• অন্যান্য

থিয়েরি অঁরি - তোমায় হয়তো ভালোবাসি, আবার বাসিনা!

পোস্টটি ২৭৯৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

দিনটা ছিলো ২০০৬ সালের ১ জুলাই। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল আর ৯৮'র বিশ্বজয়ী ফ্রান্স।

আমি তখন আপাদমস্তক একজন ব্রাজিল সমর্থক। বাড়ির আঙ্গিনায় ব্রাজিলের পতাকা, পরণে ব্রাজিলের জার্সি, ঘরের দেয়ালে খেলোয়াড়দের পোস্টার! ক্লাস ফোরে পড়ি, কতটুকু ফুটবল বুঝতাম মনে নেই, কিন্তু হলুদ জার্সির প্রতি ভালোবাসার যেনো কোনই কমতি নেই!

ব্রাজিল, কেবলমাত্র ব্রাজিলই জিতবে বিশ্বকাপ - ছোট্ট একটা মানুষের মনের চাওয়াটা তো ঠিক এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক! অবুঝ মনে এর বাইরে অন্যকিছু ভাবার সময় কই! আর মাত্র ৩ ম্যাচ জিতলেই প্রিয়দল বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, এই আশা বুকে বেঁধেই বসে গিয়েছিলাম সাদাকালো টেলিভিশনের সামনে, ব্রাজিল বনাম ফ্রান্সের ম্যাচ দেখতে!

খেলার তখন ৫৭ মিনিট চলছে, জিনেদিন জিদানের ফ্রী কিক থেকে দারুণ এক ভলিতে ব্রাজিলের গোলরক্ষক দিদাকে পরাজিত করলেন টাক মাথাওয়ালা ৬ ফুট ২ ইঞ্চির একটা মানুষ! নাম তার অঁরি, থিয়েরি দানিয়েল অঁরি!

download

 

মন খারাপ। বড্ড মন খারাপ। সেই ম্যাচ ব্রাজিলের আর জেতা হয়নি। ছোট্ট আমি কেঁদে বুক ভাসাচ্ছি। আমার কাছে সেই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দনীয় এবং বাজে মানুষটির নাম ছিলো অঁরি!

মাঠে অঁরি'র খেলা কিংবা মাঠের বাহিরে অঁরি'র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দুটোই এক নিদারুন স্নিগ্ধতায় মাতিয়েছে অসংখ্য ফুটবল প্রেমিককে। ফ্যান কিংবা রাইভাল; ফুটবলে অসাধারণ প্রতিভা, মাঠের নির্ভীকতা অঁরিকে রুপান্তরিত করেছে সবার কাছের এক প্রিয়পাত্রে!


প্রসিদ্ধ এবং কীর্তিমান এক ক্যারিয়ার অঁরি'র। যেখানে হেনরি নিজের নাম লিখিয়েছেন আর্সেনাল কিংবা নিজ দেশ ফ্রান্স দুদলেরই সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকার শীর্ষে। প্রিমিয়ার লীগ জিতেছেন, চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতেছেন, জিতেছেন বিশ্বকাপও! এছাড়া লালীগা, ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপও জিতেছেন অঁরি!

প্রিমিয়ার লীগের ৮ বছরের ক্যারিয়ারে নিজেকে লিজেন্ডদের কাতারে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। যার শুরুটা হয়েছিলো ১৯৯৯ সালে, যখন জুভেন্টাস থেকে অঁরিকে দলে ভিড়ান আর্সেনাল কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার। সেখান থেকে অঁরি ফিরেছেন নিজেকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের সর্বকালের সেরাদের একজন বানিয়ে!

Thierry-Henry-010

যদিও অঁরি'র শুরুটা ছিলো লীগ ওয়ানে, মোনাকোর হয়ে। বয়সভিত্তিক সব ধাঁপ পেরিয়ে ১৯৯৪ সালে প্রফেশনাল ডেব্যু হয় অঁরির। অঁরি ফ্রান্সের French football academy of Clairefontaine তে নিজের শৈশব কাটান। ফুটবলের হাতেখড়িটা সেখানেই!

