• ফুটবল

দিদিয়ের দ্রগবাঃ কিংবদন্তির চেয়েও বেশি কিছু

পোস্টটি ২০৩৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

লিখাটা একজন ফুটবলারকে নিয়ে তবে তার আগে একটি উদাহরন দিয়ে কিছু জিনিস বুঝিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।ক্রিকেট পাগল জাতি আমরা, আমাদের কাছে মাশরাফির মূল্যায়ন কি? আবেগ দিয়ে হোক বা ক্রিকেটীয় যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করা হোক, আমরা শব্দ সংকটে  পরে যাই বিভিন্ন সময়। পাশের দেশ ভারতে শচীন তো রীতিমতো ক্রিকেট ঈশ্বর। সম্মানের সর্বোচ্চ চূড়ায় যার অবস্থান।       

আজকে ঠিক এমনই একজন ফুটবলারের গল্প বলবো যিনি ফুটবল মাঠের সবুজ গালিচায় অনিন্দ্য সুন্দর সব মূহুর্তই শুধু উপহার দেন নি বরং দিয়েছেন একটি জাতিকে স্বাধীন ভাবে বেচে থাকার পূর্ন আস্বাদন। 

 দিদিয়ের দ্রগবা! আইভরিকোস্টের সাবেক একজন ফুটবলারের নাম। জাতির কাছে যার অবস্থান পরম ভালোবাসার জায়গায়,আর জনপ্রিয়তাতো আকাশচুম্বী।  

২০০৬ জার্মান বিশ্বকাপে  আফ্রিকান প্রতিনিধি হিসেবে প্রথমবারের মতো জায়গা করে নেয় দ্রগবার আইভরিকোস্ট। পুরোদল উন্মাতাল,পুরো জাতি দিশেহারা। আর হবেই বা না কেনো? ২০০২ থেকে যে দেশ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে দিন কাটাচ্ছে সেই দেশের এমন সাফল্যেতো বাধ ভাংগবেই।     

দিদিয়ের তখন দলটার অধিনায়ক। সুযোগটা নিয়েই নিলেন তিনি। ম্যাচ জয়ের পর পুরো দলের সবাইকে নিয়ে হাত জোর করে নেতাদের কাছে আর্জি জানালেন "  এই দিনটায় ভিক্ষা চাচ্ছি আপনাদের কাছে। মুক্তি দিন আমাদেরকে,আমরা মুক্তি চাই।আমাদেরকে আনন্দে বাচতে দিন। নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। এবার অস্ত্রটা নামিয়ে ফেলুন। "  অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি দ্রগবার সেই অনুরোধে সাড়া দিয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতারা। ৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা সেই রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দাড়ি টানা হয় সেদিনই।        

পরিবারের সবাই কোনো না কোনোভাবে ফুটবলের সাথে যুক্ত ছিলেন।সে হিসেবে দ্রগবার ফুটবলে আসাটা মোটেও অবাক করার বিষয় ছিলো না।  তবে ফুটবলে এসে ঠিক কতোটা আলো ছড়াতে পারবেন সেটা নিয়ে একটু সন্দেহ ছিলো সবার মনে। আর সন্দেহেরও যথেষ্ট কারন ছিলো। 

আলসেমি,শারীরিক,মানসিক ওযুহাতে অনুশীলন বাদ দিতেন প্রায় সময়ই। ১৫ বছর বয়সে পরিবার নিয়ে পাড়ি জমান ফ্রান্সে। সেখানকার ২য় সারির দল  লে মান্সেতে যোগ দেন। ২১ বছর বয়সে অভিষেক হয় যুবদলে। মুলদলে জায়গা পাওয়ার বছর কোনো গোল পাননি বরং ইঞ্জুরিতে কাটাতে হয়েছিলো দীর্ঘসময়। ইঞ্জুরি কাটিয়ে ফিরে এসে ম্যাচ খেলেন ১৬ টি যাতে গোল সংখ্যা মাত্র ৩। দল পাল্টিয়ে যোগ দেন 'গুইনগাম্প' নামক একটি দলে, সে দলের হয়ে ৩৪ ম্যাচে ১৭ গোল করে উত্থানের জানান দেন। পরবর্তীতে প্রথম সারির ক্লাব মার্সেইয়ে যোগ দিয়ে গোল করেন ২৪ টি আর তাতেই মরিনহোর টার্গেটে পরিণত হন।    

আনকোরা কোনো খেলোয়াড়ের জায়গা ইংলিশ প্রিমিয়ারলীগ নয়। তবে একগুয়ে মরিনহোর কল্যানেই সেবার চেলসির জার্সি গায়ে জড়ান দ্রগবা। অবশ্য সেজন্য মরিনহোকেও সহ্য করতে হয়েছে অনেক তীর্যক মন্তব্য। 

  দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সে বছরই দুবার ইঞ্জুরিতে  পরেন তিনি তবে ফিরে এসে নিজের প্রথম উপহার হিসেবে চেলসিকে দেন ৫০ বছরের আরাধনার  চ্যাম্পিয়নস লীগ ট্রফি।    

