• ফুটবল

মিলানের “জার্সি নং ৯” – অভিশাপ নাকি দুর্বহতা?

পোস্টটি ২৮৮১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

এসি মিলান! ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সফল এক দল! ইতালির লীগে ১৮ শিরোপাই নয় কেবল, ৭ বারের ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট তাদের করেছে ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক দল! অথচ গত এক দশক কি বাজে সময়ই না পার করছে এই ক্লাবটি!

দশকের শুরুর দিকে সেই ২০১১ সালে সবশেষ লিগ জিতেছিল এসি মিলান। ইব্রাহিমোভিচ, থিয়াগো সিলভা, ক্লারেন্স সিডর্ফ, আলেসান্দ্রো নেস্তা, আন্দ্রেয়া পিরলো, রবিনহোদের নিয়ে দলটা তখন নতুন দশকে আবারও ইতালিতে নিজেদের রাজত্ব করার স্বপ্ন দেখছিল যেনো, অথচ ঘুণাক্ষরেও কি তারা ভেবেছিল, এই দশকে কেবল বেদনাই সঙ্গী হবে তাদের!?

গত এক দশকে এসি মিলানের দুঃসহ এক অতীতের মাঝে আলাদা ভাবে সমর্থকদের অনেক বড় এক আফসোসের জায়গা তৈরি হয়েছে তাদের "জার্সি নং ৯" ঘিরে!

মিলানের বিশ্বকাপ জয়ী ইতালিয়ান স্ট্রাইকার ফিলিপ্লো ইনজাঘি অবসর নেন ২০১২ সালে। এরপরে অন্তত ৯ জন মিলানের এই জার্সিটি গায়ে জড়িয়েছেন, অথচ গত ৮ বছরে মিলানের ৯ নাম্বার জার্সি পরিহিত খেলোয়াড়দের পায়ে এসেছে মাত্র ২৯ গোল! অবস্থা কতটা নাজুক তার ধারণা দেওয়ার জন্যে ছোট্ট একটা তুলনা দেয়া যায়; কেবল চলতি মৌসুমেই লাজিও স্ট্রাইকার ইমোবিলের পায়ে এসেছে ২৭ টি গোল!

সময় যত গড়িয়েছে, ততই এই প্রশ্নটি কঠিনতর হয়েছে - এসি মিলানের ঐতিহ্যবাহী ৯ নাম্বার জার্সিটির তবে কি হলো! মিলানের "জার্সি নং ৯" কি তবে অভিশপ্তের খাতায় নাম লেখালো!?

ক্রিস্টফ পিয়াটেক, এই পোলিশ স্ট্রাইকারের কথাই বলা যাক; জেনোয়ার হয়ে ১৮-১৯ মৌসুমে অসাধারণ সময় কাটিয়ে ২০১৯'র জানুয়ারিতে মিলানে যোগ দেন৷ এসময় ক্লাবের অনেকেই পিয়াটেককে ৯ নাম্বার জার্সি গায়ে তুলে দেওয়ার কথা জানান, কিন্তু সেইসময় ক্লাব ডিরেক্টর লিওনার্দো জানান, মিলানের ”জার্সি নং ৯” এমন একটি জার্সি যা কিনা অর্জন করে নিতে হয়! লিওনার্দোর আপত্তির কারণে উক্ত সিজনে পিয়াটেকের আর ৯ নাম্বার জার্সি গায়ে চড়ানো হয়নি। পিঠে নাম্বার ১৯ চাপিয়ে অর্ধেক সিজনে ক্লাবের হয়ে ৯ টি গোল করেন পিয়াটেক। ফলস্বরূপ নতুন সিজনেই পিয়াটেকের হাতে তুলে দেওয়া হয় ঐতিহ্যবাহী "জার্সি নং ৯”! ঠিক তখনই পিয়াটেক যেনো গোল করতেই ভুলে গেলেন! উক্ত মৌসুমের অর্ধেক সময়ে প্রতিপক্ষের জালে বল ঢুকিয়েছেন মাত্র ৪ বার! যার দরুন অর্ধেক সিজন পেরুতেই ফ্লপ পিয়াটেককে হার্থা বার্লিনের কাছে বিক্রি করে দেয় মিলান।

ফেলিপ্পো ইনজাঘি অবসরের পর থেকে ফ্লপ নাম্বার ৯ এর তালিকায় আছেন অনেকেই; এমনকি ফার্নান্দো তোরেস কিংবা গঞ্জালো হিগুয়েইনের মতো পরিক্ষিত স্কোরার'রাও ব্যর্থ মিলানের এই "জার্সি নং ৯" গায়ে জড়িয়ে!

