• ফুটবল

রোনালদো নাজারিওর পিএসভি ডায়েরি

পোস্টটি ১৩২৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

রবার্তো বাজ্জিও’র স্পট-কিকটি ঠিক যেই মুহূর্তে ক্যালিফোর্নিয়ার রোজ বোল স্টেডিয়ামের ক্রসবারের খানিকটা উপর দিয়ে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো, ঠিক তৎক্ষনাৎ হলুদ রঙের আভায় উদ্ভাসিতো সারা মাঠ! গ্যালারিতে তখন ব্রাজিল ব্রাজিল রব! ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক ক্লাউদিয়ো তাফারেল কে জড়িয়ে বাকি খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাস! উচ্ছ্বাসটা একটু বেশি হবেই বা না ক্যান, ইতালিকে হারিয়ে ২৪ বছর পর রেকর্ড চতুর্থ বিশ্বকাপ শিরোপা নিজেদের ঘরে তুলেছে যে সেলেসাওরা!

বেবেতো, দুঙ্গা, রোমারিও; ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক ট্রফির পাশে বড় বড় সব নাম। আবার ১৭ বৎসর বয়সী এক কিশোরের নামের পাশেও বিশ্বকাপ; ৯৪ বিশ্বকাপে মাঠে ফুটবল না ছোঁয়া হলেও পরবর্তী চার বছরের মাঝে ফুটবল বিশ্বের অনেক বড় নাম হয়ে ওঠা রোনালদো, রোনালদো লুইজ নাজারিও দা লিমা’র গল্প নিয়েই এ লেখা!

 

এত ছোট্ট বয়সে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দলে রোনালদোর অন্তর্ভুক্তি যে সহজ ছিলো তাও নয়, অনেক বিশেষজ্ঞই সমালোচনা করছিলো তৎকালীন কোচ কার্লোস আলবার্তো পেরেইরার। তবুও মাত্র ১৬ বছর বয়সে ক্রুজেইরোর সিনিয়র দলে অভিষিক্ত হয়ে ৪৭ ম্যাচে ৪৪ গোল করা খেলোয়াড়টাকে দলে অন্তর্ভুক্ত করাটা খুব বেশি বেমানান বোধহয় ছিলোনা। ক্রুজেইরোর রোনালদো’র মুগ্ধতায় অভিষেকের ৩ মাস পরেই হলুদ জার্সিতে তাকে আমন্ত্রণ জানান পেরেইরা।

ক্রুজেইরো তে মাত্র এক সিজন কাটানোর পরেই কোপা দো ব্রাজিল জয়ী রোনালদোকে দলে ভেড়ানোর চেস্টা করে এসি মিলান, আয়াক্স, জুভেন্টাসের মতো ক্লাবগুলি। কিন্তু রোনালদোর এজেন্ট এবং সতীর্থ রোমারিও’র পরামর্শে তিনি যোগ দেন ডাচ ক্লাব পিএসভি তে। “রোমারিও আমাকে বলেছিলো যে পিএসভি ইউরোপের সুসজ্জিত এক ক্লাব, যারা প্রফেশনাল এবং তরুণদের জন্যে ফলপ্রসূ, যেখানে ইউরোপের ফুটবল দর্শন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়!” – বলেছিলেন রোনালদো!

আকর্ষণীয় সব অফার উপেক্ষা করে রোনালদো যোগ দেন পিএসভি তে। নতুন ক্লাব, নতুন শহর, কিন্তু ১৭ বছর বয়সী সেই বালকের সেখানে কোন প্রকার সমস্যার সৃষ্টি হয়নি; ক্লাবে জয়েনের শুরতেই আইন্দোভেনে মা এবং গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে শহরে বসবাস শুরু, আর মাঠের খেলায় রোনালদো কি বা কেনো তাকে নিতে এত হইচই তা জানাতে সময় নিলেন মাত্র ১০ মিনিট!

মাঝমাঠের নিচে বল, অথচ লেফট উইংয়ে দৌড়াচ্ছেন রোনালদো, রোনালদো কে দেখেই দূরপাল্লার শট, দৌড়ে ডিফেন্ডারদেরকে পিছনে ফেলে রোনালদোর বল রিসিভ, বল নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে যাওয়া, নিদারুণ ফিনিশ! গোল! ফিলিপ্স স্টেডন স্টেডিয়ামে রোনালদোর প্রথম দৌড় ছিলো চোখে লাগার মত! অভিষেক ম্যাচেই রোনালদোর জোড়া, পিএসভির জয় ৪-১ গোলে!

