• ক্রিকেট

ভারতের সর্বনিম্ন টেস্ট স্কোর বনাম দুই যুগের আক্ষেপ!

পোস্টটি ২০৪৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
১.
একজন ক্রিকেটার আর একজন রকস্টার, আমার আজন্ম লালিত সাধ ছিল এ দুটো হবার! আর একজন একইসাথে এই দুইয়ের মিশেল হতে পারে - সত্যিকারের ফাস্ট বোলার! ক্রিকেটের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দিক নিঃসন্দেহে ফাস্ট বোলিং!
সদ্য সমাপ্ত এডিলেড টেস্টে দুই দলের, বিশেষত অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসের ভারতকে ৩৬ রানে অলআউট করে দেয়া রক্তে নাচন তোলা ফাস্ট বোলিং যেমন মুগ্ধ করেছে, তেমনি প্রায় দুই যুগের সঞ্চিত আক্ষেপটা আরেকটু বাড়িয়ে তুলেছে।
 
১৯৯৭ এর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে-পরে থেকে আমার নিয়মিত ক্রিকেট খেলা দেখা, সে হিসেবে প্রায় ২৩-২৪ বছর। সেই ছোটবেলায় শঙ্করীপ্রসাদ বসুর 'বাছাই ক্রিকেট' বইতে পড়েছিলাম সত্তরের দশকের অস্ট্রেলিয়ার দুর্ধর্ষ ওপেনিং বোলিং যুগল- ডেনিস লিলি এবং জেফ থমসনের কথা। গতির ঝড় তোলা থমসনের থেকে যদি নিস্তার মিলে থাকেও, অন্য প্রান্ত থেকে আসছে লিলি; বেচারা ব্যাটসম্যানকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিতো দর্শক-“Ashes to Ashes, dust to dust, if Thomson don’t get ya, Lillee must.” লিলি যখন বল করতে আসতো, ভয়ংকর গতির সাথে ছিল অজি দর্শকদের স্বমস্বরে রব- ''লিলি, লিলি, লিলি, কিল! কিল! কিল!' ক্লাইভ লয়েডের বিশ্বজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ আক্ষরিক অর্থে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়ে পরবর্তী ট্যুরেই জন্ম দেয় বিখ্যাত পেস বোলিং কোয়ার্টেট এর, যা ক্রিকেট রূপকথার অবিচ্ছেদ্য অংশ! এন্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, কলিন ক্রফট এবং মাইকেল হোল্ডিং। পরবর্তীতে কলিন ক্রফটের স্থলাভিষিক্ত হয় ম্যালকম মার্শাল।
 
স্বচক্ষে লাইভ দেখেছি এমন অসাধারণ কিছু ফাস্ট বোলিং জুটি ছিল- ওয়ালশ-এমব্রোস, ওয়াসিম-ওয়াকার, ডোনাল্ড-পোলক, ম্যাকগ্রা-গিলেস্পি, স্টেইন-মরকেল ইত্যাদি। বর্তমানে আছে এন্ডারসন-ব্রড; আমার অত্যন্ত প্রিয় তো বটেই ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা!
 
gettyimages-1184367004-1024x1024
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত পেস কোয়ার্টেট। 
 
২.
উপমহাদেশের দল পাকিস্তান যেমন একের পর এক পেস বোলার তৈরীর কারিগর তেমনি প্রতিবেশি ভারত ছিল বরাবরই শক্তিশালী স্পিননির্ভর দল। ঘরের ধুলো-ওড়া মাটিতে বাঘ, বিদেশের মাটিতে বেড়াল! ষাট-সত্তরের দশকে ভারতে ছিল বিখ্যাত স্পিন কোয়ার্টেট- বিষেন সিং বেদি, ইরপালি প্রসন্ন, ভাগওয়াত চন্দ্রশেখর এবং শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবন। পরবর্তীতে কপিল দেব, শ্রীনাথ, জহির খানদের মতো কিছু পেস বোলার কালেভদ্রে আসলেও ভারতের পেসারদের গল্প ঘুরেফিরে ওই একই- পড়ে পড়ে মার খাওয়ার গল্প। দেশে হোক বিদেশে হোক- দিন শেষে স্পিনেই ভরসা।
 
এমনকি নিকট অতীতেও ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা দুই অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি এবং এমএস ধোনিরও টেস্ট বোলিংয়ের ভরসা ছিল দুই স্পিন যুগল, যথাক্রমে কুম্বলে-হরভাজন এবং অশ্বিন-জাদেজা!
 
