• ফুটবল

দিনহোঃ সবুজ গালিচার শৈল্পিক যাদুকর

পোস্টটি ১৩৪৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

inbound6524320101821209594পুরো নাম রোনালদো ডি এসেইস মোরেইরা, ডাক নাম গাউচো,ফুটবলীয় নাম রোনালদিনহো।

 

রোনালদিনহো ! !

 

পাঠকরা নিশ্চয়ই এখন নড়ে চড়ে বসবেন!  

জ্বী পাঠক, আজকের গল্প এমন একজন ফুটবলারকে নিয়ে যিনি তার সময়ে রাজত্ব করেছেন ফুটবল বিশ্বে,যার নান্দনিক খেলায় বুদ হয়েছিল ফুটবল দুনিয়া, নিজ পক্ষ তো বটে যার খেলায় মুগ্ধ হয়েছিলো প্রতিপক্ষ দল-প্রতিপক্ষের সমর্থক। 

এমন না যে তিনি যে সময়টাতে খেলতেন সে সময় অন্য কোনো প্লেয়ার  প্রতিপক্ষের রক্ষন দুমড়ে মুচড়ে দিতো না কিংবা এমনও না যে এই দিনহো'ই রাজত্ব করে গেছেন ফুটবলে যুগের পর যুগ। কিন্তু তারপরেও নিজের ফুটবলীয় কারুকার্যে আলাদা জায়গা করে নিয়েছিলেন কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ে,রাঙিয়ে দিয়েছেন পুরো একটি জেনারেশনের শৈশব। 

 

১৯৮০ সালের ২১ শে মার্চ ব্রাজিলের পোর্তো আলেগ্রীতে জন্ম গ্রহণ করেন রোনালদিনহো।

নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার হলেও রোনালদিনহোর বাবা ছিলেন স্থানীয় এরিয়ার একজন ফুটবলার,বড় ভাই স্থানীয় ক্লাব গুলোতে ফুটবল খেলে বেশ সুনামও কুড়িয়েছিলেন। তাই বলা যেতে পারে রোনালদিনহোর জন্ম একটি ফুটবলীয় পরিবারে। যেই কারনে রোনালদিনহো নিজেও বেশ গর্ব করতেন।

বস্তি এলাকায় জন্মগ্রহণ করার কারনে ঘাসের মাঠ ছিলোনা,তাই বালুর মাঠেই ফুটসালের মাধ্যমেই ফুটবল টাকে আয়ত্ব করেন রোনালদিনহো।

বলের উপর দারুন নিয়ন্ত্রণ রাখার ক্ষমতা সেখান থেকেই শুরু। ৮ বছর বয়সেই একটি ক্লাবে প্রথম যোগ দেন,অন্যান্য সতীর্থের তুলনায় তিন ছিলেন কম বয়সী,যার কারনে সেখানেই কোনো একজন সতীর্থ তার নাম দেন রোনালদিনহো।

১৩ বছর বয়সে স্থানীয় একটা ক্লাবের হয়ে তিনি একটি ম্যাচে একাই ২৩টি গোল দেন।  তার দল ও জিতে ২৩-০ গোলের বিশাল ব্যাবধানে।

 তখন থেকেই রোনালদিনহো ব্রাজিলের সবচেয়ে উঠতি প্রতিভা হিসেবে সব আলো নিজের দিকে নিয়ে আসেন

 

১৯৯৭ সালে ব্রাজিলের অনুর্ধ ১৭ দলের হয়ে যুব বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন,দলকে চ্যাম্পিয়ন করার পাশাপাশি নিজে হন টুর্নামেন্ট এর সেরা ফুটবলার। 

এর পর ব্রাজিলের ফুটবল ক্লাব গ্রামীওতে যোগ দেন রোনালদিনহো। 

১৯৯৯ সালে জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে লাটভিয়ার বিপক্ষে,অভিষেক ম্যাচে করেন ২ গোল।

একই বছর কোপা আমেরিকায় ব্রাজিল দলে চান্স পেয়ে যান রোনালদিনহো,সেই টুর্নামেন্ট জেতাতে ব্রাজিলকে দারুন ভাবে সাহায্য করেন তিনি। ১৯ বছর বয়সেই পেয়ে যান ব্রাজিলের হয়ে শিরোপা জয়ের স্বাদ।

একই বছর ফিফা কনফেডারেশন কাপে একের পর এক গোল করে দলকে নিয়ে যান ফাইনালে, ফাইনালে উঠার পথে প্রত্যেকটি ম্যাচেই গোল পান রোনালদিনহো। এর মাঝে সৌদি আরবের বিপরীতে করে বসেন হ্যাট্রিক।

টুর্নামেন্ট এর প্রতিটি ম্যাচে গোল পাওয়া রোনালদিনহো গোল পেতে ব্যার্থ হন ফাইনাল ম্যাচে,ব্রাজিলও হেরে যায় মেক্সিকোর সাথে ফাইনালে। দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেখিয়া রোনালদিনহো জিতে নেন গোল্ডেনবল এবং গোল্ডেন বুট।

 

২০০১ সালে গ্রামীও থেকে ফ্রেঞ্চ ক্লাব পি এস জিতে যান রোনালদিনহো। 

পি এস জিতে  কখনো সাইড বেঞ্চে আবার কখনো একাদশে জায়গা পাওয়া রোনালদিনহোর খেলার অভিজ্ঞতা ছিলো মিশ্র।

এরই মধ্যে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সার নজরে পড়েন। ৩২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে পিএসজি থেকে বার্সায় পাড়ি জমান তখনকার সেনসেশন ।

 

