• ফুটবল

গোল; শুধু একটি গোল….

পোস্টটি ৪০১৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সুইডেনের র‍্যোজেনবার্গের বিশাল মাঠের একপাশটায় চলতে থাকা ফুটবল ম্যাচে এক দল হারছিলো ৫-০ গোলের ব্যবধানে। ডাগ-আউট থেকে কোচের ইশারায় ১০ বছর বয়সী যে ছেলেটা নেমেছিলো দ্বিতীয়ার্ধে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটা গোলের পর গোল করেই যাচ্ছিলো! তার একেকটা গোল যেন বারুদমাখা প্রলেপে আচ্ছাদিত কোনো আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানির মতোই ফুলঝুরি ফোটাচ্ছিলো। ৫-০ গোলে হারের মুখ থেকে ফিরে এসে ৫-৮ গোলে ম্যাচ জয় করেছিলো সে কিশোরের দল। বলাই বাহুল্য, দু’হালি গোলের সবকটাই এসেছিলো বদলি হিসেবে নামা সে কিশোরের পা থেকে! পরবর্তীতে বিশ্ব যাকে চিনেছে, ‘জ্বালাতান ইব্রাহিমোভীচ’ হিসেবে।

নাহ, কৈশোরে ইব্রাহিমোভীচের ভয়ংকর সে উত্থানের গল্প অবতারণা করা এই লেখার মুল বিষয়বস্তু মোটেই নয়। বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘গোল’। একটা গোল কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে সে প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা হতেই পারে৷ কিংবা একটা গোল কতটা বিষাদের ছাপ ফেলতে পারে তা নিয়েও দীর্ঘ আলাপচারিতায় মেতে উঠা যেতে পারে৷

গোল’কে বলা হয়ে থাকে ফুটবলের সোনার হরিণ। সে হরিণের সংখ্যা যার আশ্রয়ে যতবেশি থাকে, দিনশেষে সে-ই স্বর্গের হাসি হাসি। গোল খেলার অংশ; গোল মানব মস্তিষ্কে উত্তেজনা সৃষ্টির কড়া উপাদান, গোল মানুষের অশ্রুসিক্ত নয়নের নীল খামে বন্দী ইমোশনের ফেরিওয়ালা। গোল মানুষকে হাসায়, কাঁদায়- ভালোবাসা বিলায়; গোল মানুষের মস্তিষ্কের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে খেলা করে দিনরাত! ১২০ গজের জগতে, ৯০ মিনিট সময়ের জীবনে গোল-ই সব। গোল সম্পর্কিত লেখায় ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া ভয়ংকর কিছু গোলের উদাহরণ দেয়া যেতেই পারে।

ফুটবল ইতিহাসের হাতেগোনা কয়েকটা গোলের তালিকা তৈরি করা হলে, সেখানে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অব গড’ খ্যাত গোলটি যে সন্দেহাতীতভাবেই থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। যুগের পর যুগ ধরেই সে গোলটি নিয়ে আলোচনা সমালোচনার অন্ত নেই। ৫১ মিনিটে প্লেয়ারদের বোকা বানিয়ে হাতের সাহায্য গোল করে সেটি উদযাপনও করেন তিনি। টেকনোলজির সহায়তা না থাকায় ইংলিশ প্লেয়ারদের দাবি ‘হাত দিয়ে গোল করা হয়েছে”- এমন অভিযোগ আমলে নেন নি রেফারি৷ ফলে গোলটা স্কোরকার্ডে যোগ হয়ে যায়৷

মিনিট চারেক পর এই ডিয়াগো ম্যারাডোনা-ই গোটা স্টেডিয়ামকে স্তব্ধতার চাদরে ঢেকে ফেলেন। নিজেদের অর্ধে পাওয়া বল পায়ের জাদুতে জনা সাতেক ইংলিশ ফুটবলারকে ড্রিবলিংয়ে পরাস্ত করে ফেলে দিয়ে গোলমুখ বরাবর এগিয়ে যান ম্যারাডোনা; ঘটনার আকস্মিকতা এতোটাই দ্রুত ঘটেছিলো যে ইংলিশ গোলকিপার পিটার শিল্টনের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিলোনা! গোলটিকে শতাব্দির শ্রেষ্ট গোল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ডিয়াগোর সেদিনের দুই গোলে ম্যাচ জিতে ফাইনালে যায় আর্জেন্টিনা এবং পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে ২য় বারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুলে।

সর্বকালের সেরা ফ্রি-কিকগুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হলে সবার উপরে যে গোল’টি থাকবে সেটি হচ্ছে ১৯৯৭ সালে ফ্রান্সের বিপক্ষে করা রবার্তো কার্লোসের ‘ব্যানানা’ কিকের গোলটি। প্রায় মাঝমাঠ থেকে নেয়া বুলেটগতির সে কিক-টি এতোটাই ক্ষিপ্র ছিলো, মানবপ্রাচীর ভেদ করে বাঁকা হয়ে চলে যায় গোলপোস্ট দিয়ে! গোলকিপার কিছুই বুঝে উঠার আগেই বলটি জ্বালে ধরা দেয়; গোল সেলিব্রেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কার্লোসেরা। বিজ্ঞানকে রীতিমতো প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন কার্লোস৷ ফ্রি-কিক প্রসঙ্গ যখন আসলো তাহলে আরোও কয়েকটা ফ্রি-কিক গোলের উদাহরণ দেয়া যাক।

