে আছেন। ম্যাচ চলছে৷ হঠ্যাৎ... গোল; ভাষ্যকারের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ; আপনি দু'হাত তুলে প্রিয় দলের সেলিব্রেশনের অংশ হলেন। কিংবা, উল্টোটাও হতে পারে। গোল খেলো আপনার প্রিয় দল। তবু একজন মানুষ টিভি স্ক্রিনে উল্লাসিত কন্ঠে চিৎকার করে যাচ্ছে। আপনার শুনতে একটুও খারাপ লাগছেনা। কিংবা যে মানুষটা অতি আনন্দিত গলাতে গোলের বর্ণনা দিচ্ছে, তার প্রতি আপনার কোনো ক্ষোভ নেই। তার পেশা'টাই যে ফুটবলের রঙ্গ ছড়ানো! তবে টিভি স্ক্রিনের ওপাশে উল্লাস- উৎকন্ঠায় গলা ফাটিয়ে রঙ্গ ছড়ানো সেসব মানুষ'দের সম্পর্কে আমরা কি-ই বা জানি। এই জগতের কিংবদন্তি সমতুল্যে একজন মানুষের গল্প বলা যেতে পারে। তাকে বলা হয়ে থাকে 'দ্যা পোয়েট অফ ফুটবল'! যিনি ফুটবল খেলেন না, কিন্তু ধারাভাষ্যের মাধ্যমে ফুটবলকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন- পিটার ড্রুরি! যার কন্ঠস্বরে কেঁপে উঠে নিস্তব্ধ ফুটবলের আসর; প্রানহীন ম্যাচেও যার কন্ঠস্বর শুনায় তেজী সিংহের মতো; আর কি মাধুর্যতা সে কন্ঠে! শ্রবণেন্দ্রিয়কে সাময়িক সুখ দিতে পারে যার কাব্যিক ধারাভাষ্য- তবে তাকে নিয়েই গল্প হোক….

শুরু করতে চাই কৈশোরের দুরন্তপনায় ভরা সেইসব দিনের পিটার ড্রুরির কথা। ছোটবেলার কথা রোমান্থন করতে গিয়ে ড্রুরি বলেন-

'বাল্যকাল থেকেই আমি জানতাম একজন ভালো ক্রীড়াবিদ হতে পারবোনা। তবে আমার স্বপ্ন ছিলো ফুটবলার হই। কোনো প্রফেশনাল ক্লাবের হয়ে খেলি। কিন্তু আমি এসবের ধারেকাছেও ছিলাম না। টেলিভিশন এবং রেডিওতে, বিশেষ করে রেডিওতে আমি খেলাধুলার খবরাখবর নিতাম। শুনতে বেশ লাগতো। কিছুটা রহস্যময়ও লাগতো- কিভাবে টিভি- রেডিওতে মানুষ কথা বলে এটা ভেবে।'

একজন তরুণ হিসেবে ড্রুরির জীবনকাল খুবই স্বাভাবিক গতিতে চলতো। পার্কে খেলতে গিয়ে কখনোও গোল দিয়ে দিলে, রেডিওতে শুনা জকি'দের ভঙ্গিমায় নিজেই বলে উঠতেন- 'গোওওওওল, ও হোয়াট আ গোল! দিস ইজ আনরিয়েল'….. কিংবা ক্রিকেট খেলায় উইকেট পেয়ে গেলে- 'গট হিম', 'ইউ মিস আই হিট'... এভাবেই ভাষ্যকারদের নকল করে চিল্লাচিল্লি করা ড্রুরি একদিন ভাবলেন; মন্দ তো নয়, লেটস গিভ ইট আ ট্রাই!

১৯৮৮ সালের দিকে ড্রুরি যখন ইউনিভার্সিটি ছাড়লেন; তিনি নিজেও জানতেন না কি হতে চলেছে তার জীবনে। বেকারত্ব কাটাতে জড়িয়ে পড়লেন একাউন্টেন্ট পেশায়। তবে তা স্থায়ী হলোনা। ড্রুরি মাইন্ডসেট ঠিক করে নিলেন- স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার কাজে নেমে পড়ার এখনি সময়। লেখার শুরুর বার্নার্ড সাহেবের মতো তিনিও চাকরি ছেড়ে লেগে পড়লেন ভিন্ন কিছু করার তাগিদে। তবে এই ভিন্ন কিছুটা 'ধারাভাষ্য' দেয়া ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। স্পোর্টস জার্নালিস্ট হিসেবে আত্মনিয়োগ করতে শুরু করলেন নিজেকে। শুরুতেই হোচট খেতে হলো। ডজনখানেক রিজেকশনের পরেও বার্নার্ড সাহেবের মতো তিনিও থেকে থাকলেন না। যে-করেই হোক, ধারাভাষ্যকার হওয়া তার চাই৷ নেশার মতো হয়ে গিয়েছিলো ব্যাপারটা। ড্রুরি বলেন-

'রিকেশনের পর রিজেকশন! আমার বেডরুমে মস্তবড় এক ফাইল রয়েছে, শুধুই রিজেকশনের চিঠি! সবার একই কথা- অভিজ্ঞতা নাই। তবে আমার ভাগ্যে খুলে গেলো লন্ডনের বিখ্যাত 'হ্যাটেরস' স্পোর্টস এজেন্সির সাড়ায়। তারা আমাকে জয়েন করতে বলবো এবং তাদের সাথে কাজ করতে থাকলাম আমি।'

