• ফুটবল

তিনি আসলেন, স্বপ্ন দেখালেন, জয় করলেন!

পোস্টটি ৫৫৩৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১৮৯২ সালের কথা। ফুটবল এসোসিয়েশনের কাছে জন হৌল্ডিং নামের এক ভদ্রলোক আবেদন করলেন 'এভারটন এফসি অ্যান্ড এথলেটিক গ্রাউন্ড লিমিটেড' নামে একটি ক্লাবের নামকরণ হবে। ফুটবল এসোসিয়েশন বিনয়ের সাথে তার প্রস্তাবটি নাচক করে দিলেন। জন হৌল্ডিং নামের ওই ভদ্রলোক ছিলেন ইংল্যান্ডের ৭ম বৃহত্তম ফুটবল মাঠ 'এনফিল্ড' এর কর্ণধার। তার কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে বিগত বছর আটেক ক্লাব পরিচালনা করেছে পাশ্ববর্তী এলাকার ক্লাব 'এভারটন'। '৯২ সালে এসে এভারটন ক্লাব কর্মকর্তাদের সাথে বনিবনা না হওয়ায় জন হৌল্ডন তাদেরকে তার মাঠ ছেড়ে যেতে বললেন। এভারটন চলে গেলো গডিসন পার্কে। এদিকে ক্লাবের নামকরণে বাঁধা পেয়ে হৌল্ডন সাহেব ভাবলেন তবে এবার নিজেই একখানা ক্লাব খুলে বসা যাক। এলাকার নামে নামকরণ করলেন লিভারপুল এফসি; লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের জাগরণের সূচনা এখান থেকেই।

লিভারপুল এখন পর্যন্ত ২১ জন পূর্ণকালীন ম্যানেজার নিয়োগ দিয়েছে। তন্মধ্যে ক্যানি ডাল্গলিশ কেবল দুবার ক্লাবের দায়িত্ব নিয়েছেন। সফল ম্যানেজারদের তালিকায় সবার উপরে থাকবে 'বব প্যাইস্লি'র নাম। তবে টানা ১৯ বছর ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা টম ওয়াটসনের নামও স্মরণ হবে দৃঢ়চিত্তে। বিল শ্যাঙ্কলির কথাও বলা যেতে পারে। তবে সবাইকে ছাপিয়ে আমি আপনাদের আজ পরিচয় করিয়ে দিবো লিভারপুলের বর্তমান কোচের সাথে।

১৯৬৭ সালের ১৬ জুন। মহাকবি গ্যোটে’র দেশ জার্মানির বিভাগীয় শহর স্টুটগার্টের দক্ষিন-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা ব্যাদেন-উর্টেম্বার্গের এক অস্বচ্ছল পরিবারে তার জন্ম। বাবা নোবার্ট ক্লপ পেশায় একজন সেলসম্যান; টুকিটাকি জিনিস ফেরি করে বেড়ান শহরের এ প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। তারুণ্যে নোবার্ট দাপিয়ে বেড়িয়েছেন কতসব তেপান্তরের মাঠ। ছিলেন একজন প্রফেশনাল গোলকিপার৷ সংসারের অর্পিত দায়িত্বে বিসর্জন দিয়েছেন সব। ছেলে জার্গেন ক্লপ আর দু'মেয়েকে বেড়ে তুলেছেন ছবির মতো সুন্দর গ্রাম ব্ল্যাক ফরেস্ট ঘেষা গ্ল্যাটেন গ্রামে। স্বচ্চ কাঁচের মতো নীল পানি আর সাদা তুলোর মতো মেঘ দু'দিক দিয়ে পরিবেষ্টিত হয়ে আছে ব্ল্যাক ফরেস্ট৷

এমন নৈসর্গিক পরিবেশে বেড়ে উঠছিলো স্বপ্নবাজ এক তরুণ, যার মন পড়ে থাকতো কেবল খেলার মাঠে! ক্লাসে অমনোযোগী ছিলো বটে, তবে স্কুলের যেকোনো প্রতিযোগিতায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজে বের করা ছিলো মুশকিল। কিশোর বয়সে একজন প্রফেশনাল ডাক্তার হওয়ার কথা ভাবতো সে৷ তবে সে আশায় গুড়ে বালি; কারণ সে জানতো ডাক্তার হওয়ার মতো যথেষ্ট 'স্মার্ট' সে ছিলোনা। বর্ষ সমাপ্তিতে উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে যখন তার আমলনামা দেয়ার পালা, হেডমাস্টারমশাই তাকে ডেকে পাঠালেন৷ 'এ-' এর সার্টিফিকেটখানার দিকে তাকিয়ে তার উদ্দ্যেশে বললেন- 'আমি মনে করি এ- এর সার্টিফিকেট হয়তো ফুটবলে কাজে দিবে, এছাড়া তোমার জন্য এটি ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসবেনা।'

