• ফুটবল

এমার্জেন্স অব দ্য "স্পেশাল ওয়ান"

পোস্টটি ৩০১৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

"প্লিজ ডন্ট সে আই অ্যাম আরোগ্যান্ট, বিকজ হোয়াট আই সে ইজ ট্রু। আই অ্যাম ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন, সো আই অ্যাম নট...ওয়ান অব...অব দ্য বোটল। আই অ্যাম আ...আই থিংক আই অ্যাম আ স্পেশাল ওয়ান।"

অদ্ভুত একজন মানুষ। শুধু তার ম্যানেজিং ক্যারিয়ারেই নয়, কথা বার্তা, চাল চলন সব কিছুতেই যেন তিনি বিশেষ একজন। সত্যিকার অর্থেই তিনি স্পেশাল ওয়ান।

ক্যারিয়ার শুরুর পর থেকে প্রায় সবসময়ই হয়েছেন শিরোনাম। সবসময় যে একই জিনিস নিয়ে, তা কিন্তু নয়। কখন যে কি নিয়ে, তার আদৌ কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। বিভিন্ন সময় হয়েছেন সবার হাসির খোরাক, বৈচিত্র্যহীন ফুটবলে এনেছেন রস। হোসে মরিনহো পুরোটাই যেন একটা প্যাকেজ, যেখানে আপনি সবকিছু পাবেন।

আচ্ছা, এই বিশেষ ব্যক্তিটির ফুটবলে আবির্ভাব হলো কিভাবে? আজ চলুন শুনে আসা যাক সেই গল্পটা।

লিসবনের ঠিক পাশেই ছোট্ট এক শহরতলী। নাম সেতুবাল। সেখানকার বাসিন্দা ছিলেন ফেলিক্স মরিনহো। ফেলিক্স ছিলেন প্রফেশনাল ফুটবলার। এমনকি পর্তুগাল জাতীয় দলের হয়েও গোলবার সামলেছিলেন একবার! তার স্ত্রী মারিয়া ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা।

মধ্যবিত্ত এক সুখী পরিবার। এ পরিবারেই ১৯৬৩ সালে পৃথিবীর আলো দেখেন হোসে মরিনহো। ছোট বেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিলো বাবার মতো সেও হবে ফুটবলার। কিন্তু হায়! শক্তি ও গতি কম হওয়ার জন্য ছোটবেলাতেই কবর দিতে হয় সেই স্বপ্ন কে। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন কোচিং এ মনোযোগ দেওয়ার।

যেই কথা সেই কাজ। ইচ্ছা পূরণের জন্য ভর্তি হন লিসবনের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি তে। সেখানেই তার ফুটবল ম্যানেজিং এর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়।

সেখান থেকে ফিরে সিদ্ধান্ত নিলেন এবার আসল কোচিং শুরু করা যাক। দায়িত্ব নিলেন স্থানীয় ক্লাব ভিতোরিয়া দ্য সেতুবালের যুব দলের। এরপর এস্ত্রেলা দা আমাদোরা তে সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করেন অল্প কিছুদিন।

image_search_1598870375725

১৯৯২ সাল। লিসবনের ক্লাব স্পোর্টিং সিপির নতুন কোচ হয়ে এলেন স্যার ববি রবসন। কিন্তু একটা গুরুতর সমস্যা দেখা দিলো। পর্তুগিজ ভাষার এক ছিটেফোঁটাও জানেন না রবসন। এখন কি করে খেলোয়াড়দের শেখাবেন ট্রিক্স? কিভাবে আলোচনা করে ছক কষবেন ম্যাচ জয়ের?

