• ফুটবল

মাতিয়া সিন্দেলার : কাগজের মানুষ

পোস্টটি ৫৮৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

কাগজের মানুষ

অস্ট্রো-হাঙ্গেরির চেক অংশে যখন তাঁর জন্ম হলো, তখন মাতিয়া সিন্দেলারের বাবা ইয়ান সিন্দেলার হয়তো ধরে নিয়েছিলেন ছেলে তার মতোই কামার হবে। সিন্দেলারের পরিবার যখন ভিয়েনার চেক-অধ্যুষিত ফভোরিতেন অঞ্চলে আসে, তখনও কামারের পেশাই হয়তো তার ভাগ্যে ছিল। কিন্তু ভিয়েনার রাস্তায় ফুটবল খেলতে শেখা সিন্দেলারের অসাধারণ ফুটবলীয় প্রতিভা তাকে সুযোগ এনে দেয়।

sindelar potrait

"সমর্থকরা তাঁর নাম দেয় 'ডার পাপিয়েরেন"

চৌদ্দ বছর পিতৃহারা হওয়া সিন্দেলার একবছর পর যখন হার্থা ভিয়েনার চোখে পড়েন, তখন তার ভবিষ্যত নির্ধারিত হয়ে যায়। হার্থায় কয়েকবছর খেলে এফকে অস্ট্রিয়া ভিয়েনায় যোগ দেন। সেখানে তারকা হয়ে উঠতে সময় নেন নি তিনি। হালকা-পাতলা গড়নের ছিলেন, তাই সমর্থকরা নাম দেয় 'ডার পাপিয়েরেন', বাংলায় যার অর্থ হয় কাগজের মানুষ।

সিন্দেলার নিঃসন্দেহে তাঁর সময়ের সেরাদের একজন ছিলেন। বল কন্ট্রোল, পাসিং, ড্রিবলিং আর সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি নিজেকে চিনিয়েছিলেন। সমালোচক আলফ্রেড পোলগার লিখেছেন, "তিনি সেভাবেই ফুটবল খেলতেন যেভাবে একজন গ্র্যান্ডমাস্টার দাবা খেলেন।" এফকে অস্ট্রিয়াতে তাঁর প্রথম তিন মৌসুমে তিনি তিনবার অস্ট্রিয়ান কাপ আর একবার লিগ জেতেন। নিজের খেলা দিয়ে 'ফুটবলের মোজার্ট' এর খেতাব অর্জন করেছেন 'ডাস পেপিয়েরেন'।

সিন্দেলারের অস্ট্রিয়া,অস্ট্রিয়ার সিন্দেলার

ত্রিশের দশকের শুরুর দিকে বিশ্ব ফুটবলের পরাশক্তি হয়ে ওঠে অস্ট্রিয়া। হুগো মেইসের সেই 'উন্ডারটিম'-এর আত্না ছিলেন 'ডাস পেপিয়েরেন'। অধিনায়কের আর্মব্যান্ডটাও ছিল তাঁর হাতে।

wunderteam

"সেই দলের সামনে দাঁড়াতে ভয় পেত যে কেউ"

প্রতিটি পজিশনে সেসময়ের সেরা খেলোয়াড়রা ছিলেন অস্ট্রিয়ার সেই উন্ডারটিমে। জোসেফ স্মিসতিক, জোসেফ বিকান, রুডি হিদেনদের নিয়ে গড়া সেই দলের সামনে দাঁড়াতে ভয় যে কেউ। সবকিছুর কেন্দ্রে ছিলেন সেন্টার ফরোয়ার্ড সিন্দেলার। ১৬ মে ১৯৩১ থেকে ২৩ অক্টোবর ১৯৩২ পর্যন্ত হারে নি তারা। স্কটল্যান্ড, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড সবাই লুটায় উন্ডারটিমের পায়ে। হাঙ্গেরি প্রথম দেখায় ড্র করলেও পরের দেখায় আট গোলে উড়ে যায়। ইংল্যান্ডের কাছে চৌদ্দ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড হারালেও সিন্দেলার ষোলো ম্যাচে করেছিলেন ষোলো গোল। অন্যতম ফেভারিট হিসেবে ১৯৩৪ এর বিশ্বকাপে গিয়েছিল সিন্দেলারের উন্ডারটিম।

একটি কলঙ্কিত বিশ্বকাপ

চৌত্রিশের বিশ্বকাপ ইউরোপে হবে, তা নিশ্চিত ছিল। ইতালিতে তখন স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনির সময়। ক্ষমতার জোরে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ আয়োজন করেন তিনি। বিতর্ক থাকে পুরো টুর্নামেন্টজুড়েই। আগাগোড়া নকআউট পদ্ধতির এই বিশ্বকাপে শুরুতেই বিদায় নেয় ইউরোপের বাইরের সব দল। প্রতিটি ম্যাচের রেফারি ঠিক করতো ইতালি সরকার, আর প্রতিটি ম্যাচে গ্যালারিতে থাকতেন মুসোলিনি।

ফ্রান্সকে হারিয়ে শুরু করা অস্ট্রিয়া কোয়ার্টারে দেখা পায় হাঙ্গেরির। অস্ট্রিয়ার কাছে আবার বধ হয় তারা, উন্ডারটিম চলে যায় সেমিফাইনালে, যেখানে তাদের অপেক্ষায় আছে সহজেই সব পার করে আসা ইতালি