১৯৮৯-৯০ সালে প্রথমবারের মতো সিনিয়র পর্যায়ে প্রফেশনাল কোনো ক্লাবের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি, তবে ততোদিনে অন্তত সাতটি প্রফেশনাল ক্লাবের জুনিয়র টিমে খেলার অভিজ্ঞতা হয়ে যায় তার৷ ১৯৯০ সালের এক গ্রীষ্মের দুপুরে 'মেইনজ ০৫' ক্লাবের সিনিয়র দলে তার অন্তর্ভুক্তি হয়ে যায় পাকাপোক্ত। ক্লপ খেলা শুরু করেন একজন জাত স্ট্রাইকার হিসেবে। তবে '৯৫ সাল থেকে খেলার ধরন পাল্টে বনে যান রাইটব্যাক। 

প্রফেশনাল ক্যারিয়ারের সিংহভাগই কাটিয়েছেন মেইনজ ক্লাবের হয়ে। '৯০ সালের শুরুতে যোগ দিয়েছিলেন ক্লাবে। টানা ১১ বছরের সে যাত্রা গিয়ে থামলো ২০০১ সালের শুরুতেই। ততোদিনে শতবর্ষী ক্লাবের প্রিয়জনে পরিনত হয়ে গিয়েছেন ক্লপ। পাশাপাশি তাদের অলটাইম গোলস্কোরারের তমকাটাও গায়ে জড়িয়েছেন। রিটায়ার্ড করার ক'দিন পরেই মেইনজ তাদের কোচ 'অ্যাকহার্ড ক্রায়ুথজুন'কে বরখাস্ত করে এবং অন্তর্ভর্তিকালীন কোচ হিসেবে ঘোষণা করে জার্গেইন ক্লপের নাম! ফুটবলার ক্লপের কোচিংয়ের শুরুটা মূলত এখান থেকেই..

° ক্লপ যেভাবে মেইনজ ক্লাবের ইতিহাস বদলে দিলেনঃ

মেইনজ তখন রেলিগেশন শঙ্কায় দিন পার করছিলো। দায়িত্ব নেয়ার পরদিনই ক্লপকে ড্যোজবার্গের মুখোমুখি হতে হলো। সে যাত্রায় ১-০ গোলের জয়ে বেঁচে গেলেন সদ্য নিয়োগ পাওয়া এই কোচ। তবে পরবর্তী ৭ ম্যাচের ৬ টিতেই দলকে জয় এনে দিয়ে বিস্ময়ের জন্ম দেন ক্লপ। এক ম্যাচ হাতে রেখে ১৪ নাম্বার হয়ে মৌসুম শেষ করে বাঁচিয়ে রাখেন দ্বিতীয় বিভাগে খেলার স্বপ্ন। ২০০১-০২ মৌসুমে তাকে পুরোদস্তুর এক ফুটবল কোচ হিসেবে আবিষ্কার করে জার্মানবাসী। ক্লাবকে রীতিমতো বদলে ফেলেন তার আপন মহিমায়। রেলিগেশন শঙ্কায় থাকা ক্লাবটি পরবর্তী মৌসুম শেষ করে লীগে চতুর্থ স্থান দখল করে। তবে টপ ত্রি'তে জায়গা না পাওয়ায় বুন্দেসলীগায় খেলা হলোনা সেবার৷  ২০০৩-০৪ মৌসুমে দুর্দান্ত খেলে তার দল। তবে প্রমোশনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় মৌসুমের শেষ দিন পর্যন্ত। এবারোও হতাশ হতে হয় ক্লপ'কে! শুধুমাত্র গোল ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ায় আবারোও বুন্দেসলীগায় জায়গা নিতে ব্যার্থ হয় তারা। মৌসুম শেষ করে ৪ নাম্বার অবস্থানে থেকে। টানা দু'মৌসুমে হতাশার আগুনে দগ্ধ হওয়া ক্লপ ২০০৩-০৪ মৌসুম শেষে ঠিকই হাসলেন বিজয়ের হাসি।

