• অন্যান্য

ক্রোট- ডেনিশ বিদ্রোহের সন্ধ্যা এবং বাবা দিবস!

পোস্টটি ১৮২৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
রবিবারের এক সন্ধ্যা। রাশিয়ার নিঝনি নভগরদ স্টেডিয়ামের আলোয় শঙ্কার প্রতিটা মূহুর্ত পার করছে দুটো ভিন্ন জাতির সোনালী প্রজন্ম। রাউন্ড অফ সিক্সটিনের ম্যাচ। হারলে টিকেট ধরতে হবে বাড়ি ফেরার। কিংবা জয়ে লিখা হতে পারে নতুন কোনো কাব্য।
 
ডাগআউটে অস্থিরতায় পায়চারি করছেন দু'দলের কোচ। তবে সে অনুভূতি গায়ে মাখছেনা গ্যালারিতে বসে উন্মাদনায় ছটফট করতে থাকা মানুষেরা। সন্দেহাতীতভাবে এটা অসাধারণ একটা ব্যাপার; মাঠের খেলায় যেমন কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে রাজী নয়, তেমনি উচ্ছ্বাসিত স্রোতধারার দু'দলের ফ্যানবেজও একে অপরকে ছেড়ে কথা বলছে না।
 
যুদ্ধটা তবুও ১২০ গজের ফুটবল পিচে। ক্রোটদের সাথে ডেনিশদের যুদ্ধ হবে নিঃসন্দেহে ভয়ংকর। ম্যাচের বয়স তখন ৫৭ সেকেন্ড সবে; ক্রোটদের জালে ডেনিশরা ঢুকিয়ে দিলো বল! হতভম্ব পুরো দল। নির্বাক তাদের দর্শকেরা। খানিক সময়ের যুদ্ধ জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা ডেনিশ'রা। এ যেন যুদ্ধ বিজয়ের পূর্ব সংকেত বেজে উঠলো পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে।
 
বাংলায় একটা কথা আছে, মেঘের পরে রোদ হাসে। ক্রোটদের আকাশে সত্যিই রোদ হাসলো মিনিট তিনেক পরেই। 'তিন মিনিট' শুনলেই আমার মাথায় চলে আসে বাঁকা পায়ের জাদুকর গারিঞ্চার *গ্রেটেস্ট থ্রি মিনিটস ইন ফুটবল হিস্ট্রি*র ঘটনা। তবে এখানে আমি সেটার অবতারণা করতে যাচ্ছিনা। ক্রোট শিবিরে আনন্দের ঢেউ তুললো মানজুকিচের গোল। সে গোল রক্ষার কোনো উপায় ছিলো না ডেনিশ গোলরক্ষক স্মেইকেলের।
 
এদিকে হতাশা নেমে এলো ডেনিশ শিবিরে। আমার চোখ তখন ভিআইপি গ্যালারিতে বসে থাকা কাঁচাপাকা চুলের মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তির উপর৷ ভাবছি তার কথা। একটা সময় প্রিমিয়ারলীগে রাজত্ব করেছেন। ম্যাঞ্চেষ্টার ইউনাইটেডে ৮ বছরের ক্যারিয়ারে ট্রেবলসহ পাঁচ লীগ টাইটেলের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লীগও জিতেছেন। ডেনিশদের হয়ে চারবার সেরা গোলকিপার হয়েছেন, গোলকিপার হয়েও তিনবার জিতেছেন বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব। '৯২ এ ডেনিশদের হয়ে ইউরো জিতেছিলেন। এতসব ছাপিয়ে তার পরিচয় তার নামেই; পিটার শ্মেইকেল। এক কিংবদন্তি।
 
ক্রোটদের বিপক্ষে ডেনিশ গোলবারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা যে যুবক'কে দেখা যাচ্ছে, এটি তার ছেলে। ক্যাসপার শ্মেইকেল। লিস্টারের এই গোলকিপার এতোদিনেও কেন বাবার মতো উজ্জ্বল হতে পারলোনা, ভাবতে আমার অবাক লাগে।
 
নিঝনি নভগরদে সন্ধ্যা ফুরিয়ে যাচ্ছে। আক্রমণ পাল্টা আক্রমনে যুদ্ধের মাত্রা পরিলক্ষিত হচ্ছে, টালমাটাল পরিস্থিতিতেও কাউকে বিজয়ী ঘোষণা করা যাচ্ছেনা আপাতত। যুদ্ধের সময়সীমা তাই অতিরিক্ত সময়ে গড়ানোর নেয়ার সংকেত দিলেন কমরেড রেফারি৷
 
কবি হেলাল হাফিজ একবার বলেছিলেন, 'ভালোবাসা-বাসীর জন্য অনন্তকালের প্রয়োজন নেই, সুন্দর একটা মূহুর্তই যথেষ্ট।' ফুটবল মাঠে উক্তিটার সারমর্ম কি দাঁড়াতে পারে? উক্তিটা যেন পরিষ্কার বলছে 'ম্যাচে হিরো হতে নব্বই মিনিট ঘাম ঝরানোর প্রয়োজন নেই, কয়েকটা সেকেন্ডই যথেষ্ট!'
 