এখন সমাধান একটাই। শুরু হয়ে গেলো দোভাষীর খোঁজ, এমন একজন, যে কিনা দোভাষীর পাশাপাশি ফুটবল ব্যাপারেও ভালো ধারণা রাখে। অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল একজন কে। ববি রবসনের দোভাষী হিসেবে স্পোর্টিং সিপিতে এলেন হোসে মরিনহো।

রতনে রতন চিনে! অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রবসন বুঝতে পারলেন তার দোভাষী ফুটবল বিষয়ে বেশ অভিজ্ঞ, এমনকি কোচিং ব্যাপারে ভালো ধারণা ও আগ্রহও আছে। তাই শুধু দোভাষীর কাজ ছাড়াও কোচিং এর কাজে ছোটখাটো অনেক ব্যাপারেই মরিনহো কে কাজে লাগাতেন রবসন।

কিন্তু স্পোর্টিং এ রবসনের সময় ভালো কাটছিলোনা। লিগে তৃতীয় হওয়ার পর ইউয়েফা কাপে সালজবুর্গের কাছে হার। আর যায় কোথায়! ছাটাই হলেন রবসন।

কিন্তু এরই যেন অপেক্ষায় ছিলো স্পোর্টিং এর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পোর্তো। সঙ্গে সঙ্গে রবসন কে কোচ করে নিয়ে আসে তারা। রবসন এবার মরিনহো কে বসালেন একদম তার সহকারীর আসনে। সেখানে তার সহকারী ছিলেন আরও একজন তরুণ, সেও পরবর্তীতে কোচ হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি হলেন আন্দ্রে ভিয়াস বোয়াস, বর্তমানে অলিম্পিক ডি মার্সেই এর কোচ।

পোর্তো তে বেশ সাফল্যের দেখা পেয়েছিলেন রবসন। টানা দুইবার লিগ জয়, তাছাড়াও দলকে তুলেছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমি ফাইনালে, যেখান থেকে বিদায় নিতে হয় বার্সেলোনার কাছে হেরে। সেই ম্যাচেই বার্সার নজরে পড়ে গিয়েছিলেন রবসন। ফলাফল, ১৯৯৬ এ বার্সা নিয়ে আসে রবসন কে, সাথে অবশ্যই হোসে মরিনহো।

বার্সেলোনা কর্তৃপক্ষ চেয়েছিলো রবসনের সহকারী হোক তাদের সাবেক ডিফেন্ডার হোসে র‍্যামন আলেক্সাঙ্কো। কিন্তু মরিনহো কে ছাড়তে নারাজ রবসন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাই তাদের রাজী হতেই হলো।

মরিনহো যে বিশেষ কিছু তা বেশ পরিষ্কার হতে শুরু করলো ম্যাচ পরবর্তী প্রেস কনফারেন্স গুলো তে। সেখানে রবসনের কথাগুলোর অনুবাদ ছাড়াও ম্যাচ ব্যাপারে নিজের চিন্তাভাবনা গুলোও জানাতেন। সাংবাদিকেরা রবসন কে আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করলেও অনেক সময় মরিনহো নিজেই সেসব সামলে নিতেন। আবার রবসনের এলোমেলো কথাগুলোকেও চমৎকার ভাবে সাজিয়ে তুলে ধরতেন তিনি। এতে কোচের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন হোসে।

বার্সার খেলোয়াড়দের সাথেও হোসের সম্পর্ক ছিলো অতি ঘনিষ্ট। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, পেপ গার্দিওলা তখন ছিলেন বার্সার খেলোয়াড় এবং তার সাথে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতেন হোসে। শুধু পেপই নয়, লরা ব্লাঁ, লুইস এনরিকে, রিভালদো, রোনালদো সবার সাথেই নিবিড় সম্পর্ক ছিলো জোসের। পেপ ছাড়াও এনরিকে, ব্লাঁ বর্তমানে স্বনামধন্য কোচ। খেলোয়াড়দের একেবারে আপন লোক হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

বার্সা কে অনেক কিছুই জিতিয়েছিলেন রবসন। কিন্তু তারপরও সন্তুষ্ট ছিলোনা বোর্ড। আর বার্সার কোচিং এর আদর্শ ক্রুইফের ট্যাকটিক ছিলো রবসনের থেকে একদমই আলাদা। তাই ক্রুইফের আদর্শ ধরে রাখার জন্য আয়াক্স থেকে তারা নিয়ে আসে ক্রুইফের স্বদেশী লুই ফন গাল কে। সরে যেতে হয় রবসন কে। রবসন চলে গেলেও থেকে যান মরিনহো। রবসনেরই পরামর্শে ফন গালও তাকেই সহকারী হিসেবে রেখে দেন।

image_search_1598870458662

অল্প কিছুদিনের মধ্যে ফন গালের ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলেন হোসে। ম্যাচের ট্যাকটিক্যাল ব্যাপারে প্রায় সব সিদ্ধান্তই কোচ হোসের সাথে কথা বলে তারপর চূড়ান্ত করতেন।

