• ক্রিকেট

তাহারেই পড়ে মনে

পোস্টটি ১৬১০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১.

পাকিস্তানের কিংবদন্তি বোলার ওয়াসিম আকরামের বিপক্ষে খেলেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের কাউকে যদি বলা হয় নিজেদের খেলা কঠিনতম তিনজন বোলার বেছে নিতে তবে ধরে নিতে পারেন অবধারিতভাবে সবার তালিকায় ওয়াসিম আকরামের নামটা থাকবে। আর সেই ওয়াসিমকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তার বিপক্ষে খেলা সেরা ব্যাটসম্যান কে, তিনি অনেকের নাম-ই বলেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছিলেন একজনকে। বলতে পারবেন কে সেই একজন? 

যদি উত্তরটি আপনার জানা না থাকে তবে প্রশ্নটি আপনাকে বেশ ভাবনায় ফেলে দেয়ার কথা। ওয়াসিম আকরাম তো আর কম গ্রেটদের বিপক্ষে বল করেন নি। তার চেয়ে বরং খেলোয়াড়টি সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

তিনি ছিলেন একজন অনুপ্রেরণাদায়ী অধিনায়ক যিনি সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিতে পছন্দ করতেন। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ফেভারিটের তালিকায় না থাকলেও বিশ্বকাপে সেই দল নিয়ে সেমিফাইনাল খেলেছেন এবং নিজে দুর্দান্ত পারফর্ম করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত-ও হয়েছেন। যেই দলটির কাছে হেরে বিশ্বকাপ স্বপ্ন শেষ হয়েছিল সেই দলটিই পরবর্তীতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় আর ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন সেই দলের ওয়াসিম আকরাম।

এতক্ষনে নিশ্চই বুঝে ফেলেছেন কার কথা বলা হচ্ছে। হ্যা, তিনি হলেন মার্টিন ক্রো। নিউজিল্যান্ডের প্রয়াত কিংবদন্তি ক্রিকেটার। তিনি ছিলেন তার সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। ইনজুরির কারণে মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই ক্যারিয়ার শেষ না হলে বিশ্ব ক্রিকেটের এই সুনিপুণ শিল্পীর কাছে আরো কিছু পাওনা বাকি ছিল। তবে সে পাওনা তিনি ঠিকই মিটিয়েছেন। খেলা ছাড়ার পর-ও তিনি ছিলেন অঙ্গাঙ্গিভাবে ক্রিকেটের সাথে জড়িত একজন। ছিলেন একজন অসাধারণ ক্রিকেট বিশ্লেষক, লেখক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ।

MartinCrowe3x2via @balabugs

১৯৯২ বিশ্বকাপের প্লেয়ার অব দা টুর্নামেন্ট মার্টিন ক্রো 

সদ্য সমাপ্ত বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সফলতা নিয়ে আইসিসি গর্ব করতেই পারে। জানেন কি, এই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ভাবনা যাদের কল্পনাপ্রসূত তাদের অন্যতম এই মার্টিন ক্রো।

২. 

এসব পরিচয় তো আছেই, তবে ক্রোর যেই পরিচয় আমার কাছে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী তা হল নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের প্রতি তার মাতৃসূলভ ভালোবাসা।

টেস্টে ক্রোর নিজের সর্বোচ্চ রান ছিল ২৯৯, যা ছিল নিউজিল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোরও। টেস্টে ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে ত্রিশতক ছুতে দেখে কী শিশুসুলভ উচ্ছাসটাই না প্রকাশ করেছিলেন ক্রো। ২০১৫ বিশ্বকাপে যেই ভয়ডরহীন ক্রিকেটের জন্য পরিচিতি পেয়েছিল নিউজিল্যান্ড সেই একইরকম খেলা ১৯৯২ বিশ্বকাপেও মার্টিন ক্রোর পরিকল্পনায় খেলেছিল নিউজিল্যান্ড। ওপেনিংয়ে মার্ক গ্রেটব্যাচের মতো বিগ হিটারকে পাঠিয়ে কিংবা নতুন বলে অফস্পিনার দীপক প্যাটেল কে আক্রমণে এনে বিশ্ব ক্রিকেটকে তিনি চমকে দিয়েছেলেন বললে ভুল হবে না। নিজের উদ্ভাবনী নেতৃত্ব, ট্যাকটিক্যাল ব্রিলিয়ান্স আর ব্যাক্তিগত পারফর্মেন্স দিয়ে দলকে সেমিফাইনালে তুলে আনেন। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে পড়ে রানার নিয়ে দুর্ভাগ্যজনক রান আউটের স্বীকার হওয়ার আগে নিজে খেলেন ৮৩ বলে ৯১ রানের ম্যাচের সর্বোচ্চ ইনিংস। দলকে পৌঁছে দেন ২৬২ রানের নিরাপদ সংগ্রহে। তবে ফাইনালের আগে ইনজুরি ত্বরান্বিত করার ঝুঁকি নিয়ে ফিল্ডিংয়ের সময় মাঠে না নামার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উল্টে পাল্টে যায় সব হিসাব। ইনজামাম ঝড়ে ভেঙে যায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন, যে আক্ষেপ তাকে আজীবন তাড়া করে ফিরেছে।

