• ফুটবল

নটিংহ্যাম ফরেস্ট ও একজন জাদুকরের রোমাঞ্চগাথা

পোস্টটি ২০৬৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ইংলিশ ফুটবলে বরাবরই বেশ কিছু ক্লাব রাজত্ব করেছে। শুরুর দিকে যেমন অ্যাস্টন ভিলা, সান্ডারল্যান্ড, এভারটনের মতো ক্লাব গুলো শাসন করেছে ইংলিশ ফুটবল, তেমনি এ জামানায় রাজত্ব করছে লিভারপুল, আর্সেনাল, চেলসি আর ম্যানচেস্টারের দুই ক্লাব।

কিন্তু প্রায় দেড়শ বছরের ইংলিশ ফুটবলের ইতিহাসে এসব ছাড়াও মাঝে মাঝে কিছু ক্লাব আবির্ভূত হয়েছে কিছু সময়ের জন্য, চমক দেখিয়েছে পুরো বিশ্বকে। অতঃপর আবার কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে অন্তরালে।

এমন ক্লাবের কথা মনে করলে আমাদের মাথায় শুরুতেই আসে লিস্টার সিটির নাম, যারা কিনা এই কিছুদিন আগে ইংল্যান্ডের টপ সিক্সের সবাইকে হটিয়ে লিগ জিতে নিয়ে রচনা করেছে রূপকথা। তবে ইংলিশ ফুটবলে সবচেয়ে অভাবনীয় রূপকথার জন্ম যে ক্লাব দিয়েছিলো, তার নাম নটিংহ্যাম ফরেস্ট।

নটিংহ্যাম ফরেস্টের সূচনা টা গৌরবমণ্ডিতই ছিলো। বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ক্লাব এটি, প্রতিষ্ঠা একশ পঞ্চান্ন বছর আগে, ১৮৬৫ সালে। শুরুতে বেশ প্রাচুর্যপূর্ণই ছিলো এ ক্লাব। শুধু তাই নয়, অন্যান্য ক্লাবের উন্নয়নের জন্যও যথেষ্ট সাহায্য সহযোগিতা করতো তারা। আর্সেনাল, লিভারপুল, ব্রাইটনের মতো ক্লাব গুলো ফরেস্টের সহায়তা পেয়েই প্রতিষ্ঠা পায়। এমনকি আর্সেনালের সকল কিটের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলো তারা, আর সেজন্যই নটিংহ্যাম ফরেস্টের অনুকরণে আজও আর্সেনাল লাল জার্সিতেই মাঠ কাঁপিয়ে বেড়ায়।

image_search_1584771422285

তবে শুরুতে বেশ প্রাচুর্য থাকলেও কখনোই তেমন সাফল্যের দেখা তারা পায়নি। টপ ডিভিশনে শুরু করলেও কয়েক মৌসুম পরেই তারা নেমে যায় সেকেন্ড ডিভিশনে এবং ক্লাবের ইতিহাসের অধিকাংশ সময় সেখানেই পার করতে হয়।

সেকেন্ড ডিভিশনের একদমই নিয়মিত ক্লাবে পরিণত হয়েছিলো ফরেস্ট। সবকিছু সেভাবেই চলছিলো। কিন্তু একদিন এলো, যেদিন বিপ্লব ঘটলো নটিংহ্যামের দলটিতে, আর অবাক হয়ে তা দেখলো পুরো পৃথিবী।

সাফল্য টা কে নটিংহ্যামের কীর্তি না বলে ব্রায়ান ক্লফ নামের এক জাদুকরের কীর্তি বললেও ভুল বলা হবেনা। সত্যিকার অর্থেই তিনি ফরেস্টদের নিয়ে যা করেছিলেন, সেটাকে স্রেফ ম্যাজিকই বলা যায়।

ব্রায়ান ক্লফের জন্ম ইংল্যান্ডের মিডলসব্রোতে এবং স্থানীয় দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাব টিতেই শুরু করেন ক্যারিয়ার। খেলোয়াড় হিসেবে ছিলেন জাত স্ট্রাইকার। মিডলসব্রোর হয়ে ২২২ টি লিগ ম্যাচ খেলে করেছেন ২০৪ গোল! টানা চার সিজন চল্লিশোর্ধ গোল করেন।

কিন্তু একদমি বাজে ডিফেন্সের কারণে এর পরও সাফল্যের দেখা পায়নি মিডলসব্রো। শেষে ত্যক্ত বিরক্ত ক্লফ যোগ দেন রাইভাল ক্লাব সান্ডারল্যান্ডে। সান্ডারল্যান্ডের হয়েও ৭৪ ম্যাচ খেলে করেন ৬৩ গোল!