সেই জয়কে ছাপিয়ে পিএসভি ফ্যানদের স্বস্তি আর উচ্ছাসের জায়গা ছিলো যে তারা রোমারিও’র যোগ্য উত্তরসূরী পেয়ে গেছেন, যিনি ১ বছর আগেই বার্সার উদ্দেশ্যে ক্লাব ছেড়েছেন।ইউরোপের মাটিতে ৭ বার জোড়া পুর্ণ এবং ১ হ্যাট্রিক সহ ৩৫ ম্যাচে ৩৩ গোল নিঃসন্দেহে রোনালদোর অসাধারণত্ব বহন করে!

হ্যা! ঠিকই ধরেছেন! এল ফেনোমেনোন ইউরোপে তার নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চলে এসেছেন!

পিএসভি তে এক একটা ম্যাচ, আর দিনকে দিন দর্শক ভক্ত কিংবা স্কাউটরা কিশোর রোনালদোর প্রতিভা কিংবা মাঠের দক্ষতার বিস্ময়বিমূঢ়তায় বিমোহিত হচ্ছিলো!

যদি কোন একজন পিএসভি’র রোনালদোর পারফরম্যান্সের সারসংক্ষেপ রচনা করতে চায় তবে তাকে সেই সিজনের চ্যাম্পিয়নস লিগের বায়ার লেভারকুজেন বনাম পিএসভি ম্যাচে তাকাতে হবে। যেখানে রোনালদো জানান দিয়েছিলেন তিনি একজন দক্ষ শাসক হতে এসেছেন, ইউরোপের ফুটবল মঞ্চে নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এসেছেন। তিনি জানিয়েছিলেন, কেনো তাকে ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রতিভা ভাবা হচ্ছে, কেনো তিনি অন্য টিনেজদের চেয়ে আলাদা!

জার্মান স্ট্রাইকার আল্ফ ক্রিস্টেনের হ্যাট্রিকে সেদিন লেভারকুজেনের জয় ছিলো ৫-৪ গোলে, কিন্তু বিশ্ব মিডিয়ায় টক অব দ্য টাউন ছিলো পরাজিত সেই দলের ৯ নাম্বার জার্সি পরিহিত ১৭ বছর বয়সী রোনালদোর পারফরম্যান্স নিয়ে। অসাধারণ, অবিশ্বাস্য! নিরলসভাবে বল নিয়ে কারিকুরি, ড্রিবলিং, বলে মারাত্মক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, মারাত্মক গতিতে ডিফেন্স ভেদ করা, যেনো বয়সের চাইতেও বেশি উদ্দীপনা আর প্রাচুর্যসম্পন্ন একজন খেলোয়াড়!

মাত্র ৬ মিনিটে ক্রিস্টেনের গোল, ৫ মিনিট পরেই পেনাল্টি থেকে রোনালদোর গোল, সমতা। ২ মিনিট পরেই লেভারকুজেনের আবার লিড।৩ মিনিট পরে ক্রিস্টেনের জোড়া পুর্ণ, হাফটাইমের আগেই ক্রিস্টেনের আরেক গোল, হ্যাট্রিক পুর্ণ! পিএসভি পিছিয়ে ৪-১ গোলে! এরপরই মাদকতায় ঠাসা রোনালদো জাদুর শুরু! দর্শনীয় আরো দুই গোল করে নিজের প্রথম হ্যাট্রিক পুরণ করে ম্যাচ জমিয়ে তোলেন রোনালদো। শেষ পর্যন্ত পিএসভি ৫-৪ গোলে হারলেও রোনালদো উদিত হোন আকর্ষণীয় দৃষ্টিনন্দন এক তরুণ তুর্কি হয়ে।

রোনালদো, রোনালদো, রোনালদো – রোনালদোর পারফরম্যান্সে আবিষ্ট হয়ে ফ্যানদের চ্যান্টে কেবল একটাই নাম! ম্যাচ হারার বেদনার চেয়েও একজন রোনালদোকে পাওয়ার উচ্ছ্বাস। টিভি কমেন্ট্রিতেও মন্ত্রমুগ্ধ ধারাভাষ্যকার জানান দিচ্ছিল একটু পর পরই – “this is just a 17-year-old boy”, “this is just a 17-year-old boy”!

আমি আমার জীবদ্দশায় একজন ১৮ বছর বালককে এতটা ভালো খেলতে দেখিনি – বলেছিলেন জার্মান লিজেন্ড রুডি ভোলার। বিশ্বকাপ জয়ী বালক, যিনি কিনা পাঁচটা দিন পরে সদ্য ১৮ তে পা দেওয়া একজন হবেন, ঠিক যেনো দুর্লভ এক গুপ্তধন, সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আশীর্বাদ!