অঁরির গতি, ক্লোজ কোন্ট্রল, স্কিলে আস্থা রেখে সেসময়কার মোনাকো কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার তাকে দলের উইঙ্গার হিসেবে দলভুক্ত করেন।

একজন ফুটবলার হিসেবে অঁরির নিজের প্রতিভার প্রস্ফুটন ঘটে মোনাকোতেই। শুরুর সিজনেই ফ্রান্সের ইয়ংগার প্লেয়ার অফ দা আর্থ নির্বাচিত হোন অঁরি। ঘরোয়া লীগে সুন্দর শুরুর পরে নিজের বিষ্ময়কর ফুটবল শৈলী প্রদর্শনের মঞ্চায়ন তৈরি হয় অঁরির সামনে, ৯৭/৯৮ সিজনে চ্যাম্পিয়নস লীগের আসরে দলকে একদম সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন অঁরি। দলকে সেমিফাইনালে তোলায় অঁরির অবদান ছিলো ৭ গোল! একদিকে একজন তরুণ ফ্রেঞ্চ নিজের জাত চিনিয়েছিলেন, অন্যদিকে ইউরোপের মঞ্চে মোনাকোকে আরেকটু উচ্চাসনে নিয়ে গিয়েছিলেন! এরপরে আর কখনোই অঁরি কে পিছুপা হতে হয়নি।

story-henry-0007

মাত্র ২১ বছর বয়সেই, অঁরি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ফুটবল বিশ্বের নতুন সম্ভাবনা রূপে! নামের পাশে বসিয়েছিলেন ফ্রান্সের বর্ষসেরা তরুণ খেলোয়াড়ের খেতাব, অ-২১ দলের ইউরো ট্রফি ; এমনকি অসীম প্রত্যাশার পারদ নিয়ে জাতীয় দলেও ডাক পেয়ে গিয়েছিলেন খুব দ্রুত!

তৎকালীন ফ্রান্স কোচ জ্যাকুয়েটের অত্যন্ত সাহসীকতার সহিত অঁরি কে দলে ভিড়ান। মাত্র ৪ ম্যাচ সুযোগ পাওয়ার পরেই বিশ্বকাপ দলেও অন্তর্ভুক্ত হোন অঁরি! ফ্রান্সের বিশ্বজয়ের আসরে ৩ গোল করে নিজেকে আরো একধাপ এগিয়ে নেন অঁরি!

12-35-41-EP2aunQWsAA_bk7

বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা অঁরির ক্যারিয়ারের উন্নতি ও অগ্রগতিতে বিশেষ ভুমিকা রাখে। বিশ্বকাপের পরপরই আর্সেনালে চলে যাওয়া কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার অঁরি কে পেতে চায়, কিন্তু কিছু জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি! তবে একথা সবার বোধগম্য ছিলোই যে, অঁরি আর ওয়েঙ্গারের রিইউনিয়ন কেবল সময়ের অপেক্ষা মাত্র!

এরপর মোনাকো থেকে জুভেন্টাসে যায় অঁরি, কিন্তু সিজনের শেষার্ধে নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি অঁরি। পেটিট, দেশম কিংবা জিদানের মতো জাতীয় দল সতীর্থ পেয়েও ওল্ড লেডিদের হয়ে মানিয়ে নিতে পারেননি অঁরি। অঁরির ক্যারিয়ারের হতাশাজনক অধ্যায় বলতে গেলে জুভেন্টাসে কাটানো এই ছয় মাসের কথাই উল্লেখ করা যায়! ফলস্বরূপ জুভেন্টাসের মাত্র ৬ মাস শেষেই ওয়েঙ্গারের আর্সেনালে পাড়ি জমান অঁরি!

thierry-henry-juventus_3tudd0cbtbu51fgc1wh1wtl5y

বিধাতা সম্ভবত অঁরির সেরা হওয়ার রাস্তাটা আগেই তৈরি করে রেখেছিলেন, ভাগ্যই হয়তো অঁরিকে একটা খারাপ সিজন কাটাইতে বাধ্য করেছিলো, কেনোনা পরের যাত্রাটা তো কেবল অঁরির নিজেরই নয় বরনং প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাসকে নতুন করে লেখার সূচনা তৈরি করেছিলো!