image_search_1584771326302

কিন্তু এরপরই ঘটে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে নির্মম ঘটনা। মারাত্মক হাঁটুর ইঞ্জুরিতে পড়েন ক্লফ। দুই বছর পর ইঞ্জুরি কাটিয়ে মাঠে ফিরে মাত্র তিনটি ম্যাচ খেলতে পারেন। তারপর আবার হানা দেয় সে ইঞ্জুরি। আর এগিয়ে নিয়ে জেতে পারেননি তার খেলোয়াড়ি জীবন কে। সময়ের অন্যতম সেরা এ স্ট্রাইকার কে ক্যারিয়ার শেষ করতে হয় মাত্র ২৯ বছর বয়সে। আর এ সময়েই গড়ে ফেলেন রেকর্ড। ইংলিশ লিগে ২০০ এর বেশি গোল করা খেলোয়াড়দের মধ্যে ম্যাচ প্রতি গোলের হিসেবে .৯১৬ গোল নিয়ে এখন অবধি ক্লফের অবস্থান শীর্ষে।

এরপর শুরু হয় তার কোচিং ক্যারিয়ার। শুরুটা করেন চতুর্থ বিভাগের ক্লাব হার্টলপুলস ইউনাইটেডে। আর সহকারী হিসেবে নেন পিটার টেলর কে। টেলর ছিলেন ক্লফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, মিডলসব্রোতে একসাথে খেলার সময় থেকেই বন্ধুত্ব তাদের।

দুইবছর হার্টলপুলস কে কোচিং করানোর পর ১৯৬৭ সালে দায়িত্ব নেন দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাব ডার্বি কাউন্টির। এখানেই সাফল্য আসতে শুরু করে। দায়িত্ব নিয়েই নতুন ভাবে দলকে সাজিয়ে ফেলেন ক্লফ। ফলাফল হাতেনাতে। পরের মৌসুমেই প্রায় একদশক পর দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে উন্নীত হয় ডার্বি।

শুধু উন্নীত করেই থেমে থাকেননি। পরের দুই মৌসুম ডার্বি শেষ করে চতুর্থ ও নবম হয়ে। তবে তৃতীয় মৌসুমে এসে সবচেয়ে বড় জাদুটা দেখান ক্লফ। কয়েক বছর আগে দ্বিতীয় বিভাগে ধুঁকতে থাকা ডার্বি কাউন্টি জিতে নেয় প্রথম বিভাগের শিরোপা।

কর্তৃপক্ষের সাথে সম্পর্কের অবনতির জেরে ১৯৭৩ সালে ডার্বির দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপর অল্প কিছুদিন কোচিং করান ব্রাইটন ও লিডস ইউনাইটেড কে। অতঃপর ১৯৭৫ সালে ক্লফ দায়িত্ব নেন নটিংহ্যাম ফরেস্টের।

image_search_1584771629733

নটিংহ্যাম ফরেস্ট তখন দ্বিতীয় বিভাগে ধুঁকতে থাকা ক্লাব। প্রথম বিভাগের কথা চিন্তা করাও তাদের জন্য ছিলো অলীক কল্পনা। ক্লফ দায়িত্ব নিয়েই দলকে সাজানো শুরু করেন। দ্বিতীয় মৌসুমে তার সাথে সহকারী হিসেবে যোগ দেন বন্ধু টেলর। টেলর ছিলেন খাঁটি জহুরি। পুরো ইংল্যান্ড ঘুরে ট্যালেন্ট যোগাড় করতেন তিনি। তার হাতেই উঠে আসে পিটার শেলটন, ট্রেভর ফ্রান্সিস, জন ম্যাকগভেনের মতো বেশ কিছু কিংবদন্তি। অবশেষে তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯৭৭ সালে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয় ফরেস্ট।

এইবার শুরু হয় নটিংহ্যাম ফরেস্টের রূপকথা। প্রথম বিভাগে এসেই সবাইকে টেক্কা দিতে শুরু করে তারা। এবং পুরো মৌসুম জুড়েই চলে তাদের জয়জয়কার। শেষে সেবারই জিতে নেয় লিগ শিরোপা, তাও আবার দ্বিতীয় হওয়া লিভারপুলের সাথে ৭ পয়েন্ট ব্যবধান রেখে।

পরেরবার ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে তারা ইউরোপিয়ান কাপের (বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লিগ) শুরুতেই হারায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল কে। এটাকে সবাই অঘটনই ধরে নেয়, কারণ ইউরোপে তখনও ফরেস্ট একদমই অপরিচিত দল। কিন্তু ফরেস্টের কোচ যে একজন জাদুকর। ক্লফের জাদুতে সব জায়ান্টদের হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় ফরেস্ট।

সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ হয়ে আসে তৎকালীন জার্মান জায়ান্ট ওয়ান এফসি কোলন। নিজেদের মাঠে প্রথম লেগে শুরুতে দুই গোলে পিছিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত ৩-৩ গোলে ড্র করতে সক্ষম হয় ক্লফের দল। দ্বিতীয় লেগে ক্লফের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে জার্মানি থেকে ০-১ গোলে জিতে আসে ফরেস্ট। ম্যাচের নায়ক অবশ্য ছিলেন গোলকিপার পিটার শেলটন, অসংখ্য অতিমানবীয় সেভ করে ফরেস্ট কে সেভ করেন তিনি।

এবার বেশ ভালোভাবেই সবার নজর কাড়েন ক্লফ ও ফরেস্ট। স্প্যানিশ এক বিখ্যাত পত্রিকা তাকে টোটাল ফুটবলের জনক রিনাস মিশেলের উত্তরসূরি আখ্যা দেয়। অবশেষে ফাইনালে মুখোমুখি হন সুইডিশ জায়ান্ট মালমোর। কিন্তু ক্লফের দলের কাছে কোনো বাধাই আর বাধা নয়। ফ্রান্সিসের একমাত্র গোলে মালমোকে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইউরোপসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করে ফরেস্ট। গণমাধ্যম এ অর্জন কে অভিহিত করে "দ্য মিরাকল অব নটিংহ্যাম ফরেস্ট" নামে।

image_search_1584770154878

পরের মৌসুমেও সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখে ফরেস্ট। আবারও পৌঁছে যায় ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে। তবে সেবার বেশ কঠিন অবস্থায় পড়েছিলো ফরেস্ট। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর সেই ফাইনালে ছিলেন না আগেরবারের জয়ের নায়ক ফ্রান্সিস। কিন্তু ফ্রান্সিস না থাকলে কি হবে, ফরেস্ট তো ততদিনে পরিপক্ব পূর্ণাঙ্গ দল। রবার্টসনের একমাত্র গোলে হামবুর্গ কে হারিয়ে আবারও শিরোপা ঘরে তোলে নটিংহ্যাম ফরেস্ট। পরপর দুইবার ইউরোপসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করে ক্লফের দল।

এরপর থেকেই আস্তে আস্তে অবনতি শুরু হয় ফরেস্টের। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মৌসুমেও তারা লিগ শেষ করে পঞ্চম হয়ে। তারপর আরও নিচে নামতে থাকে দল। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় দল ছাড়ে। বেশ কিছু সমস্যার জেরে ১৯৮২ সালে দল ছাড়ে ক্লফের বহুদিনের সঙ্গী টেলর।

আরও বেশ কয়েক বছর ফরেস্টের হাল ধরে ছিলেন ক্লফ। শেষ দিকে এসে আরও একবার দল গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে লিগ কাপ জেতে ফরেস্ট। কিন্তু আগের মতো অবস্থায় আর ফিরে জেতে পারেননি। শেষে ১৯৯৩ সালে এসে ফরেস্ট রেলিগেটেড হয়ে যায় দ্বিতীয় বিভাগে। ক্লফও ইতি দেন তার কোচিং ক্যারিয়ারের।

image_search_1584770349261

ক্লফ যাওয়ার পর ফ্রাঙ্ক ক্লার্কের হাত ধরে আবারও প্রিমিয়ার লিগে ব্যাক করে ফরেস্ট। কিন্তু তেমন সাফল্য আর আসেনি। অবশেষে ১৯৯৯ সালে আবারও রেলিগেটেড হয়ে যায় দল।

তারপর আর ফিরে আসতে পারেনি ফরেস্ট। একবিংশ শতাব্দীতে এখন অবধি একটি বারের জন্যও আসতে পারেনি প্রিমিয়ার লিগে। তাদের সফলতার গল্প এখন শুধুই ইতিহাস।

হারিয়ে গেছে সেই বিশ্বজয়ী নটিংহ্যাম ফরেস্ট, হয়ে গেছে রূপকথা। কিন্তু এ রূপকথাই এখনো প্রেরণা যোগায় লিস্টার সিটির মতো দলগুলোকে নতুন নতুন ইতিহাস রচনা করতে। আর নতুন নতুন ইতিহাসে নতুন নতুন রঙ ধারণ করে এ খেলা। এজন্যই তো ফুটবল এতটা সুন্দর!