৩য় বারের চেষ্টায় ক্লপ তার দলবল নিয়ে হানা দিলেন জার্মান ফুটবলের শীর্ষস্থান বুন্দেসলীগায়। এটিই ছিলো ক্লাবের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বুন্দেসলীগায় স্থান দখল করা। সবচেয়ে কম বাজেট, দেশের সবচেয়ে ছোট স্টেডিয়াম আর অল্প সংখ্যক ফ্যান নিয়ে বুন্দেসলীগায় মেইনজের পথচলা শুরু হলো ক্লপের হাত ধরে। জার্মানির টপ ক্লাবগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে মেইনজ ২০০৪-০৫ মৌসুম শেষ করলো ১১ তম স্থানে। পরবর্তী মৌসুমে একই অবস্থা, আবারোও ১১ তম! তবে এবার তারা ইউয়েফা কাপের জন্য কোয়ালিফাই করলো। যদিও সেভিয়ার সাথে হেরে গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিতে হয় তাদেরকে। ২০০৬-০৭ মৌসুমে বুন্দেসলীগা থেকে রিলেগেটেড হয়ে যায়; তবু ক্লপ ক্লাবের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরবর্তী মৌসুমে বুন্দেসলীগায় স্থান নিতে না পারায় অভিমানে ক্লাবের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করলেন ক্লপ। স্মৃতিতে রেখে গেলেন ক্লাবের রেকর্ড পরিমান ১০৯ টি জয়!

° বুরুশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে আবির্ভাব ক্লপেরঃ

জার্মানির ফুটবলে ক্লপ তখন চেনা মুখ। মেইনজের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের সুযোগ নিতে চাইলো জার্মান চ্যাম্পিয়ন বায়ার্ন মিউনিখ। তবে তাদেরকে হতাশ করে ২০০৮ সালের মে মাসে দু'বছরের চুক্তিতে ক্লপ নাম লেখালেন বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডের কোচ'দের তালিকায়। বুরুশিয়া তখন খারাপ সময় পার করছিলো। পূর্ববর্তী কোচ থমাস ডলকে বহিষ্কার করা হয় লীগ টেবিলের ১৩'তে তাদের নিয়ে যাওয়ার খেসারতস্বরুপ। বায়ার্নকে হারিয়ে ক্লপ বুরুশিয়ায় প্রথম মৌসুমেই জিতে নেন জার্মান সুপারকাপের শিরোপা, আর মৌসুম শেষ করেন ৬ নাম্বারে থেকে। পরবর্তী মৌসুমে লীগের সবচেয়ে তারুণ্য-নির্ভর দল নিয়ে মৌসুম শেষ করেন ৫ম স্থানে থেকে।

২০১০-১১ মৌসুমটা স্বপ্নের মতো কাটলো বুরুশিয়ার। লেভারকুসেনের বিপক্ষে ২-০ হার ব্যতীত ১৫ ম্যাচের ১৪টিতেই টানা জয় পেয়ে ক্রিসমাসের ছুটি কাটাতে যায় ক্লপের শীষ্যরা। দুই ম্যাচ হাতে রেখেই ২০১০-১১ মৌসুমে লীগ শিরোপা ঘরে তুলে বুরুশিয়া। এটি ছিলো বুরুশিয়ার ৭তম লীগ শিরোপা জয়, তবে এর আগে এতো তরুণ দল নিয়ে কেউ লীগ জিততে পারেনি। ২০১১-১২ মৌসুমে টানা ২য় বারের মতো শিরোপাজয়ের উল্লাস করলো ক্লপ বাহিনি।  মৌসুম শেষে বুরুশিয়ার ৮১ পয়েন্ট ছিলো বুন্দেসলীগার ইতিহাসের শ্রেষ্ট রেকর্ড! পাশাপাশি লীগে বায়ার্নের ২৫ ম্যাচ জয় থাকার রেকর্ডটিও ছুঁয়ে ফেলে তারা। মৌসুমে ২৮ ম্যাচ আনবিটেন থাকার আরেক মাইলফলক গড়ে বুরুশিয়া। মে মাসে 'ডিএফবি-পোকাল' কাপের ফাইনালে বায়ার্নকে ৫-২ গোলে বিধ্বস্ত করে মৌসুমে ডাবল শিরোপা ঘরে তুলে বুরুশিয়া। 

বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডের ফ্যানদের বলা হয়ে থাকে 'বেস্ট ফ্যানবেজ ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড'। মেঘের পরে যেমন রোদ হাসে- তেমনি খারাপ সময় পার করে ইতিহাসের শ্রেষ্ট সময় পার করছিলো ক্লাবটি। আর সার্কাসের পুতুলনাচের অপারেটরের মতোই সেখানে কাড়ি নাড়ছিলেন জার্গেইন ক্লপ। বুরুশিয়ায় ক্লপের দিনগুলো স্বপ্নের মতো কাটছিলো। ক্লপ চাইছিলেন দল যেন চ্যাম্পিয়ন্স লীগের প্রতি মনোযোগী হয়। কারণ বিগত মৌসুমগুলোতে চ্যাম্পিয়নস লীগে তাদের পার্ফমেন্স সন্তষ্টজনক ছিলোনা। প্লানমাফিক সেভাবে এগুতো থাকলেন ক্লপ। তবে গ্রুপ অব ডেথে ভাগ্যে নির্ধারণ হয় তাদের। ফলাফলস্বরুপ সবগুলো ম্যাচেই ড্র করে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই নটআউট পর্বে যায় তারা। সেমিফাইনালে মুখোমুখি হতে হয় মরিনহোর মাদ্রিদের।

সেমিফাইনাল ম্যাচের আগেরদিন বায়ার্ন ঘোষণা করে মারিও গোৎজে'কে তারা চুক্তিবদ্ধ করে ফেলেছে! ঘটনার আকষ্মিকতায় যথেষ্ট রাগান্বিত হন ক্লপ। যাইহোক, দু'লেগ মিলিয়ে গোল বিচারে মাদ্রিদকে হারিয়ে ফাইনালে খেলার টিকেট পায় ক্লপ বাহিনি। ফাইনালে বায়ার্নের মুখোমুখি হয় তারা। ১-১ সমতায় থাকা ম্যাচে রোবেন ৮৯ মিনিটে গোল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন! নিঃস্তব্ধতার চাদরে ঢেকে ফেলেন পুরো স্টেডিয়াম। ডাগ-আউটে কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায় ক্লপের মলিন মুখ অনেক কিছুই বলে দিচ্ছিলো। ম্যাচ শেষে প্লেয়াররা যখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলো, ক্লপ তখন তাদের পরম মমতায় বুকে টেনে নিয়ে সান্তনা দেন। এখানেও তিনি অনন্য, সবার থেকে আলাদা। প্লেয়ারদের খাটিয়ে কেবল শিরোপা ঘরে তুলাতেই যে সবকিছু শেষ না; কিংবা ম্যাচের বাজে ফলাফলে প্লেয়ারদের উপর রাগ করে ড্রেসিংরুমে চলে যাওয়াতেই স্বার্থকতা না- তিনি সেটি খুব নীরবে ভুমিকায় বুঝিয়ে দেন।

চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর জার্মান সুপারকাপ ফাইনালেও হেরে যায় বুরুশিয়া। পাশাপাশি পোকাল কাপের রাউন্ড অফ সিক্সটিন থেকেও বাদ পড়ে তারা। মৌসুম শেষ করে লীগ টেবিলের ২য় হয়ে। ২০১৩-১৪ মৌসুমের শুরুতেই ক্লাবের সাথে চুক্তির সময়সীমা বাড়ান ক্লপ। জানুয়ারীতে ঘটা করেই দলের অন্যতম সেরা তারকা রবার্ট লেওয়ান্ডনবস্কি দল ছাড়েন। প্রধান দুই অস্ত্র হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন ক্লপ। সে মৌসুমে জার্মান সুপারকাপ জিতলেও চ্যাম্পিয়নস লীগ থেকে বাদ পড়ে তারা, লীগে ২য় স্থান ধরে রাখে আবারো। ২০১৪-১৫ মৌসুম ছিলো বুরুশিয়ায় ক্লপের শেষ মৌসুম। ৭ম স্থানে থেকে বাজেভাবে মৌসুম শেষ করে তারা৷ এপ্রিলে বুরুশিয়া ছাড়ার ঘোষণা দেন ক্লপ। সিগনাল ইদুনা পার্কের লন ধরে শেষ পদক্ষেপের আগ পর্যন্ত অসংখ্য- অগুনতি দর্শকের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে শেষ ম্রিয়মান হাসি হাসেন ক্লপ; বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডের স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে যার আগমন ঘটেছিলো। দু'হাত উজাড় করে দিয়েছেন ক্লাবকে। ক্লাবের রেকর্ডবুক, ট্রফি ক্যাবিনেট কিংবা ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার- সবখানেই তিনি সফল। তার হারানোর কোনো ভয় ছিলোনা এখানে। যাওয়ার আগে ক্লাবের রেকর্ড সংখ্যক ১৭৯ ম্যাচ জয় তাকে স্মৃতিতে অম্লান করে রাখবে বহুদিন।

