• ফুটবল

মারাকানাজো

পোস্টটি ১৩৭১ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

দ্য সাউন্ড অব সাইলেন্স।

শুনেছেন কখনো?

ধরা যাক, আপনি এক মাঠে খেলতে নেমেছেন। প্রতিপক্ষের মাঠ। বিরাট গ্যালারি। গ্যালারি ভর্তি প্রায় দু লক্ষ মানুষ। তারা সবাই আপনার প্রতিপক্ষ দলটির সমর্থক। চিৎকার করে প্রতিনিয়ত তাদের উৎসাহ দিচ্ছে। নামে ভারেও প্রতিপক্ষ আপনাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে, সেটা তারা আগেই প্রমাণ করেছে। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ। ম্যাচে ডমিনেট করছে স্বাগতিকরাই। এক গোলে এগিয়েও ছিলো তারা। কিন্তু হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন আপনারা। করলেন পর পর দুটি গোল। স্বাগতিকদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল আপনার দল। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল সব কলরব। স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো গ্যালারি। নেমে এল মৃত্যুর মতো নিরবতা।

অনুভব করতে পারেন সেই মুহূর্তটি?

দু লক্ষ মানুষকে স্তব্ধ বানিয়ে দেওয়ার কারিগর আলসিডেস ঘিগিয়া এভাবেই ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বলেন, “সেখানে পুরোপুরি নিরব হয়ে গিয়েছিলো। জনসমূদ্র যেন বরফ হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছিলো কারো শ্বাসপ্রশ্বাসও চলছেনা।”

১৯৫০ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামায় প্রায় এক যুগ বন্ধ থাকার পর আবার বসেছে বিশ্বকাপের আসর। এবারের আসর বসেছে ল্যাটিন পরাশক্তি ব্রাজিলে।

বর্তমানের সর্বাধিকবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দেশটির বিশ্ব আসরে শিরোপা সংখ্যা তখনো শূন্যের কোটায়। তবে সেবার বিশ্বজয়ের সব প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছিলো সেলেসাওরা। কোপা আমেরিকা জয়ের পর তাদের আত্মবিশ্বাস তখন তুঙ্গে। এবার বৈশ্বিক শিরোপা টা কোনোমতেই হাতছাড়া করা যাবেনা, এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই এসেছিলো তারা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সে বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো আগের দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালি, জার্মানি ও জাপান কে। এর সাথে বিশ্বকাপ বর্জন করেছিলো বেশ কটি দল। সব মিলিয়ে দলের কোটা পূরণ করাই কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তারপরও অবশেষে ষোলটি দল নিয়ে আয়োজন করা হয় এ আসরের। অন্যান্য এশীয় দলের বিশ্বকাপ বর্জন করায় সুযোগ পেয়ে যায় ভারত। কিন্তু অদ্ভুত এক দাবী তোলে তারা। বুট পরে মাঠে নামবেনা তারা, খেলবে খালি পায়ে। ফিফা এ দাবী না মানায় তারাও বর্জন করে বিশ্বকাপ। শেষ সময়ে ভারত ছাড়াও ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ বর্জন করে। এতে দল সংখ্যা কমে দাঁড়ায় তেরটিতে। শেষ পর্যন্ত এ কয়টি দল নিয়েই শুরু হয় সেবারের আসর।

image_search_1605634500069

সেটি ছিলো একমাত্র বিশ্বকাপ, যেখানে ছিলোনা কোনো নকআউট স্টেজ। চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিলো দল গুলোকে, যেখান থেকে শুধু চার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন উত্তীর্ণ হয় দ্বিতীয় রাউন্ডে।

দ্বিতীয় রাউন্ডও ছিলো রাউন্ড রবিন ফরম্যাটে। এ রাউন্ডে স্বাগতিক ব্রাজিলের সাথে কোয়ালিফাই করে সুইডেন, স্পেন ও উরুগুয়ে। পুরো টুর্নামেন্ট রাউন্ড রবিনে হওয়ায় নকআউটের মতো ছিলোনা কোনো ফাইনালও। তাই গ্রুপ চ্যাম্পিয়নই পাবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মর্যাদা।

ব্রাজিল যে সেবার কতটা ফর্মে, সেটা তারা প্রমাণ করে চলেছিলো প্রত্যেকটি ম্যাচেই। দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম দুই ম্যাচেই প্রতিপক্ষকে স্রেফ উড়িয়ে দেয় তারা। প্রথম ম্যাচে সুইডেন কে ৭-১ গোলে ধরাশায়ী করে দ্বিতীয় ম্যাচে স্পেনকে হারায় ৬-১ এ। দুই ম্যাচেই পুরো পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের মাথায় চড়ে বসে তারা।