মনে পড়ে ২০০৭/০৮ মৌসুমে পোর্টসমাউথের বিপক্ষে করা ক্রিষ্টিয়ানো রোনালদো সে ফ্রি-কিক গোলটির কথা? ডি-বক্সের বাইরে থেকে জোরালো পায়ে নেয়া গোলটি বাতাসে ভেসে খানিকটা যেন দিক পরিবর্তন করে ঢুকে গেলো জালে! সবাই হতবাক! ম্যাচ শেষে স্যার আলেক্স ফার্গুসন তো বলেই দিলেন, ‘কোনো সন্দেহ ছাড়াই এটা প্রিমিয়ারলীগের সেরা গোল আমি প্রত্যক্ষ করেছি।’

কিংবা ২০০১ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে গ্রীসের বিপক্ষে করা ডেভিড বেকহ্যামের সে গোলটি! বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে শুধু একটা ড্রয়ের প্রয়োজন ছিলো ইংলিশদের৷ কিন্তু ম্যাচের অবস্থা তখন ২-১ গোল। মিনিট তিনেক অতিরিক্ত সময়ে চলছে খেলা, হঠ্যাৎ-ই শেরিংহ্যামকে ডি-বক্সের বাইরে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন এক গ্রীস প্লেয়ার। ফ্রি-কিক পায় ইংল্যান্ড। হয়তো বল বাইরে চলে গেলে শেষ বাঁশি বাজিয়ে দিতেন রেফারি; তবে না, বেকহ্যামের নিখুঁত ফিনিশিংয়ে বল খুঁজে নেয় জালের ঠিকানা। ২-২ গোলে ড্র করে বিশ্বকাপের টিকেট পেয়ে যায় ইংলিশরা।

অথবা, মেসি- নেইমার- সাউল এবং আরোও অনেককে হটিয়ে ২০১৬ সালের সেরা গোলদাতার পুরষ্কার পুস্কাস জয়ী মোহাম্মদ সুব্রীর সে ফ্রিকিকের কথা বলা যায়। মালেশিয়ান সুপার লীগে পাহাং এফএ ক্লাবের বিপক্ষে করা সুব্রীর গোলটি বহু আলোচনার জন্ম দেয়। আপাত দৃষ্টিতে গোলপোস্টের বাম দিকে ঢুকতে দেখলেও বলটি গতিপথ পাল্টে আঘাত হানে ডান বারে! কিভাবে গোলটি এতোটা বাঁক নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন গতিপথে চলে গেলো তা এখনো অজানাই রয়ে গেছে। এই পথের অন্য পথিকদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম রোনালদিনহো; কিংবা জুনিনহো। লিওনেল মেসি; এই প্লেয়ারটি ফ্রিকিক থেকে গোল করাটাকে রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত করেছেন। রজারিও কেনি’র নামটাও যে আজীবন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে সন্দেহ নাই।

এবার আসি অনেকের মতেই এই শতকের সেরা গোল প্রসঙ্গে। ২০১৪ সালের কথা। স্টকহোমে মুখোমুখি ইংল্যান্ড- সুইডেন। পরিক্ষা মূলক ম্যাচ খেলতে রয় হজসনের ইংল্যান্ড দলে সেদিন ৬ জন ফুটবলারের অভিষেক হয়েছিলো। পাশাপাশি স্টিভেন জেরার্ডের ১০০ তম ম্যাচ ছিলো। অঘটন যা ঘটানোর- তার সবটুকু দায়িত্ব সেদিন ইব্রাহিমোভীচ একাই কাঁধে নিয়েছিলেন। শেষ ১২ মিনিটে হ্যাট্টিকসহ ম্যাচে ৪ গোল করেন তিনি; তবে সর্বশেষ গোলটিই যে বারুদের মতো তীব্র ঝাঁজালো হবে তা ক’জন জানতো? বল তখন ইংল্যান্ডের অর্ধে, দৌড়াচ্ছেন ইব্রা৷ ডিফেন্ডার না থাকায় বলটি ক্লিয়ার করতে আসলেন স্বয়ং গোলকিপার নিজে৷ ডি-বক্সের বাইরে হওয়ায় ধরার বদলে হেড মেরে দূরে সরিয়ে দিলেন তিনি। অতপর সেখান থেকে, প্রায় ৩৫ মিটার দূরে থেকে উল্টে ভলি করে গোলপোস্টে বল পাঠিয়ে দেন ইব্রা! এবং গোল….. ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটি গোল!