স্পিনতীর্থ এই ভারতেও বিস্ময়করভাবে এখন স্রোত বিপরীত দিকে বহমান। আর তার পিছনে আছে একটি নাম- বিরাট কোহলি!
 
নানান কারণে বর্তমান অধিনায়ক বিরাট কোহলিকে আমি পছন্দ করি, তার একটি কোহলির দূরদর্শিতা। প্রজ্ঞাবান কোহলি ভালো মতোই জানেন, সর্বকালের সেরা টেস্ট দল ভারতকে তখনই বলা যাবে যখন দলটি ঘরে বাইরে সব জায়গায় সমানভাবে কর্তৃত্ব দেখিয়ে জয় আদায় করে নিতে পারবে। পরাক্রমশালী ভারতীয় ব্যাটিং শুধু ড্র-ই নিশ্চিত করতে পারে কিন্তু অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড এই চারটি দেশে জয় পাওয়ার ক্ষেত্রে ভালো পেস বোলিংয়ের বিকল্প নেই। আর তাই ২০১৭ এর লম্বা বিদেশ সফরের আগে ভারত নিজেদের পেস বোলিংকে শক্তিশালী করে। ভরত অরুনের মত বোলিং কোচের পাশপাশি ছিল বিরাটের সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার তাড়না, সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা এবং বোলারদের নিজেদের ছাড়িয়ে যাবার আকাঙ্ক্ষা। পরপর তিনটি ট্যুরে ভারত দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে, ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ডকে একটি করে টেস্টে এবং অস্ট্রেলিয়াকে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিরিজে পরাজিত করে- যা ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম। এমনকি পরাজিত হলেও বেশির ভাগ টেস্টে প্রতিপক্ষের বিশটি করে উইকেট ভারত নিয়েছে যার সিংহভাগ কৃতিত্ব পেস বোলারদের। অশ্বিনের মাপের একজন স্পিন বোলারও অনেক সময় দলে ব্র্যাত্য থেকেছে এসব ট্যুরে!
 
শুধু সহায়ক উইকেটেই না, এমনকি ভারতের মাটিতেও ইশান্ত শর্মা, বুমরা, শামি, ভুবনেশ্বর, উমেশ যাদবরা যথেষ্ট কার্যকর। গতবছর ইডেন গার্ডেনসের আমাদের সাথে ঐতিহাসিক পিঙ্ক টেস্ট সবার স্মরণে থাকার কথা- পেস বোলিংয়ে কী নাকানি চুবানিটাই না খাওয়ালো!
 
বর্তমানে স্টার্ক-কামিন্স-হ্যাজেলউড, সাউদি-বোল্ট-ওয়াগনার পেস ত্রয়ীর চেয়ে ইশান্ত-শামি-বুমরা খুব বেশি পিছিয়ে নেই।
 