Benito Mussolini

"ক্ষমতার জোরে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ আয়োজন করেন তিনি"

মিলানের বৃষ্টিভেজা দিনে ভিত্তোরিও পোজ্জোর আগ্রাসী ইতালির মুখোমুখি হয় শৈল্পিক ফুটবল খেলা মেইসের অস্ট্রিয়া। গোলকিপার রুডি হিদেন সেদিন ছিলেন না। তার জায়গায় নামেন পিটার প্লাটজার। নিচু ক্রসটা ধরতে পারলেও কড়া ট্যাকল করে বসেন গুইসেপ্পে মেয়াজ্জা। রেফারি সেটা দেখেননি, হয়তো না দেখার ভান করেন। এনরিকো গাইতার ট্যাপইনে গোল হয়ে যায়। লুইস মন্টিতে আটকে থাকা সিন্দেলার সেদিন জাদু দেখাতে পারেন নি। হেরে যায় অস্ট্রিয়া, হেরে যান সিন্দেলার।

কলঙ্কিত এক বিশ্বকাপের সাক্ষী হয়ে থাকে মুসোলিনির ইতালি।

একটি অপ্রীতিকর প্রীতি ম্যাচ

ত্রিশের দশকের শেষের দিকে ক্ষমতালোভী হিটলারের নাৎসিবাহিনী ইউরোপ থাবা বসায়। অস্ট্রিয়ায় যখন নাৎসিদের পা পড়ে, তখন সিন্দেলার তা মেনে নিতে পারেন নি। নাৎসিরা ইহুদিদের ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করে। খালি হয়ে যায় এফকে অস্ট্রিয়ার দল, যে দলের অনেকেই ছিলেন ইহুদি।

১৯৩৮ সালের তেসরা ডিসেম্বর। অস্ট্রিয়া দলের সাথে জার্মান দলের একটি প্রীতি ম্যাচ আয়োজন করে নাৎসিরা ভিয়েনার প্রাটার স্টেডিয়ামে। আগে থেকেই পরিকল্পনা করা ছিল ম্যাচটি হবে বন্ধুত্বপূর্ণ গোলশুন্য ড্র। অস্ট্রিয়া দলকে গোল না করার জন্য  বলা হয়। কিন্তু সিন্দেলার সেকথা শুনেন নি, শুনতে চান নি। তার মনে অন্য কিছু ছিল। ম্যাচের সত্তর মিনিটে সিন্দেলার যখন বল জালে পাঠান, তখন তার ক্যারিয়্যার শুধু নয়, জীবনের শেষ দেখে ফেলেছিলেন অনেকে। সিন্দেলার গোল করেই থেমে থাকেন নি। তিনি গ্যালারির সামনে গিয়ে নেচে উদযাপন করেন, যেখানে বাঘা বাঘা নাৎসি অফিসাররা বসে ছিলেন। স্পষ্টতই তিনি নাৎসিদের ব্যাঙ্গ করতে চেয়েছিলেন। নাৎসিরা তা মোটেও ভালো চোখে দেখে নি।

পরবর্তীতে জার্মানরা সিন্দেলারকে অস্ট্রিয়া-জার্মানি মিলিয়ে তৈরি জার্মান দলে খেলতে বলে, যা তিনি ইনজুরি আর বয়সের কথা বলে এড়িয়ে যান। তিনি তার প্রিয় ভিয়েনাতেই থেকে যান।

জোনাকিরা চলে যায়

এ ঘটনার নয় মাস পরের কথা। সিন্দেলারের বন্ধু গুস্তাভ হার্টম্যান যখন সিন্দেলারের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ঢোকেন, তখন তিনি বিছানার ঘুমিয়ে ছিলেন। তার দেহ ছিল ঠান্ডা, নিথর। তার ঘুম আর কোনোদিন ভাঙে নি। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে চলে যান সিন্দেলার। তার সঙ্গিনী ক্যামিলা কাস্তানোলাকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়, যিনি পরে হাসপাতালে মারা যান। পুলিশি তদন্তে বলা হয় কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ায় তারা মারা যান, যার কারণ ছিল চিমনির সমস্যা। ছয়মাস পর নাৎসিদের হস্তক্ষেপে তদন্ত বন্ধ হয়ে যায়। সিন্দেলারের মৃত্যু রহস্যই রয়ে গেছে। কেউ বলে তিনি ভিয়েনাকে নাৎসিদের দখলে দেখে বিষণ্ণতায় আত্মহত্যা করেন। আবার অনেকে বলে, নয় মাস আগের একটি গোলের খেসারত দিতে হয়েছে তাকে।

sindelar

"তার ঘুম আর কোনোদিন ভাঙে নি"

'গ্রেভ অফ দি ফায়ারফ্লাইজ' সিনেমায় ছোট্ট সেতসুকো তার ভাইকে বলে,"জোনাকিরা এত তাড়াতাড়ি মরে যায় কেন?"

মাতিয়া সিন্দেলার জোনাকি ছিলেন, যিনি ফুটবলকে আলোকিত করেছিলেন নিজের আলোয়।

 

তথ্যসূত্র:

১। উইকিপিডিয়া।

২। Matthias Sindelar-The Footballer Who Defied The Nazis-Tifo Football.

৩। ফিরে দেখা বিশ্বকাপ: ইতালির হলো শুরু অস্ট্রিয়ার হলো সারা-সাইফুল্লাহ বিন আনোয়ার,প্যাভিলিয়ন।