গ্রুপের অন্যদল উরুগুয়ে বলতে গেলে ভাগ্যের জোরেই টিকে থাকে। প্রথম ম্যাচেই স্পেনের সাথে ২-১ এ হারতে বসেছিলো তারা, সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত ২-২ এ ড্র করতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় ম্যাচে সুইডেনের বিরুদ্ধে কোনোরকমে ৩-২ গোলে জয় তুলে নেয় আকাশী নীল রা।

শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্টের শেষ ম্যাচ দাঁড়ায় অলিখিত ফাইনাল। তবে ব্রাজিলের জন্য সমীকরণ ছিলো তুলনামূলক সহজ। কোনোমতে হার এড়াতে পারলেই শিরো ঘরে উঠবে তাদের। কিন্তু উরুগুয়ের শিরোপা জয়ের জন্য ব্রাজিলকে হারানো ছাড়া আর কোনো পথ ছিলোনা।

image_search_1605634811909

ফাইনাল ম্যাচের আগেই সংবাদমাধ্যমগুলো ব্রাজিলকে অগ্রিম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে দেয়। ২২টি গোল্ড মেডেলও ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের নাম খোদাই করা হয়ে গিয়েছিলো ম্যাচ শুরুর আগেই। ফাইনাল শুরু হওয়ার দু’ঘণ্টা আগে দেওয়া বক্তব্যে রিও ডি জেনেইরোর মেয়র পর্যন্ত ‘চ্যাম্পিয়ন’ বলে সম্বোধন করেন ব্রাজিল ফুটবল টিমকে। ‘Brasil os Vencedores’ নামে একটি গান রচনা করা হয় ম্যাচ শেষে গাওয়ার জন্য। অবশ্য পুরো ব্যাপারটি অযৌক্তিক কিছু ছিলো না। তৎকালীন ব্রাজিল দলটির সাথে উরুগুয়ে কেন, বিশ্বের আর কোনো দলেরই তুলনা চলতোনা।

দু দলের শক্তির পার্থক্য যে কতটা সেটা তো টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে ব্রাজিল তাদের প্রতিটি প্রতিপক্ষকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে উরুগুয়ে এ পর্যন্ত পুরো পথই পাড়ি দিয়েছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

আবার ব্রাজিল একদিকে ছিলো স্বাগতিক দেশ, অন্যদিকে আগের বছরেই অনুষ্ঠিত কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন। সে টুর্নামেন্টেও প্রতিটি দলকে নিয়ে ছেলেখেলা করে তারা। ফাইনালে প্যারাগুয়ে কে হারায় ৭-০ তে। এমনকি এই উরুগুয়ে কেও গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ৫-১ গোলে হারিয়েছিলো সেলেসাওরা। তাই জয় পরাজয় নয়, ব্রাজিল কত বড় ব্যবধানে জয়লাভ করবে, ম্যাচের আগে সেটাই ছিলো আলোচনার মূখ্য বিষয়।

ফাইনাল ম্যাচের আগের দিন ব্রাজিলের তৎকালীন বিখ্যাত দৈনিক "ও মুন্ডো" ব্রাজিল দলের ছবি দিয়ে লিখেছিলো ‘These are the Champions!’। উরুগুয়ে অধিনায়ক ওব্দুলিও ভারেলা সেই পত্রিকার অসংখ্য কপি কিনে আনেন। তারপর সেগুলো নিজেদের বাথরুমের ফ্লোরে বিছিয়ে সতীর্থদের সাথে নিয়ে সেগুলোর উপর মূত্র ত্যাগ করেন।

ম্যাচ শুরুর আগে উরুগুয়ের কোচ হুয়ান লোপেজ তাদের ডিফেন্সিভ খেলার নির্দেশনা দিচ্ছিলো। অতঃপর কোচ চলে গেলে উঠে দাঁড়ান ভারেলা। তারপর সতীর্থদের উদ্দেশ্যে বলেন, "হুয়ান লোপেজ একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তবে আজ তার কথা শুনলে আমাদের অবস্থাও হবে স্পেন, সুইডেনের মতো।" এরপর দেন এক আবেগময় বক্তব্য। তাতেই উজ্জীবিত হয়ে ওঠে পুরো দল।

image_search_1605634485770

১৬ জুলাই, ১৯৫০। মারাকানা স্টেডিয়াম, রিও ডি জেনেইরো। তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্টেডিয়ামটি সেদিন পরিণত হয় জনসমূদ্রে। ২ লক্ষ ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামটিতে উপস্থিত হয় ১,৯৯,৮৫৪ জন মানুষ। সবাই এসেছে ব্রাজিলের জয়োৎসবে যোগদান করার জন্য।