সুঠাম দৈহিক গঠন, শৈল্পিক বল কন্ট্রোল, নিঁখুত ফিনিশিং, মাত্র ১৮ বছরের এক তরুণের মাঝে একজন কমপ্লিট ফরওয়ার্ডের ছোঁয়া ফুটবল বিশ্ব আগে দেখেনি।

“এভাবে এগোতে থাকলে রোনালদো ইউরোপের যেকোন ক্লাবে খেলতে পারবে, সফলতার চরম শিখরে পৌঁছাবে” – প্রথম সিজন শেষেই ফুটবল বোদ্ধাদের কাছে এমন স্তুতি পেতে থাকেন রোনালদো!

রোনালদো কে ঘিরে এতসব ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হওয়ার পথে তিনি আরো একধাপ এগিয়ে যান পরের সিজনেই। দুর্ভাগ্যবশত ইঞ্জুরি নামক বিভিষিকায় পুরো সিজন খেলা হয়নি রোনালদোর! ইঞ্জুরি, বিভিষিকাময় এক থাবা, যেই থাবাই কিনা একটা সময় সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রতিভাধর রোনালদোর সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়ায়!

নতুন মৌসুমে বিস্ফোরক শুরুর পরেও ১৯৯৫ এর অক্টোবরে হাঁটুর ইঞ্জুরিতে পড়েন রোনালদো, যেই ইঞ্জুরি তে ভুগে এপ্রিল পর্যন্ত মাঠে নামা হয়নি আর তার! সিজনের একদম শেষে মাঠে নামেন তিনি। ইউরোপে রোনালদোর দ্বিতীয় সিজন শেষ হয় মাত্র ১৯ ম্যাচ খেলে, ১৮ গোল করে!

তবুও এই ফিটনেস ইস্যু রোনালদোর পটেনশিয়ালটিকে আড়াল করতে পারেনি! রোনালদোর এমন পারফরম্যান্স দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বড় বড় ক্লাবগুলি, পিএসভি’ও জানতো তারা রোনালদোকে ধরে রাখতে পারবেনা, তাই তারা চড়ামুল্য চায়। রোনালদো কে কেনার দৌড়ে এগিয়ে ছিলো বার্সা ও ইন্টারমিলান। রোনালদোর ইঞ্জুরিতে কাটানো শেষ সিজন কে মাথায় নিয়ে ইন্টার মিলান চড়া মূল্যে তাকে কিনতে চাননি। শেষ পর্যন্ত তৎকালীন রেকর্ড ১২.৫ মিলিয়ন ইউরোতে বার্সায় যোগ দেন রোনালদো নাজারিও!

এখনো পিএসভি ফ্যানদের কাছে প্রিয়তর এক নাম রোনালদো, তাদের ফ্যানদের মুখে এখনো রোনালদো বন্দনা রয়ে গেছে! ২০০৮ এ এসি মিলান থেকে রোনালদো কে আবার কেনার চেষ্টাও করেছিলো পিএসভি। কিন্তু তা আর বাস্তবের মুখ দেখেনি।

হয়তোবা এই ট্রান্সফারটি সুন্দর হতে পারতো; সর্বজয়ী এক মহারাজার প্রত্যবর্তন সেই ময়দানে ঠিক যেখানে তিনি মহারাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন! পিএসভিতে হয়তো রোনালদো আরো উচ্চতায় পৌঁছাতে পারতেন, কিন্তু এক সিজনের ইঞ্জুরি, বড় বড় ক্লাবের নজরে ২ সিজনেই আইন্দোভেনবাসী রোনালদো কে হারিয়ে ফেলে! তবুও, নেদারল্যান্ডসের মাটিতে সৌন্দর্যময় এক ফুটবলার আর লিগ ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্রতিভার প্রদর্শকদের একজন হয়েই থাকবেন রোনালদো নাজারিও!

রোনালদোর পুরো ক্যারিয়ার স্বচক্ষে দেখা যেকোন ডাচদের হয়তো আক্ষেপের জায়গা জুড়ে রোনালদোর পিএসভি ক্যারিয়ার আরো দীর্ঘায়িত না হওয়ার আফসোস রয়ে গেছে! হয়তোবা আইন্দোভেনের আলো বাতাস এখনো একজন রোনালদো নাজারিও দা লিমার স্মৃতি চারণ করে, আইন্দোভেন, নেদারল্যান্ডস, এই মাটিতেই যে একজন এল ফেনোমেননের ইউরোপ শাসনের সূচনা ঘটেছিলো