• ফুটবল

স্বপ্ন ভঙ্গের রাতে আইভরিয়ান মুগ্ধতা!

পোস্টটি ১৭৯৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

রবিবারের রাতটা যেন স্বপ্নের মতো কাটলো আইভরিয়ান'দের। 

দেশটির সর্ববৃহৎ শহর আবিদজানে রাত্রীকালীন জমাট উৎসব আয়োজনের কমতি ছিলোনা কোনোকিছুর। বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে থাকা মানুষদের চোখেমুখে লেপ্টে ছিলো স্বর্গীয় হাসি। বিজয়োৎসবের মিছিল আর স্লোগানে মুখরিত পুরো শহর! প্রেসিডেন্ট আলিস্যান আউট্টারা ন্যাশনাল রেডিওতে দেশবাসীকে কেবল বিজয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে ক্ষান্ত হলেন না; বরং ঘোষনা দিলেন রাষ্ট্রীয় ছুটির। 

F42

তাদের এই সরব প্রানবন্ত উন্মাদনার উপলক্ষ অবশ্য বিজয়; দীর্ঘ ২২ বছরের অপেক্ষার অবসানের! ঘানা'কে তারা পেনাল্টি শ্যুটআউটে হারিয়েছে। তবে তার জন্য কাঠখড় পোহাতে হয়েছে অনেক। হিংস্রতার ১২০ মিনিট; অতঃপর পেনাল্টি শ্যুটআউটের মঞ্চায়ন! তবু যেন কাঙ্ক্ষিত বিজয় নিশান উড়ছিলো না কারো আকাশে-ই!    

খানিক পরে নাটকীয়ভাবে আইভরিয়ান'রা যখন ম্যাচ জিতে উল্লাসে মাতোয়ারা; তাদের আকাশে যখন স্বর্গীয় সুখের মহড়া চলছে, ঠিক তখনি *ব্ল্যাক স্টার*দের আকাশ থেকে ভঙ্গুর হৃদয়ের হাহাকার ভেসে আসছিলো। ম্যাচ হারার শোক যেন সইতে পারছিলেন না আন্দ্রে আইয়ো। মাঠ থেকে মঞ্চ হয়ে ড্রেসিংরুম; তার কান্নার মাত্রা বাড়তেই থাকলো। 

Ivory-Coast-winners-2015

বিষাদের কান্নায় থাকেনা কোনো রহস্য। আইয়োর সে কান্নার পিছনে লুকিয়ে ছিলো তীব্র আর্তনাদ। দেশের হয়ে পঞ্চম আফ্রিকান ন্যাশনস কাপের শিরোপা'টা হাতছাড়া হয়ে গেলো মূহুর্তেই! ফাইনালে হারার যন্ত্রনা বোধহয় ভীষণ কষ্টদায়ক, আইয়োর কান্না অন্তত সেটিই বলছিলো সে রাতে।  

wpid-andre-ayew-in-tears-after-ghanas-2015-afcon-final-loss

তাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছুই নেই। ফিফা ১০০ গ্রেটেস্ট ফুটবলারের তালিকায় আপনি তার বাবা 'আবেদি পেলে'কে অবশ্যই খুঁজে পাবেন। কিংবা নিশ্চয়ই ইব্রাহিম- জর্ডান আইয়ো'র নাম শুনে থাকবেন৷ তারা আন্দ্রে আইয়োর ভ্রাতৃদ্বয়। বাবার দেখানো পথে ফুটবলে হাতেখড়ি হয়েছে বয়স সাতের কোটা পেরোবার আগেই। দশে করেছিলেন প্রফেশনাল চুক্তি! প্রফেশনাল ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা কাটিয়েছেন মার্শেইয়ে। পদরেখা পড়েছে প্রিমিয়ারলীগে৷