ম্যাচের বয়স তখন একশত চৌদ্দ মিনিট। ডেনিশ দুর্গের যোদ্ধাদের বোকা বানিয়ে প্রাণপণে ছুটছেন এক ক্রোট সৈনিক। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পালাচ্ছেন না; বরং যুদ্ধে ক্রোটদের পরাস্ত করতে কফিনে শেষ পেরেকটুকু ঢুকে দিচ্ছেন বৈকি! কিন্তু শেষপর্যন্ত তার রক্ষা হলোনা, ডেনিশ দুর্গের ভিতরে তাকে ফেলে দিলো এক সৈনিক। কমরেড তৎক্ষণাৎ বাঁশি বাজালেন। তার যুদ্ধক্ষেত্রে অন্যায় চলবেনা। বিপাকে পড়ে গেলেন শ্মেইকেল পুত্র! পুরো দুর্গের ভার এখন তার হাতে। মিনিট ছয়েক দূরে হয়তোবা তাদের বিজয় নিশান উড়ছে। কিন্তু এখান যেন সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো।
 
ভিআইপি বক্সে ফিরে এলাম। দেখি মানুষটা আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেছেন। আশঙ্কার ভয়ংকর থাবা গেড়ে বসেছে তার সুন্দর চেহারায়৷ হয়তো ভাবছেন, ছেলে কি পারবে জাতীকে আশঙ্কামুক্ত করতে? যদি না পারে? তাহলে কি এভাবেই আমরা যুদ্ধে হেরে যাবে এতোদূর এসে? নাহ, তিনি আর ভাবতে পারছেন না। উত্তেজনায় তার গা কাঁপছে। অপলক দু'চোখ কেবল বিঁধে আছে ডেনিশ গোলবারে। এইতো দেখা যাচ্ছে গুটিগুটি পায়ে ডেনিশদের দুর্গ ধ্বংস করে দিতে এগিয়ে আসছে ক্রোট সৈনিক মড্রিচ। কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। এক্ষুনি হয়তো কিক নিবে আর ধূলিসাৎ হয়ে যাবে ডেনিশদের যুদ্ধ কৌশল! পেনাল্টি নেয়ার জন্য প্রস্তুত হলো মড্রিচ। চাপা উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসছে বাবার; না জানি কতটা চিন্তিত আছে তার ছেলেটা। মড্রিচ শ্যুট করলো এবংং…..
 
kasper
 
মাঠিয়ে লুটিয়ে পড়লো ক্যাসপার। বাবা দাঁড়িয়ে গেলেন, দেখলেন ছেলে তার বল কোলে নিয়ে শুয়ে আছে৷ উত্তেজনায় তিনি প্রায় চিৎকার করে উঠলেন! এই না হলে আমার ছেলে! দেখো তোমরা, এটা আমার ছেলে। দেখো দেখো- আমার ছেলে পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়েছে! এ যেন বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ!
 
maxresdefault
 
শ্মেইকেল বলতেন আমার ছেলে ছোটবেলায় পড়ে থাকতো কম্পিউটার গেইমে। অথচ যখনি আমার খেলা খেলা চলতো, আমি গোল সেইভ দিতাম; সে চিৎকার দিয়ে উঠতো। আর বলতো; বাবা জিতে গেছে, বাবা জিতে গেছে!
আজ প্রেক্ষাপট ভিন্ন৷ খানিক মূহুর্তের জন্য হলেও ছেলে জিতিয়ে দিয়েছে বাবা'কে। ছেলের বদলে বাবা আজ চিৎকার করছেন মাঠে বসে!
 
ম্যাচের পরের গল্প আমরা জানি। মড্রিচের গোল সেইভ দিয়েও ট্রাইবেকারে ক্রোটদের কাছে হেরে যায় ডেনিশ সৈনিকেরা। শ্যুটআউটেও পেনাল্টি সেইভ দিয়েছে শ্মেইকেলের ছেলে। তবে দলকে যুদ্ধের ময়দানে হার থেকে রক্ষা করতে পারেনি।
 
ম্যাচ শেষে মাথা নিচু করে বাবার কাছে আসে ক্যাসপার৷ বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে নেন৷ হেরেও বাবার কাছে জিতে গিয়েছে তার সন্তান। বাবা সান্তনা দেন, আর বলেন, *সান, ইউ আর মাই চ্যাম্পিয়ন*...
 
বিশ্ব বাবা দিবসে 'হেরে যাওয়া সব সন্তানদেরকে ভালোবাসায় জিতিয়ে দেয়া বাবা'দের বাবা দিবসের শুভেচ্ছা রইলো। বাবা'রা হারেন না, তারা জিতিয়ে দেন৷
 
© আহমদ আতিকুজ্জামান।