গল্পের শুরুটা করা যায় ফুটবল বিশ্বের এক আক্ষেপের নাম আলেক্সান্ডার পাতো কে দিয়ে। অসম্ভব সম্ভাবনা নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা পাতো মিলানের "জার্সি নং ৯" গায়ে জড়ান ২০১২ সালে! ঠিক তারপর থেকেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকেন তিনি। ব্যর্থ সময় পার করতে থাকা পাতো মিলান থেকে করিন্থিয়ান্সে চলে যান।

আলেসান্দ্রো মাত্রি, এই ইতালিয়ান ২০১৩ সালে জুভেন্টাস থেকে মিলানে আসেন। ১৫ লিগ ম্যাচে গোল পেয়েছিলেন মাত্র ১ টি। এরপরই ফিওরেন্টিনা তে চলে যান তিনি।

এর পরের সিজনে ২ জন খেলোয়াড় মিলানের জার্সি নং ৯ গায়ে জড়িয়েছিলেন, উক্ত সিজনে মিলানের "জার্সি নং ৯" এর পায়ে এসেছিলো মাত্র ৪ গোল; দুইজনের একজন ছিলেন স্প্যানিশ ফার্নান্দো তোরেস এবং ইতালিয়ান মাতিয়া দেস্ত্রো!

এরপরে শাখতার থেকে এসেছিলেন ব্রাজিলিয়ান লুইজ আদ্রিয়ানো, এসেছিলেন জিয়ানলুকা লাপাদুলা, পর্তুগালের আন্দ্রে সিলভা, এবং প্রত্যেকেই পুরোপুরি ব্যর্থ!

মিলান ফ্যানদের হৃদয়ে ততদিনে এই প্রশ্নটি গেঁথে গেছে, তবে কি মিলানের জার্সি নং ৯ কোন অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে!?

”আমি ইতোমধ্যেই অনেক ঐতিহ্যবাহী জার্সি গায়ে জড়িয়েছি, মিলানের "জার্সি নং ৯" কোন সমস্যা নয়, আশা করছি যে আমি সফল হবো!" ২০১৮'র আগস্টে জুভেন্টাস থেকে মিলানে লোনে এসে সাংবাদিকদের এভাবেই বলেছিলেন আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার গঞ্জালো হিগুয়েইন! ফলাফল, অর্ধেক সিজনে মাত্র ৬ গোল, এবং জুভেন্টাসে ফিরে যাওয়া।

ফেলিপ্পো ইনজাঘি যাওয়ার পর মাত্র ৫ জন স্ট্রাইকার ১০'র বেশি গোল করতে সক্ষম হয়েছেন - স্টেফান এল শারাওয়ে, জিয়ামপাওলো পাজ্জিনি, মারিও বালোতেল্লি, কার্লোস বাক্কা এবং প্যাট্রিক কুট্রোন; অবাক করা ব্যাপার যে তাদের কেউই জার্সি নং ৯ পরিহিত খেলোয়াড় ছিলেন না! যদিও তাদের কেউই ২০ গোলের মার্ক স্পর্শ করতে পারেননি!

মার্কো ভ্যান বাস্তেন, জর্জ ওয়াহ কিংবা ইনজাঘি'র মতো সফলতম স্ট্রাইকারের জার্সি "জার্সি নং ৯" যেনো এখন অনেকটাই ভাবশুণ্য, মিলানের পবিত্র আচ্ছাদন যেনো এখন বিষাক্ত পেয়ালায় পরিণত! যতবার একেকজন ব্যর্থ সৈনিক মিলান ছেড়েছে, ততবারই এই অভিশাপের প্রশ্ন শক্তিশালী হয়েছে!

ইতিহাসের অন্যতম সফলতম ক্লাব হিসেবে মিলানের জার্সি নং ৯ এর গুরুভার স্বভাবতই অনেক বেশি ছিলো! এসি মিলান সাম্প্রতিক সময়ে যেমন খারাপ সময় পার করছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে "জার্সি নং ৯" সম্ভবত দুর্বহ হয়ে উঠেছে মিলান ফুটবলারদের জন্যে!

অভিশাপ নাকি দুর্বহতা, মিলানের "জার্সি নং ৯" ঘিরে এত প্রশ্নের মাঝে মিলানের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কথাও অকপটে স্বীকার করতে হয়! একটা সময়ে রেকর্ড দামে খেলোয়াড় কেনা ক্লাবটি এখন ট্রান্সফার মার্কেটের বড় বড় নামের পিছনে ছুটতে পারেনা! তবুও সময়ের সাথে গত দশ বছরে প্রতিভাবান খেলোয়াড়, এমনকি পরিক্ষিত খেলোয়াড়দের হাতেও মিলান তাদের "জার্সি নং ৯” তুলে দিয়েছে! কিন্তু হয়তো কোন এক আধিদৈবিক শক্তির ফলে কেউই নিজেদের জাত চেনাতে পারেননি, সফল হয়ে উঠতে পারেননি, বরং মিলানের একজন ব্যর্থ সৈন্য হিসেবে পরিচিত হয়েছেন!


তবে কেবল "জার্সি নং ৯” কে তৈরি হওয়া মিথ'ই নয়, মিলান ফ্যানরা এখনো স্বপ্ন বুনেন, একটা সময় ক্লাবের দুরাবস্থার অবসান হবে, ট্রান্সফার মার্কেটে বাজি ধরবে, সকল প্রশ্নের অবসান ঘটবে! মিলান ফ্যানরা স্বপ্ন বুনেন কোন একজন নতুন সেনা এসে মিলানের জার্সি নং ৯’র গায়ে লেপ্টে যাওয়া "অভিশাপ" নামক দাগ মুছবে, হয়তো ইউরোপের বড় মঞ্চে আবারো মিলানের জয়োৎসবের নিশান উড়বে!