কিন্তু ফন গালেরও বিদায়ের সময় এসে গেল। চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে না পারায় তাঁকে সরিয়ে দিল বার্সা বোর্ড।

এরপর হোসে সিদ্ধান্ত নিলেন, সহকারী হিসেবে তো অনেক হলো, এবার প্রধান কোচের দায়িত্ব নেওয়া যাক। ফন গালও তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, এবার আর সহকারী নয়, তোমাকে হতে হবে প্রধান কোচ।

প্রধান কোচ হওয়ারই প্রস্তাব এল হোসের নিজের শহর লিসবনের সবচেয়ে বড় ক্লাব বেনফিকা থেকেই। অবশেষে মরিনহোর যাত্রা শুরু হলো প্রধান কোচ হিসেবে।

বেনফিকায় মরিনহোর শুরুটা ভালোভাবে হয়নি। শুরুতেই ক্লাব কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়তে হয় সহকারী কোচ বাছাই নিয়ে। এর মধ্যে কিছুদিন পর আবার বদল হলো ক্লাব প্রেসিডেন্টের। তবে দলের পারফর্মেন্স বেশ ভালোই যাচ্ছিল। তাই মরিনহো ভেবেছিলেন নতুন প্রেসিডেন্টও তার ওপর খুশি থাকবেন। কিন্তু না। নতুন প্রেসিডেন্টের সুনজরে পড়তে ব্যর্থ হন মরিনহো। ফলাফল, বেনফিকা থেকে হোসের বিদায়।

image_search_1598870508633

এবার মরিনহো দায়িত্ব নিলেন পর্তুগালের এক অখ্যাত দল উনিয়াও দে লেইরার। প্রথম মৌসুমেই পেয়েছিলেন মাত্র সাতটি ম্যাচ। তাতেই দলকে দারুণ কামব্যাক করিয়ে টেবিলের পাঁচে তুলে আনলেন। পরের মৌসুমে তো একদম বাজিমাৎ! জায়ান্ট বেনফিকা-পোর্তো কে হটিয়ে উনিয়াও উঠে এল টেবিলের তিনে, যেটি তাদের ইতিহাসেরই শ্রেষ্ঠতম ফলাফল।

এই দুর্দান্ত পারফর্মেন্সের মূল কারিগর যে মরিনহো, তা নজর এড়াল না পর্তুগিজ জায়ান্ট পোর্তোর। তাই পরের মৌসুমেই তারা দলে টেনে নিলো হোসে কে। সেই সাথে শুরু হলো এক রূপকথার।

মরিনহো যখন পোর্তোর হাল ধরেন, তখন পোর্তোর একদম করুণ দশা। লিগে অবস্থান ছিলো পাঁচ নম্বরে। মরিনহো এসে তাই শুরুতেই স্কোয়াড গোছানো শুরু করলেন। দলের কয়েকজন কে বানালেন কি প্লেয়ার। ফলাফল হাতে নাতে। পরের পনের ম্যাচের এগারটি জয়, দুইটি ড্র। পোর্তো অবশেষে লিগ শেষ করে তিনে থেকে। আর মরিনহো কথা দেন পরের মৌসুমেই চ্যাম্পিয়ন করবেন দল কে।

পরের মৌসুমে দলকে পুরো ঢেলে সাজালেন মরিনহো। অসংখ্য প্লেয়ার সরিয়ে দিলেন, পাকা জহুরির মতো বাছাই করে আনলেন পছন্দমত ফুটবলার। তারপর কাজে লাগালেন তার নিজস্ব ট্যাকটিক। আর তাতেই বাজিমাত! কথা রাখলেন তিনি। পোর্তো জিতলো লিগ। শুধু লিগই নয়, সেই সাথে ইউয়েফা কাপও সেবার ঘরে তুললো পোর্তো।

টানা দুই মৌসুম লিগ জিতলো পোর্তো। সেই সাথে একটা ইউয়েফা কাপ। লেকিন আভি তোহ পার্টি শুরু হোয়ি হ্যায়!

