• ক্রিকেট

মন্থর উইকেটে সাকিবের ভিন্নরকম ব্যাটিং মাস্টারক্লাস

পোস্টটি ৮১৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১.

২০১৯ বিশ্বকাপের পর ওয়ানডেতে বিদেশের মাটিতে এই প্রথম রান তাড়া করে ম্যাচ জিতলো বাংলাদেশ। সময়ের হিসেবে দুই বছর এক মাস নিতান্ত কম নয়। যদিও এর মাঝে বিদেশের মাটিতে খুব বেশি ম্যাচ খেলেওনি বাংলাদেশ। তবে বিদেশের মাটিতে অধরা জয় নয়, এ লেখায় রান তাড়া করে জেতার প্রসঙ্গ টানার কারণ ভিন্ন। শেষবার বিদেশের মাটিতে জেতা ম্যাচটা বাংলাদেশের যেকোন ক্রিকেট ভক্তেরই মনে থাকার কথা। বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে উইন্ডিজের বিপক্ষে ৩২২ রান তাড়া করতে নেমে প্রায় আট ওভার হাতে রেখে কী দাপুটে জয়টাই না পেয়েছিল বাংলাদেশ সেদিন। 

চলমান জিম্বাবুয়ে-বাংলাদেশ সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশের জয়টার সাথে সেদিনের জয়ের ব্যবধান আকাশ-পাতাল বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। সেদিন যেখানে মাত্র ৩টি উইকেট পড়েছে, এ ম্যাচে সেখানে ৩টি উইকেট হাতে রেখে জয় এসেছে। এই আপাত বৈপরীত্য সত্ত্বেও দুটি ম্যাচকেই একটি বিন্দুতে মিলিয়ে দিচ্ছেন কিন্তু একজন। ঠিকই ধরেছেন, সেই একজন হলেন সাকিব আল হাসান। 

সেদিন ১২৪ রান করে অপরাজিত থেকে ম্যাচ জেতানো সাকিব এ ম্যাচেও খেলেছেন ম্যাচ জেতানো হার না মানা ইনিংস। ম্যাচ দু'টির মতো ইনিংস দু'টিতেও একইরকম বৈপরীত্য লক্ষ্যণীয়। সেদিনের ইনিংসের মতো স্ট্রোকের ফুলঝুড়ি ছড়ানো ইনিংস না হলেও এ ম্যাচের ইনিংসটিও কেন ওডিআই মাস্টারক্লাস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এ লেখাটিকে মূলত সেটিই বিশ্লেষণ করে দেখার ক্ষুদ্র চেষ্টা বলা যায়। সাকিবের ব্যাটিং নান্দনিকতার মানদন্ডে কখনোই বিচার্য ছিল না। এমনকি বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিংয়ে স্বাভাবিক যে এলিগ্যান্স আছে, সাকিবের ব্যাটিংয়ে সেটিও নেই। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী সাকিব যখন স্বভাবসূলভ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে বল বাউন্ডারি ছাড়া করেন তা দেখতে যতটা উপভোগ্য এ ম্যাচের ৯৬ রানের ইনিংস সেরকমও নয়। এতদস্বত্বেও ধীরগতির উইকেটে দ্রুত উইকেট হারিয়ে চাপের মুখে কীভাবে ব্যাট করে ম্যাচ জেতানো যায় তার অনন্যসাধারন নমুনা এ ইনিংস।

পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়ে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যখন প্যাভিলিয়নে ফেরত যান, বাংলাদেশ তখনো জয় থেকে ১০০র চেয়ে বেশি রান দূরে। খেলোয়াড়দের মানসিক দৃঢ়তা দেখানোর সুযোগ থাকে যেসব পরিস্থিতিতে সেরকম আদর্শ পরিস্থিতি পেয়েও পরের দুই তরুণ ব্যাটসম্যান মিরাজ এবং আফিফ সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলেন না। 

 

২. 