সময়ের স্রোতে ল্যাম্পার্ডের সাথে জুটি বেধে চেলসির শোকেজের খালি পরে থাকা জায়গা গুলো ট্রফি দিয়ে পূরন করতে থাকেন একে একে। দ্রগবা ছিলেন ক্রাইসেস ম্যান। দল হারতে যাচ্ছে বা সমতায় ফেরানো প্রয়োজন কিংবা দলের জয়সূচক গোল বেশিরভাগ সময়ই দ্রগবার পা থেকেই আসতো। ২০০৬/০৭ মৌসুমে লীগ কাপ ফাইনালের দুই গোল বা এফ এ কাপ ফাইনালের সেই জয়সূচক গোল যেনো তারই প্রমাণ।        

২০০৬/০৭ মৌসুম দ্রগবার ক্যারিয়ারের সোনালী সময় বলা চলে।  সব মিলিয়ে ৩৩ গোল এবং শুধুমাত্র প্রিমিয়ার লিগেই ২০ গোল করে সেবার গোল্ডেন বুট নিজের করে নেন। ২০০৭ সালে আইভরিকোষ্ট এর সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন।    সে-বছরই স্যামুয়েলন ইতো এবং  মাইকেল এসিয়েনকে পেছনে ফেলে আফ্রিকার সেরা ফুটবলার হিসেবে নির্বাচিত হন।  

চেলসির সংগ্রহে যে ট্রফি গুলো আছে তার বেশিরভাগই এসেছে দ্রগবার মায়াবী ফুটবলের কল্যানেই। ব্লুজদের হয়ে সম্ভাব্য সব ট্রফিতেই চুমু একে দিয়েছেন দিদিয়ের দ্রগবা। ক্লাবটির হয়ে সব মিলিয়ে করেছেন ১৬৪ টি গোল। যা কোনো বিদেশি ফুটবলার হিসেবে   ইতিহাসে সর্বোচ্চ।  

২০১২ সালে ব্লুজদের পক্ষে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে উয়েফার ফাইনালে ট্রাইবেকারে নেওয়া ম্যাচের শেষ শটটি ছিলো চেলসির ক্যারিয়ারে দ্রগবার শেষ শট!  আর হ্যা সে ট্রাইবেকারের গোলে চেলসির জয় নিশ্চিত হয়।         

তারপর চীনের সানহাই শেংহুয়া,তুরস্কের গ্যালতাসারের হয়েও বুদ করে রেখেছিলেন ফুটবল সমর্থকদের।গ্যালতাসারে তো দ্রগবাকে 'সেভিয়র' উপাদিও দিয়ে দিয়েছিলো৷ 

 ক্লাব ফুটবলের পাশাপাশি দ্রগবা জাতীয় দলেও ছিলেন দুর্দান্ত। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলা আফ্রিকান দেশটর অধিনায়ক ছিলেন দ্রগবা।     দ্রগবার নেতৃত্বেই নেশন্স কাপের ফাইনালে উঠে আইভরিকোস্ট।   ০৮ সালে আবারও নেশন্স কাপ কিংবা দশের বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া আইভরিকোস্টের ত্রাতা ছিলেন দ্রগবা। ১২ সালের নেশন্সকাপের ফাইনালে নিতান্ত দূর্ভাগ্যবশতই হেরে যায় দলটি। সে ম্যাচে জাম্বিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টি পেয়েও মিস করেন দ্রগবা৷ 

  সেই গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার দুইবছর পর আবারো অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা দেখা দেয়। ফুটবল মাঠের ক্রাইসেস ম্যান আবারো এখানে দাঁড়িয়ে গেলেন দেশটাকে বাচাতে৷ প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করে বিদ্রোহীদের এলাকায় একটি ম্যাচের আয়োজন করান। ম্যাচের পূর্বে জাতীয় সংগীত গাইবার সময় বিরোধী দুই নেতা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যখন বুকে হাত দিয়ে গান গাইলেন,তখন যেনো নতুন আইভরিকোস্টের জন্ম হচ্ছে। চোখের কোণে জল জমিয়ে রাখা দ্রগবা তখন হিসেব মিলিয়ে দেখছেন- "না! পুরো জীবনে আমি এর চেয়ে বেশি তৃপ্তি  কখনোই পাই নি। " 

চকলেট,কফিশপ থেকে জুতার দোকান দেশটির প্রতিটি জিনিসে দ্রগবার ছবি। ফুটবল মাঠের ত্রাতা, ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন দেশটির দুঃসময়ে। দুঃসময়কে পেছেন ফেলে দেশটির অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান সবুজ গালিচায় শিল্প আকা দিদিয়ের দ্রগবার। 

  মাঠের ফুটবলে আলো ছড়িয়েছেন,সর্বত্র শান্তির বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন ।  ফুটবলার পরিচয় ছাপিয়ে তিনি বনে গিয়েছেন  একজন নেতা,একজন আইকন,একজন কিংবদন্তির চেয়েও বেশি কিছু। 

  অনিন্দ্য ফুটবলের জাদুতে বুদ করে রেখেছিলেন ক্যারিয়ারের পুরোটা সময়। দ্রগবা নামটি আফ্রিকান কিশোরদের কাছে হয়ে গিয়েছে আবেগ, ভালোবাসার সমার্থক।   যে নামটি আফ্রিকার দেশটির সবার হৃদয়ও মন্দিরে থাকবে চিরো অম্লান।।