২০০২ সালে ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ দলে ডাক পান।

রোনালদো,রিভালদো এবং রোনালদিনহো এই ত্রয়ী তখন যেকোনো দলের জন্যই আতংক,ফুটবল বিশ্বে এরকম আক্রমণ ভাগ আদৌ দেখা গেছে কিনা সেটা নিয়ে চাইলে গবেষণা করতেই পারেন৷  বিশ্বকাপের পূর্বে এই ত্রয়ীর দারুন নৈপুন্যে কোপা আমেরিকা জিতে নেয় ব্রাজিল। স্বভাবতই বিশ্বকাপে প্রত্যাশার পারদ একটু বেশিই ছিলো এই ত্রয়ীর উপর। 

রোনালদিনহো করেন ৫ ম্যাচে ২ গোল।

টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ড এর বিপক্ষে ৪০ গজ দূর থেকে নেওয়া সেই ফ্রি কিকের অনন্য,অসাধারন গোলটি ফুটবল ইতিহাসে সেরা গোল গুলোর শীর্ষেই থাকবে। অবশ্য চোখের পলক আটকে রাখা এরকম অনেক গোলই আমাদের শৈশব রাঙিয়েছে দারুন ভাবে।  ফাইনালে জার্মানিকে হারিয়ে

নিজের প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফিতে চুমু দেওয়ার সৌভাগ্য হয় রোনালদিনহোর। এটাকে রোনালদিনহোর সৌভাগ্য না বলে ট্রফির সৌভাগ্যও বলা যায়। 

 

রোনালদিনহোর ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা কাটে বার্সোলনার হয়ে। অনিন্দ্য, অসাধারণ সব খেলা উপহার দিয়ে তিনি হয়ে উঠে  বার্সার প্রান ভোমরা। যেই পথে বার্সা এখনো ছুটছে দুরন্ত গতিতে। 

হতাশাগ্রস্থ বার্সাকে দেখিয়ে দেন আলোর পথ,যেই পথে বার্সা এখনো ছুটছে দুরন্ত গতিতে। অনবদ্য পারফরম্যান্সের সুবাদে ২০০৫ সালে অর্জন করেন ব্যালন ডি ওর। আর ২০০৬ সালে দীর্ঘ ১৪ বছর পর বার্সাকে জেতান চ্যাম্পিয়নস লীগ। 

সবমিলিয়ে কাতালান ক্লাবের হয়ে ১৪৫ ম্যাচে করেন ৭০ গোল। বর্তমানে দুর্দান্ত খেলা লিওনেল মেসি বার্সায় প্রথম দিকে সংগী হিসেবে পেয়েছিলেন দিনহো কে। যেখানে মেসি অকপটে স্বীকার করেন তার ক্যারিয়ারে দিনহোর অবদান অসীম।

 

২০০৬ এর বিশ্বকাপ রোনালদিনহো কখনোই মনে রাখতে চাইবেন না,মনে রাখতে চাইবে না কোনো দিনহো প্রেমী। সেই আসরে গোল শুন্য থাকতে হয় এই ফুটবলারকে।

 

এরপর থেকেই রোনালদিনহোর ফর্ম পড়তির দিকে,উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন এর দিকে ঝুকে পড়েন তিনি।  ফুটবলকে তিনি যতটা দিয়েছেন তা হয়তো যথেষ্ট কিন্তু একজন রোনালদিনহো যে সম্ভাবনা,অমিত প্রতিভার জানান দিয়েছিলেন শুরুতে সেই সম্ভাবনা শুধু সম্ভাবনাই রয়ে গেলো।

 

দুংগার করা ২০১০ বিশ্বকাপে জায়গা পান নি। তবে ২০১০/১১ সালে এসি মিলানের হয়ে দারুন পারফর্ম করে শিরোপা জিতে জানান দেন ফুটবলকে চাইলে এখনো অনেক কিছুই দিতে পারেন তিনি।

কিন্তু অতি জনপ্রিয়তার চাপ সামলাতে না পেরে ফুটবলকে উপেক্ষা করে উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনকেই বেছে নেন। ক্যারিয়ারকেও বেশি দীর্ঘ করতে পারেননি।

২০১০ এর বিশ্বকাপের পর থেমে থেমে কয়েকবার সুযোগ পেয়েছিলেন জাতীয় দলে, কিন্তু স্কলারির দেওয়া ২০১৪ বিশ্বকাপের বহরে থাকতে পারেননি। রোনালদিনহোর জাতীয় দলের ক্যারিয়ারের 

বিদায় ঘন্টা মূলত  তখন ই বেজে যায়। 

 

২০১৫ সালে পেশাদার ফুটবলে তাকে শেষবারের মতো দেখা যায়। শেষমেশ ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়ে দেন বুট জোড়া দুটো তুলে রাখছেন।

 

এরপর থেকে কখনো সবুজ গালিচায় বাবরি চুলে মাঠ মাতানো সেই দিনহোকে দেখা যায় নি কোনো প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে ।

নান্দনিক সব পায়ের কারুকার্যে যিনি একের পর এক মুগ্ধ করে চলতেন,সবুজ মাঠে যার পায়ের আকিবুকিতে বুদ হয়ে থাকতো কোটি কোটি ফুটবল প্রেমী, শৈশবে ফুটবলকে প্রেম বানানোর কারিগর, চোখের পলক থমকে দেওয়া সেই সব গোলের নিখাঁদ শিল্পী। 

শৈল্পিক ফুটবল দিয়ে যিনি মন জয় করেছিলেন আলোচক-সমালোচক সবার। সেই রোনালদিনহো নামটা এখনো অনেকের কাছে আবেগের একটা নাম।

জাগো বণিতার এই শৈল্পিক যোদ্ধা যেখানে,যেভাবেই আছেন ভালো থাকুন।