ড্রুরি যোগ করেন- 'এখানে কয়েক বছর কাজ করার পর আমি এবার আবেদন করলাম লিডসের বিবিসি লোকাল রেডিওর জন্য। নব্বইয়ের দশকে লিডস ইউনাইটেড ছিলো ইংল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন দল! তাদের হয়ে সর্বপ্রথম ধারাভাষ্য শুরু করা ছিলো আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।'

লিডস ইউনাইটেডের পাশাপাশি সেসময় ইয়র্কশায়ারের ক্রিকেট লীগেও ধারাভাষ্যকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্টিত করতে শুরু করে দিয়েছেন পিটার ড্রুরি। এ তো কেবল যাত্রা! সুপ্রসন্ন ভাগ্যে তাকে কতদূর নিয়ে পৌঁছায় তা আমরা জানবো। তবে তার আগে জেনে নিই ড্রুরির অভিজ্ঞতার কথা-

'সত্যি কথা বলতে কি- আমি অনেক বড় রিক্স নিয়ে ফেলেছিলাম। আমার জীবনের সব অনূকূলতার বিরুদ্ধে ধারাভাষ্যকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্টিত করা ছিলো যুদ্ধের সামিল ব্যাপার! তবে আমি দমে যাইনি।'

ধারাভাষ্যকার হিসেবে বেশ ভালোই করছিলেন ড্রুরি। ফলস্বরুপ, ৯৬ সালের ইউরো কাপে তাকে দেখা গেলো 'বিবিসি রেডিও ফাইভ লাইভের' ভাষ্যকার হিসেবে। তার প্রাণখোলা কন্ঠ, সরল স্বীকারোক্তি ধরনের হাস্যেজ্জল ধারাভাষ্য অনেকের-ই মনে ধরলো৷ তারচেয়ে বড় কথা- তার দরাজ কন্ঠে ফুটবলের ধারাভাষ্য শুনা যেন গায়ে আগুন লাগা! গুজবাম তৈরি হওয়া..

ড্রুরি যখন ধারাভাষ্য দেন, কোনো প্লেয়ার গোল দিলে তার নামের পাশে অন্তত ২-৩ টা বিশেষণ ব্যবহার করে থাকেন। কিভাবে এতো দ্রুত সময়ে ব্যাপারটা ঘটে আমার জানা নেই। উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে- গোল দিয়েছেন জার্মেইন ডিফো; ড্রুরির কন্ঠ থেকে বেরিয়ে আসবে-

Jermain Defoe, the perfect pint-sized package of pace, poise and panache…

ড্রুরি বলেন বলেন- আমি শব্দের খেলা করতে ভালোবাসি। শব্দগুলো যথাসময়ে বেরিয়ে আসে। আমি জানি মানুষ ধারাভাষ্য শুনার জন্য ফুটবল খেলা দেখেনা; তারা জানেওনা কে কোন অবস্থায় ধারাভাষ্য দিচ্ছে; তবে এদিক দিয়ে আমি ভাগ্যবান। আমি ফুটবলকে উপভোগ করার সাথে সাথে দর্শক-শ্রোতাদের উপভোগ করার সুযোগ দিতে পারি।

ড্রুরির ধারাভাষ্যে একটা জিনিস খুব ইন্টারেস্টিং। যখন কোনো ফুটবলার বিপজ্জনক শর্ট নেয়, তিনি ইচ্ছা করেই প্লেয়ারটির পুরো নাম উচ্চারণ করবেন। যেমন-

It's headed clear, but only as far as the edge of the box and Diago Costa..

ড্রুরি তার প্রফেশনাল ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন লিডস ইউনাইটেড ক্লাবের রেডিওতে ধারাভাষ্য দিয়ে। আজ তার কন্ঠ ছড়িয়ে পড়েছে বহুদূর! নব্বইয়ের দশকে ধারাভাষ্য জগতে পদচারণা করা পিটার ড্রুরির জন্ম ১৯৬৭ সালে, ইংল্যান্ডে৷ লিডসে ৪ মৌসুম কাটানোর পর ড্রুরি লন্ডনের ব্রডকাস্টিং হাউজে যোগ দেন। তারপর আইটিভি, রেডিও ফাইভ ছাড়াও বেশ কিছু কর্পোরেশনের সাথে কাজ করার পর ২০১৩ সালে বিটি স্পোর্টসের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন ড্রুরি। সেইসাথে ইংলিশ প্রিমিয়ারলীগ, ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ, ইউয়েফা ইউরো কাপ এবং এফএ কাপে ধারাভাষ্য দেয়ার সুযোগ পান তিনি। ২০১৪ ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা- জার্মানির ম্যাচে ধারাভাষ্যকার হিসেবে ছিলেন এই ড্রুরি! কিংবা ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল- এখানেও আছেন 'পোয়েট অফ ওয়াল্ড ফুটবল'। প্রিমিয়ারলীগের বেশিরভাগ ম্যাচেই জিম ব্যাগলিনের সাথে ধারাভাষ্য দেন ড্রুরি। জিমের সাথে ১৯৯৫ সাল থেকে সখ্যতা তার!

একজন ধারাভাষ্যকার'কে নিয়ে লিখা আর্টিকেলে অসাধারণ কিছু থাকার সুযোগ বোধহয় নেই। তবুও আমি কল্পনা করতে পারি কিংবদন্তিতুল্যে এই মানুষটার কন্ঠ; গায়ে কাটা দেয়। তার বজ্রধ্বনি গায়ে উদভ্রান্তের মতো আগুন ছড়িয়ে দেয়; ড্রুরির ধারাভাষ্য মানেই যেন ভিন্ন কিছু। তাকে নিয়ে গল্প হতেই পারে…

© আহমদ আতিকুজ্জামান।