আফসোসের ব্যাপারটা অন্য জায়গায়; আইভোরিকোষ্টের বিপক্ষে যুদ্ধ মঞ্চে হেরে যাওয়া এই সৈনিক এখন খেলতে পারতেন ফরাসীদের শিবিরে৷ ফ্রান্স অনুর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন৷ বছর না যেতেই ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশন তাকে অনুর্ধ্ব- ২১ দলে খেলার প্রস্তাবও দিয়েছিলো। ততোদিনে তার জন্মস্থান ঘানা থেকে তার সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করা হয়নি। আইয়োর কাছে তখন কেবল একটা অপশন-ই ছিলো, সেটা ফ্রান্স! অথচ তিনি সে প্রস্তাব বিনয়ের সাথেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন৷ 

পরবর্তীতে ঘানা জাতীয় দলে চান্স পাওয়ার আগেই দেশকে অনুর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের স্বাদ এনে দিয়েছিলেন। সে বছর ঘানা জুনিয়ার দলের হয়ে জিতেছিলেন ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা। ফর্মের ধারাবাহিকতা তাকে জায়গা দিয়েছিলো '১০ এর আফ্রিকান ন্যাশনস কাপের দলে। সেবার দলকে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়েছিলেন৷ তবে মিশরের কাছে হেরে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে৷ 

তারপর আবার দীর্ঘ ৫ বছরের অপেক্ষা৷ নবম বারের মতো আফ্রিকান ন্যাশনস কাপের ফাইনালে ঘানা। আমার জন্মদিনের রাত৷ সেদিন আমার সব ব্যস্ততা ছিলো এই ম্যাচটিকে ঘিরে৷ প্রায় তেত্রিশ হাজার দর্শকের করতালি, দুয়োধ্বনি আর স্লোগানে মুখরিত পুরো স্টেডিয়াম। শ্বাসরুদ্ধকর একটি ম্যাচ। ট্রাইবেকারের নাটকীয়তা শেষে আইভরিয়ানদের বিজয়৷ আর ২য় বারের মতো ফাইনালের মঞ্চে বিমর্ষ শুন্যতার পরাজয় আইয়োর! আবেগটা তা-ই ধরে রাখতে পারলেন না আইয়ো; অশ্রুসিক্ত চোখে হতবিহ্বলের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন কতক্ষণ। ইচ্ছেমতো অঝোরে কাঁদলেন। সতীর্থরা তাকে সান্তনা জানালেন। কোচ তার বুকে টেনে নিয়ে শান্ত করতে চাইলেন। আচ্ছা, এ কান্নার মূল্য কত? 

নাহ, আন্দ্রে আইয়ো মোটেও সুপারস্টার লেভেলের কোনো ফুটবলার না। তবে দেশপ্রেম তাকে ঠিকই সুপারস্টার বানিয়েছে। ফ্রান্সের মতো দেশের হয়ে খেলার লোভনীয় প্রস্তাব যে মানুষ তার মাতৃভূমির জন্য বিসর্জন দিতে পারে, সে তো সুপারস্টার-ই বটে! 

আমরা গ্রেটদের দুঃখে ব্যতীত হই, তাদের সাফল্যে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করি৷ আচ্ছা, গ্রেটদের পথচলা কতটা ভঙ্গুর, তারা কিভাবে রক্তমাংসে গড়া মানুষ থেকে গ্রেটে পরিনত হন- সেটা ভেবে দেখেছি কখনো? আইয়োদের মতো ফুটবলারের কাছে দেশের হয়ে খেলা প্রতিটি ম্যাচ-ই তো বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ।

আন্দ্রে আইয়োর মতো অসংখ্য আইয়োর বাস এ পৃথিবীতে। যারা সবকিছুর উর্ধ্বে ফুটবল'টাকে  ভালোবাসেন। তারপর দেশপ্রেমের মহান ব্রতে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন শ্রেষ্টদের তরে। তারা কোন দলে খেলেন, তাদের চামড়ার রং কি, তারা শক্তিশালী কিনা- এসব হিসেব বড্ড বেমানান। তাদের জন্য আমার শ্রদ্ধা আর গভীর ভালোবাসা। 

>  আহমদ আতিকুজ্জামান৷