২০১৫ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ক্রিকেটবিষয়ক ওয়েবসাইট ইএসপিএন ক্রিকইনফোর জন্য লেখা এক কলামে তিনি নিজের হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসা জানিয়েছেন উত্তরসূরিদের। তিনি তখন প্রাণঘাতী ক্যান্সারের সাথে লড়ছেন। মেলবোর্নে অনুষ্ঠিতব্য ফাইনালই হতে যাচ্ছে তার শেষ মাঠে যাওয়া সে ঘোষণাও আগাম দিয়েছেন। নিজে ছিলেন দুর্দান্ত এক ব্যাটসম্যান, খেলোয়াড়ি জীবনে কত কত অর্জন আছে, ক্রিকেট মাঠে এত ঘটনার সাক্ষী তবু প্রিয় দলের খেলা সেই ফাইনালটাকে অভিহিত করেছেন নিজের ক্রিকেটীয় জীবনের সেরা হাইলাইট হিসাবে। হৃদয়ের সবটুকু আবেগ মিশিয়ে লেখা সেই কলামের প্রতিটি শব্দ ছুঁয়ে যাবে যে কোন পাঠককেই তা সে ক্রীড়াপ্রেমী হোক বা না হোক। ক্রো জানিয়েছেন খেলার ফলাফল যাই হোক না কেন, তিনি চোখের জলে ভিজেই উপভোগ করবেন তার জীবনের সেরা সময়টা।

বিশ্বকাপের বছর না ঘুরতেই মাত্র ৫৩ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান এই কিংবদন্তি। নিজের জীবদ্দশায় কায়মনোবাক্যে তিনি সর্বদা কামনা করতেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের বৈশ্বিক সাফল্য। বেঁচে থাকলে নিজের দেশকে বিশ্বসেরা হতে দেখলে কী আনন্দিতই না হতেন মানুষটা।

৩. 

নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ঘনিষ্ঠ যে কেউ জানেন মার্টিন গাপটিল এবং রস টেলর এই দুজন ব্যাটসম্যানকে ক্রো নিজের পুত্রজ্ঞান করতেন। সেই পুত্রসম গাপটিলকে ২০১৯ বিশ্বকাপে কয়েক ইঞ্চি ব্যবধানের জন্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার বুকভাঙা কষ্ট ভোগ করতে তিনি দেখেছেন পরপার থেকে। তবে ক্রিকেট বিধাতা যিনি, জীবনও তো তারই লেখা। ক্রিকেটকে তাই জীবনের মত করে হামেশাই লেখা হয়ে থাকে।

 323749

এবার আর পা হড়কানো নয়, শিরোপা নিশ্চিত করেই তবে মাঠ ছাড়ছেন উইলিয়ামসন-টেলর জুটি

ক্রোর পরম আরাধ্য বৈশ্বিক সাফল্য অর্জনের পথে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়শিপের ফাইনালে জয়সূচক রানটি এসেছে যে তারই আরেক পুত্র রস টেলরের ব্যাট থেকে সেটিতো ক্রিকেট মাতার প্রিয় সন্তানদের একজন মার্টিন ক্রোর অমোঘ নিয়তিই।

সাউদাম্পটনের রোজ বোলে শেষ বিকেলের রোদের ছটায় টেলরের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি দেখে মার্টিন ক্রোর সদাহাস্য মুখখানা কারো মনে পড়লে তাকে কি দোষ দেওয়া যায়?