° ক্লপের লিভারপুল যাত্রা এবং ইতিহাস পাল্টে দেয়াঃ

এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে শিরোপা খরায় ভুগছিলো দলটি, তার উপর ব্রেন্ডন রজার্সের বাজে ট্যাক্টিক্স মাঠ ও মাঠের বাইরে প্রভাব ফেলছিলো জোড়ালোভাবে। শেষ কবে শিরোপা জিতেছিলো- এমন প্রশ্নের সম্মুখিন হলে লজ্জায় পড়ে যেতো লিভারপুল সমর্থকরা। ঠিক তখনি সমস্ত গুঞ্জনকে সত্যি করে, ক্লাবের ধুলোপড়া স্বর্ণালি ইতিহাসের পাতাকে আরোও শানিত করতে এনফিল্ডে পা রাখলেন জার্গেইন নোবার্ট ক্লপ! তারিখটা স্পষ্ট মনে আছে, ০৮ অক্টোবর, ২০১৫। লেখক নিজে সেদিন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, 'আমাদের সুদিন সন্নিকটে'। এনফিল্ডের দীর্ঘ করিডোর ধরে ক্লপ হেটে গেলেন প্রেস কনফারেন্স রুম পর্যন্ত। ততক্ষণে ক্লাবের সাথে তার ৩ বছরের চুক্তি হয়ে গেছে। মিডিয়ার সামনে আসলেন খানিক পরে। সদা হাস্যেজ্জ্বল এই মানুষটার মতিগতি দেখে বুঝার উপায় নেই তিনি যুদ্ধ জয় করে এলেন, নাকি যুদ্ধ জয়ের চ্যালেঞ্জ নিলেন। শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, 'এটা সাধারণ কোনো ক্লাব নয়। আমি দুটি ক্লাবকে কোচিং করিয়েছি, এখন সময় লিভারপুলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। প্রেসের কেউ একজন জিজ্ঞেস করে বসলেন তিনি হোসে মরিনহোর মতো 'স্পেশাল ওয়ান' কিনা! ক্লপ স্মিত করে হেসে নিলেন। বললেন, 'না আমি স্পেশাল ওয়ান নই। আমি নরমাল ওয়ান।' কনফারেন্স রুমে তখন আনন্দের হাসি বর্ষিত হচ্ছিলো। 