২০০২ চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে বায়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে করা জিনেদিন জিদানের মাস্টারপিস গোলটার কথা কিভাবে ভুলে যেতে পারে ফুটবল ভক্তরা! কিংবা ১৯৮৮ সালের ইউরো ফাইনালে করা ভ্যান বাস্তেনের পার্ফেক্ট ভলি’র কথা?


অথবা ২০০৫ সালে পুরো বার্নাব্যুকে নিঃস্তব্ধ করে দেয়া রোনালদিনহোর সে গোলের কথা? ২০০২ সালে নিউক্যাসেলের বিপক্ষে করা ডেনিশ ব্যাকক্যাম্পের সে গোল; বিশ্বকাপের মঞ্চে জেমস রুদ্রিগেজের আগুনজ্বলা সে গোল; ডিয়াগো ফোরলানের অমায়িক ফ্রি-কিক, ভ্যান পার্সির শূন্যে ভেসে হেড থেকে গোল; জার্মানির জালে রোনালদোর গোল দেয়ার পর আঙ্গুল নেড়ে সে সেলিব্রেশন; আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার গোল্ডেন গোল এবং বিশ্বকাপ জয়; কিংবা আফ্রিকান সাবালালা’র পায়ে এই দশকের প্রথম গোলের সূচনা; মারিও গোৎজের অসামান্য দক্ষতায় করা গোল- আর্জেন্টিনার স্বপ্ন ভঙ্গ; কিংবা নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ফ্রি-কিক থেকে লিও মেসির জাদুকরি সে ফি-কিক গোল!

ব্রাজিলকে হারিয়ে দেয়ার ম্যাচে ওয়েস্লি স্নাইডারের হেড, মাথায় হাত ঠেকাতে ঠেকাতে সে গোলের উদযাপন; পেনাল্টি শুটআউটে ফ্রান্সের জালে শেষ গোল ঢুকিয়ে দিয়ে ইতালির বিশ্বকাপ জয়- জিদানের কান্না! ম্যানসিটির বিপক্ষে ওয়েন রুনির করা মাতাল করা সে গোল; কিংবা আগুয়েরোর লীগ শিরোপাজয়ী গোল! হাকান সুকুরের দ্রুততম বিশ্বকাপ গোল, কিংবা সর্ব বয়স্ক রজার মিলার গোল করে ভিন্নধর্মী সেলিব্রেশন!

গোল ঠেকিয়ে দিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক জিয়ানলুইগি বুফন কিংবা ওউন গোল করার শাস্তিস্বরূপ এস্কোবারের খুন হওয়া। হাত দিয়ে গোল দিয়েও পার পেয়ে যাওয়া ম্যারাডোনা কিংবা ইচ্ছে করেই হাত দিয়ে গোল বাঁচিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা সুয়ারেজ; ল্যাম্পার্ডের বুলেট গতির সে কিক গোলের স্বীকৃতি না পাওয়া কিংবা ব্রাজিলের লজ্জাজনক ৭ গোল খাওয়ার রেকর্ড! সর্বোচ্চ পরিমান গোলের রেকর্ড হাঙ্গেরির কিংবা নিকারাগুয়ার ১৪ গোল খাওয়া। গোলকিপার হয়েও গোলের পর গোল করতে থাকা রোজারিও কেনি কিংবা জাত স্ট্রাইকার হয়েও হিগুয়েইনের পেনাল্টি মিস করা..


গোল খেলার-ই অংশ। গোলের পাল্লা যার দিকে ভারী হবে সে-ই জিতবে, সহজ সমীকরণ। তবে সমীকরণে গা ভাসায় না ফুটবল। অনিশ্চয়তার ৯০ মিনিটে গোল দিয়ে ফুটবলারেরা যেমন আবেগাপ্লুত হয়ে যান খুশিতে; তেমনি ঘটে যায় কত দূর্ঘটনা; কত অঘটন!

একজন ফুটবলার যখন গোল করেন, তার সতীর্থ’রা দৌড়ে এসে তাকে বুকে টেনে নেন; কিংবা তার সাথে সমান তালে সেলিব্রেশনে সামিল হন- আমি খেয়াল করেছি এই পুরো ব্যাপারটি নিখাঁদ। গোল দেয়া মানে নিজেকে প্রমাণ করা, দলের সম্মান রাখা; গোল দেয়া মানে বিপক্ষ দলকে চুপ করে নিজেদের দাপট দেখানো। গোল, শুধু একটি গোল- কি করতে পারে ভেবে দেখেছেন? একটি গোল আপনার প্রিয় দলকে হারের লজ্জা থেকে বাঁচাতে পারে, আপনার প্রিয় প্লেয়ারের কোনো গোল আপনাকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে; একটি গোল আপনাকে কাঁদাতে পারে, আপনাকে হতাশায় নিমজ্জিত করতে পারে! একটি গোল আপনার পুরো দিনটাই মাঠি করে দিতে পারে; কিংবা একটি গোল ঘুমুতে যাওয়ার আগে আপনাকে স্বর্গীয় আনন্দে ভাসিয়ে দিতে পারে। একটি গোল, শুধু একটি গোল…

 ~ আহমদ আতিকুজ্জামান