পরের মৌসুমেও দলে বেশ কিছু পরিবর্তন করলেন। দলকে প্রস্তুত করলেন বড় মঞ্চের জন্য।

সেবার ইউসিএলে পোর্তোর গ্রুপে পড়েছিলো রিয়াল মাদ্রিদ, মার্সেই ও পার্টিজান বেলগ্রেড। হোসের কারিশমায় পুরো গ্রুপ পর্বে শুধু গ্যালাক্টিকোদের কাছে একটা ম্যাচ হেরে শেষ ষোল তে উঠে যায় পোর্তো। সেখানে তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে এল স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের মহা শক্তিশালী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। হোম ম্যাচে শুরুতে পিছিয়ে পড়েও শেষে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়লো পোর্তো। দ্বিতীয় লেগেও শুরুতেই এগিয়ে যায় ইউনাইটেড। কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে কস্টিনহার গোলে মোড় ঘুরে যায় ম্যাচের। কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায় পোর্তো।

সেখানে খুব বেশি কসরত করতে হয়নি। ফ্রেঞ্চ চ্যাম্পিয়ন লিওঁ কে দুই লেগ মিলিয়ে ৪-২ এ হারিয়ে সেমি ফাইনালে পা রাখে মরিনহোর শিষ্যরা। সেমিতে দেখালেন তার বিখ্যাত 'বাস পার্ক'। হার্ড লাইন ডিফেন্সে দেপোর্তিভো লা করুনা কে কাবু করে ১-০ গোলের ব্যবধানে ফাইনালে পৌঁছে যায় পোর্তো।

ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে এল ফ্রেঞ্চ জায়ান্ট মোনাকো। দেশমের সেই মোনাকো ছিলো বেশ তারকা সমৃদ্ধ। প্যাট্রিস এভ্রা, লুডোভিক গিলি, ফার্নান্দো মুরিয়েন্তেস, এমানুয়েল আদেবায়োরদের মতো তারকায় ভরপুর ছিলো দল। ফাইনালে ওঠার পথে তারা হারিয়ে এসেছিলো রিয়াল মাদ্রিদ ও চেলসির মতো জায়ান্ট দের।

মোনাকোর ভাগ্যটা খারাপই বলতে হবে। মাত্র বিশ মিনিটের মাথায় ইঞ্জুরির জন্য মাঠ ছাড়েন দলের অধিনায়ক ও আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু লুডোভিক গিলি। তাতেই চিরায়ত ফর্মেশনে পরিবর্তন করতে হয় মোনাকো কে। আর সে সুযোগটাই লুফে নেয় মরিনহো। মিডফিল্ডে প্রেসিং এর মাধ্যমে একের পর এক আক্রমণের পসরা সাজিয়ে বসে পোর্তো। তাতে আর পেরে ওঠেনি মোনাকো। অবশেষে ৩-০ গোলের অসাধারণ এক জয়ে ইউরোপসেরার মুকুট মাথায় পরে পোর্তো। সেই সাথে বিশ্ব চিনে নেয় এক মাস্টারমাইন্ড কে, যিনি পারেন অসম্ভব কে সম্ভব করতে।

image_search_1598870577301

সেই হলো শুরু, তারপর থেকেই চলছে তার ইতিহাস গড়ার পালা। একের পর এক সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে মরিনহোর কাছে। হোসে কোনো দলে গিয়েছেন, অথচ ট্রফি হাতে উঠেনি, এমনটা কখনোই হয়নি। তার হাতে যেন আছে এক জাদুর কাঠি, যেখানে সাফল্য নিজেই এসে আছড়ে পড়ে।

সত্যিই, তিনি স্পেশাল ওয়ানই বটে!