ক্লপের যাত্রা শুরু হলো স্পার্সের সাথে ড্র দিয়ে। প্রথম লীগ জয় আসলো চেলসির বিপক্ষে। ২০০৭ সালের পর ক্লপের নেতৃত্বে ২০১৬ সালে ইউরোপা লীগের ফাইনালে স্থান করে নেয় লিভারপুল। সেভিয়ার বিপক্ষে স্টারিজের একমাত্র গোলের বিপক্ষে সেভিয়া করেছিলো ৩ গোল! লিভারপুল ৮ম স্থানে থেকে ২০১৫-১৬ মৌসুম শেষ করে। পরবর্তী মৌসুমে মিডলসবার্গের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয় তাদেরকে চ্যাম্পিয়নস লীগে কোয়ালিফাই করে। এবং লীগ টেবিলে ৪র্থ হিসেবে মৌসুম শেষ করে। ক্লপের যাদুকরী ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছিলো লিভারপুলের খেলার ধরণ। ক্রমেই তারা শক্ত অবস্থানের দিকে আগাচ্ছিলো। ২০১৭-১৮ মৌসুমেও ৪ নাম্বার অবস্থানে থেকে লীগ শেষ করে লিভারপুল। টানা ২য় বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লীগে খেলতে যায় ক্লপের নেতৃত্বে। ক্লপ দলকে ফাইনালের বন্দরে পৌঁছাতে সমর্থ হন। ২০০৭ সালের ইস্তাম্বুলের সেই স্বপ্নের রাতের পর আবারো আরেকটি স্বপ্নের রাত অপেক্ষা করছিলো লিভারপুল ফ্যানরা। তবে সে স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় রিয়াল মাদ্রিদের তান্ডবে। ফাইনালে ৩-১ গোলে হেরে যায় ক্লপের শিষ্যরা। সেটা ছিলো ক্লপের ক্যারিয়ারের সপ্তম মেজর টুর্নামেন্টের ষষ্ঠ পরাজয়। এমন পরাজয়ে ভেঙ্গে পড়েননি ক্লপ। তিনি আস্থা রেখেছেন, আস্থা যুগিয়েছেন৷ অনুপ্রেরিত করেছেন এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্রনায়।

সে নিয়ম মেনে ক্লপ আবারোও দৃঢ়তার সাথে দলকে পরিচালনায় মন দিলেন। জানুয়ারিতে দলে বেড়ালেন ভ্যান ডাইককে। একজন ডিফেন্ডারের জন্য ৭৫ মিলিয়ন কেন খরচ করেছিলেন ক্লপ, তা দেখার অপেক্ষায় ছিলো বিশ্ববাসী। সামারে দলে বেড়ালেন ফ্যাভিনহো আর নেবি কেইটাকে৷ শাকিরি'কে বলতে গেলেন কিনে নিলেন পানির দামে। সব ছাপিয়ে দলের গোলবার রক্ষার দায়িত্ব দিতে নিয়ে আসলেন এলিসন বেকারকে। খেলা জমে গেলো। ২০১৮-১৯ মৌসুম শুরু হলো ক্লাবের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা ফর্ম নিয়ে, টানা ৬ ম্যাচে জয়। ক'দিন পরেই লিভারপুলের হয়ে ১০০ তম জয় তুলে নিলেন ক্লপ। আর্সেনালের সাথে হারলে টানা ৩১ ম্যাচ আনবিটেন থাকার সমাপ্তি ঘটে লিভারপুলের। ৯৭ পয়েন্ট নিয়েও লীগ জিততে না পারা ছিলো ইপিএলের আরেক রেকর্ড। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০১৮-১৯ মৌসুম শেষ করতে হয় রানার্সআপ হয়ে। চ্যাম্পিয়নস লীগে গ্রুপ পর্বে ২য় হয়ে নক-আউট পর্বে জায়গা করে নেয় লিভারপুল। অতঃপর, বায়ার্ন ও পোর্তোকে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় তারা। সেমিতে প্রতিপক্ষ ছিলো বার্সালোনা। ক্যাম্প নু'তে ৩-০ গোলে হেরে গেলেও নাটকীয়ভাবে এনফিল্ডে ৪-০ গোলের ব্যবধানে জয় তুলে নেয় লিভারপুল। ফাইনালে প্রতিপক্ষ স্পার্স৷ অরিগি ও সালাহ'র গোলে সহজেই তাদের কপোকাত করে ক্লপ বাহিনি। ২০০৫ সালের পর আবারোও ইউরোপ শ্রেষ্টত্বের মর্যাদা ফিরে পায় লিভারপুল। শিরোপা উচিয়ে বিশ্ববাসীকে জানান দেন তার দেয়া প্রতিজ্ঞার কথা, তিনি এখানে শিরোপা জিততে এসেছেন।

এইতো ক'দিন আগেই ক্লপের হাত ধরে লিভারপুল ঘরে তুললো ওয়ার্ল্ড ক্লাব ওয়ার্ল্ডকাপের শিরোপা। লিভারপুল কেমন যেন বদলে গেছে, বেশ গোছালো- পরিপক্ব। এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছেন ক্লপ; যিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন নতুন অধ্যায়ের, প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ভালো কিছুর- সবই আজ অক্ষরে অক্ষরে পালন হতে চলেছে। 

© আহমদ আতিকুজ্জামান।