866674-80402-sowidhlocr-1517121508
ভারতের পেস বোলিংয়ের সোনালি প্রজন্ম। 
 
৩.
এবার আসি আক্ষেপের গল্পে। টেস্টে কোথায় আমাদের বাংলাদেশের পেস বোলিং! মাশরাফির ইনজুরি তো আমাদের চিরন্তন দীর্ঘশ্বাসের নাম, কিছুদিন শাহাদাত টেস্টে ভালোই বোলিং করেছে। এর বাইরে কে? কেউ না। পেস বোলিংয়ের কথা আসলে প্রথমেই আসবে শারীরিক সামর্থ এবং সহায়ক উইকেটের কথা! এই দুইটিতে আমরা পিছিয়ে আছি সন্দেহ নেই- তবে সেই ডিম আগে না মুরগি আগে তর্কের মত অমীমাংসিত তর্ক এখানেও রয়ে গেছে। সহায়ক কন্ডিশন নেই বলেই কি ভালো পেস বোলার নেই নাকি ভালো পেস বোলার নেই বলেই ধীরগতির নির্বিষ স্পিন উইকেট তৈরী করা হয়। এই দুষ্টুচক্রে দীর্ঘদিন ধরে আবদ্ধ আমরা, বের হয়ে আসার স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই।
 
এই দুই বিষয়ের বাইরে ক্রিকেট সংস্কৃতি বলে একটা কথা আছে, যা খুব বেশি আলোচিত না। ভারতে যুগের পর যুগ বিশ্বনন্দিত ব্যাটসম্যানরা এসেছে কারণ নিজেদের দেশে সব প্রজন্মের জন্যই ব্যাটিং আইডলরা ছিল, একই কারণে পাকিস্তানে বিশ্বমানের পেস বোলাররা এসেছে। খুব বেশি পিছনে যেতে হবে না, আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছিল বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিন! নিজের চোখেই দেখেছি ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক ডানহাতি বোলার-ও বাঁহাতি স্পিনার হবার চেষ্টায় রত, বাঁহাতি পেসারদের কথা বাদ-ই দিলাম।
 
একটা সময় কিছুটা আশাবাদী ছিলাম। পেসার হান্ট থেকে উঠে আসা রুবেল ছাড়াও শফিউলের মত বোলার সাবেক বোলিং কোচ চম্পকা রামানায়েকের পরিচর্যায় হাই পারফরম্যান্স একাডেমি থেকে জাতীয় দলে জায়গা করে নেয়। জিম্বাবুয়ে ট্যুরে রবিউলকেও ভালো বল করতে দেখেছি। হাথুরুসিংহে কোচ হয়ে আসার পর ভারতের বিপক্ষে দেশের মাটিতে এক ওডিআই ম্যাচে চার পেসার- মুস্তাফিজ, তাসকিন, মাশরাফি, রুবেলকে খেলিয়ে সাফল্য পাই আমরা। আমি আশায় বুক বাঁধি, তবে কী আমরাও পেস বোলিংকে শক্তিশালী করার দিকে একধাপ এগিয়ে যাচ্ছি? আশার পালে হাওয়া লাগে কোর্টনি ওয়ালশের মত কিংবদন্তি আমাদের পেস বোলিং কোচ এর দায়িত্ব নেয়ায়। সে আশার গুড়ে দ্রুতই বালি পড়ে। স্বয়ং ওয়ালশ কোচ থাকাকালীন সময়ে টেস্টে নামেমাত্র একটা পেস বোলার তো খেলিয়েছি-ই, এক স্পেলের বেশি বল করেনাই এমন নজিরও নেহায়তে কম হবে না।
 
20246320_713495308853067_5598083649854417162_n
কিংবদন্তি ওয়ালশের সান্নিধ্যে পেস বোলিং শিষ্যরা।
 
ভারতের উদাহরণটা ঘটা করে দেয়ার কারণ, পরিবর্তনটা আমার চোখের সামনে ঘটেছে এবং এর ফলাফল ভারত এখন যেমন পাচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদেও পেতে থাকবে পরিবর্তনটা ক্রিকেট সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেলে। আমরা কি পারি না পেস বোলিং নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে ক্রিকেটের অবকাঠামো থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছুতে পরিবর্তন আনতে? সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে হয়তো ধীরগতিতে, এবং এর ফলাফল হবে দীর্ঘমেয়াদি কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় সদিচ্ছা আছে তো আমাদের?
 
ক্রিকেট খেলা দেখার দুই যুগ তো পার করে ফেললাম। আমাদের নিজেদের বিশ্বমানের ফাস্ট বোলার পাবার কত দেরি, পাঞ্জেরি?