মোনাকোতে থাকাকালীন'ই ওয়েঙ্গার আর অঁরির সম্পর্ক টা মজবুত হয়, আর্সেনাল ম্যানেজমেন্ট কে শুরু থেকেই তাই অঁরি কে সাইন করার জন্যে চাপ দিতে থাকেন ওয়েঙ্গার। জুভেন্টাস ব্যর্থ অঁরিকে ক্লাব ছেড়ে দিতে চাইলেই সুযোগ লুফে নিতে আর ভুল করেনি আর্সেনাল।

অতঃপর, জুভেন্টাস থেকে একরাশ হতাশা নিয়ে ফেরা অঁরির প্রজন্মের অন্যতম সেরা একজনে রুপান্তরের শুরু।

আর্সেনালের সফলতার সমার্থক নামটি ছিলো অঁরি! দুই প্রিমিয়ার লীগ, যার একটি কিনা কোন পরাজয়ের মুখ না দেখে, যেই সিজনে ৩০ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন হেনরি! এছাড়াও ২ এফ এ কাপ ও ১ কমিউনিটি শিল্ড কাপ জিতেন অঁরি। ৮ সিজনে ৩৬৯ ম্যাচে ২২৬ গোল নিঃসন্দেহে অসাধারণত্বের পরিচয় বহন করে! ৮ সিজনের ৪ টিতেই সিজনের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন অঁরি, ২ বার হয়েছেন প্লেয়ার অফ দা সিজন খেতাব! নিজেকে আসীন করেছেন আর্সেনালের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে!

 

ছোট্ট আমি যে মানুষটাকে এত্ত বেশি অপছন্দ করি, তার সম্পর্কে যতই জানার চেস্টা করছিলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম! মামা, ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম সেসময়, অঁরি'র খেলায় অনাবিল এক মুগ্ধতা ছড়ায়। ধারাবাহিকতা, পারফরম্যান্স, মাঠ কিংবা বাইরের স্বভাব, ফুটবল শৈলী অঁরি এ প্রজন্মের অন্যতম একজন ফুটবলার!

বিশ্বকাপের ঠিক পরের সিজনেই আর্সেনাল ছেড়ে বার্সায় যান অঁরি। আমার ক্লাব ফুটবল ফলো করার শুরুটাও ঠিক সেসয়ই।

আর্সেনালে ঘরোয়া সব টুর্নামেন্ট জিতেছিলো অঁরি, কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লীগের মুকুটের ক্ষুধাই অঁরিকে বার্সায় নিয়ে যায়। ক্যাম্প নু তে এক অসাধারণ অঁরিকে চিনেছিলাম! ইতো, মেসি, অঁরিimportedImage62962_header ট্রায়ো এবং রোনালদিনহো ম্যাজিকে বার্সার ট্রেবল জয়, অঁরিকে সর্ব জয়ের স্বাদ দেয়! দুর্দান্ত অঁরিকে ততদিনে আর অপছন্দ করে থাকতে পারিনি, অজান্তেই মনের এক কোনে মানুষটার জন্যে এক ভালোবাসা জন্ম নেয়! বার্সায় সফল ৩ সিজন শেষ করে মেজর লীগ সকারে যোগ দেন অঁরি, সেখানে ৫ সিজন কাটিয়ে আর্সেনালে ফিরলেও ততদিনে অবসরের খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন অঁরি!

12-38-44-thierry-henry-samuel-eto-o-and-lionel-messi-5d2ac61668d609ab9c000001

খেলোয়াড় অঁরির সাফল্য আকাশচুম্বী! পরবর্তীতে কোচ হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও এখনো সফল হতে পারেননি! কিন্তু এখন অঁরির অত্যুজ্জ্বলতা কিংবা প্রতিভা ফুটবল বিশ্ব মনে রাখবে আজীবন!

Neymar-Brazil-World-Cup-exit-Belgium-Thierry-Henry-985151

কাকতালীয় ভাবে ২০১৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিল যেদিন বেলজিয়ামের কাছে পরাজিত হয়, সেদিন'ও প্রতিপক্ষের ডাগ আউটে সেকেন্ড এসিস্ট্যান্ট কোচের ভুমিকায় ছিলেন এই মানুষটিই! ব্রাজিলের দুঃখজনক হার আর আবারো এই মানুষটিকে দেখা আমার কাছে কেমন কস্টকর ছিলো! মনের অগোচরেই তাই বলে বসি, প্রিয় অঁরি তোমায় হয়তো আমি ভালোবাসি, আবার হয়তো ভালোবাসিনা!