ম্যাচের শুরু থেকেই প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক ব্রাজিল দল। প্রথমার্ধ পুরোটাই উরুগুয়ে পার করে দেয় শুধু প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকাতে। তবে তাদের রক্ষণ যে সলিড, সেটার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিলো। যেখানে অন্য দলগুলোকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছিলো ব্রাজিলের এটাক, সেখানে উরুগুয়ে প্রথমার্ধ শেষ করে কোনো গোল না হজম করেই।

তবে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই গোল পেয়ে যায় স্বাগতিকরা। সাও পাওলো স্ট্রাইকার ফ্রিয়াকার গোলে ১-০ তে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। ততক্ষণে পুরো গ্যালারি তে বিজয় উদযাপন শুরু হয়ে গেছে।

তবে গোল খেয়েও দমে যায়নি উরুগুয়ে। মাঠের মাঝখান থেকে ক্যাপ্টেন ভারেলা দলের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন, "এখনই সময় জিতে নেওয়ার"। ক্যাপ্টেনের কথা ঠিক যেন টনিকের মতো মতো কাজ করে। ঝিমিয়ে পড়া উরুগুয়ে মুহূর্তের মধ্যেই যেন জেগে ওঠে নতুন ছন্দে। রক্ষণাত্মক খেলা ছেড়ে পালটা আক্রমণ শুরু করে।

আর হঠাৎ আক্রমণে যেন হকচকিয়ে যায় পুরো ব্রাজিল ডিফেন্স। ফলাফল পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে। ৬৬ মিনিটে গোল পেয়ে যান হুয়ান আলবার্তো শিফিয়ানো। সমতায় ফেরে উরুগুয়ে।

তারপরও অবশ্য উদযাপন থামেনি। পুরো স্টেডিয়ামে তখনও চলছে ব্রাজিলের অগ্রিম বিজয় উদযাপন।

তবে আসল আঘাত টা আসে ম্যাচ শেষ হওয়ার ঠিক ১১ মিনিট আগে। "এল কাপিতানো" ওব্দুলিও ভারেলার পাস থেকে চমৎকার এক গোল করে বসেন আলসিডেস ঘিগিয়া। ব্রাজিলের গোলকিপার বারবোসার পায়ের নিচ দিয়ে বল গিয়ে জড়িয়ে যায় জালে।

image_search_1605634477318

আর তখনই...

আর তখনই থেমে গেল সব কলরব। স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো গ্যালারি। নেমে এল মৃত্যুর মতো নিরবতা। চারিদিকে যেন জনমানবশূন্য। কোনো মানুষের কলরব নেই, নেই কোনো শব্দ। ঘিগিয়ার ভাষায় "দ্য সাউন্ড অব সাইলেন্স"।

এরপর বারংবার চেষ্টাতেও আর গোলের দেখা পায়নি ব্রাজিল। শেষ পর্যন্ত রেফারি জর্জ রিডার বাজান তার হুইসেল। দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা ঘরে তোলে উরুগুয়ে। আলসিডেস ঘিগিয়া ও ওব্দুলিও ভারেলা বনে যান জাতীয় বীর।

ফাইনালের পর ব্রাজিলের তৎকালীন সাদা জার্সিটা আখ্যা পায় অভিশপ্ত হিসেবে। ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন চিরকালের মতো পরিবর্তন করে ফেলে তাদের জার্সির রঙ।

এর ঠিক আট বছর পর ব্রাজিল জয় করে বিশ্বকাপ। তারপর আরও চারটি। পাঁচটি বিশ্বকাপ নিয়ে বর্তমানে ফুটবল বিশ্বের সফলতম দল তারা। কিন্তু সেই মারাকানা ট্রাজেডি কখনো ভুলবার নয়। এখনই চাপা একটা হাহাকার বুকে নিয়ে বেড়ায় ব্রাজিলিয়ানরা, যার নাম মারাকানাজো।

image_search_1605634924296