ক্রিকেটে মানসিক দৃঢ়তার ভূমিকা যে কত বড় তার অনন্য উদাহরণ ম্যাচ জেতানো এ ইনিংসে দেখিয়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। ম্যাচ পরবর্তী ব্রিফিংয়েও সাকিব বলেছেন, ক্যারিয়ারের এ পর্যায়ে এসে প্রস্তুতি যতটা না টেকনিক্যাল বা ফিজিক্যাল তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক। বেশ কয়েক ম্যাচ ধরেই সাকিবের ব্যাটে রান নেই। যদিও শ্রীলংকা সিরিজের আগে উইন্ডিজের বিপক্ষে এক ইনিংসে অর্ধশতক ও আরেক ইনিংসে চল্লিশের বেশি রান করেছেন তবুও সাম্প্রতিক সময়ে আইপিএল বা ঘরোয়া টি-টুয়েন্টি লিগেও রান না পাওয়াতে সে সময়টাকে অনেক দীর্ঘ কাল আগের বলেই মনে হচ্ছিল। টি-টোয়েন্টি আর ওডিআই আলাদা ফরম্যাট হলেও রান তো সবসময়ই আত্মবিশ্বাস জোগায় আর রান-খরা উল্টোটা ঘটায়। সাকিব মুখে না বললেও তার ব্যাটিং যে প্রত্যাশা মতো হচ্ছিলো না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যাটিংয়ের এপ্রোচ দেখেও কিছুটা আন্দাজ করা যাচ্ছিলো যে ব্যাট হাতে খুব ছন্দে নেই সাকিব। হারারে টেস্টের প্রথম ইনিংসে বা এ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতেও ক্রিজে এসেই যে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছেন সেটি হয়তো দ্রুত কিছু রান তুলে নেওয়ার বাসনায়। ভুল থেকে দ্রুত শিখতে পারার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সাকিব এ ম্যাচে সাম্প্রতিক অতীতের ম্যাচগুলোর মতো অতিরিক্ত চিন্তা না করে বরং বল-বাই-বল খেলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ব্যাটিংয়ে খারাপ সময় কাটিয়ে উঠতে যেকোন ভালো ব্যাটিং কোচ ব্যাটসম্যানকে বলবেন বাড়তি কিছু করতে চেষ্টা না করে নিজের শক্তিমত্তার জায়গায় স্থির থাকতে। সাকিবও নিজের শক্তির জায়গা 'ভি' তেই সব চেয়ে বেশি রান করেছেন। আদর্শিকভাবে লংঅফ থেকে লংঅন 'ভি' রিজিয়ন হলেও সাকিবের শক্তিমত্তার জায়গা ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট থেকে লং অফ পর্যন্ত বৃত্তচাপ। এই বর্ধিত 'ভি' তে তিনি ইনিংসের ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৪৮ রান করেছেন। ব্রেন্ডন টেলর সাকিবের শক্তির জায়গা বুঝে অফ-সাইডে বাড়তি ফিল্ডার রেখে লেগ সাইডে খেলার টোপ দিয়েছেন। টেলরের পাতা ফাঁদে পাঁ  দিয়ে লেগ সাইডে খেলতে গেলে উইকেটের ধীরগতির কারনে বল দেরিতে ব্যাটে আসায় লিডিং এজ হয়ে যাওয়ার জোড়ালো সম্ভাবনা থাকে। এরকম সফ্ট ডিসমিসাল ক্রিকেটে হরহামেশাই দেখা যায়। বুদ্ধিমান সাকিব টোপ না গিলে বরং টেলরের ট্রাম্পকে ওভারট্রাম্প করেছেন অফসাইডেই রান করে।   

 

Shakib   সাকিব স্থির থেকেছেন নিজের শক্তিমত্তার জায়গাতেই। ছবি-ক্রিকইনফো।

 

৩.

ওডিআই সুপার লিগের ২য় বনাম ১৩তম দলের ম্যাচে বাংলাদেশের যতটা না পাওয়ার তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল হারানোর। ম্যাচটি জিতলে সেটিই স্বাভাবিক কিন্তু হেরে গেলে মহামূল্যবান দশ পয়েন্ট তো হারাতোই বাংলাদেশ পাশাপাশি সম্ভাব্য পূর্ণ শক্তির দল নিয়ে জিম্বাবুয়ের কাছে হারার মাশুল দিতে হত সমালোচনার কাঁটাতারে বিদ্ধ হয়ে। এরূপ পরিস্থিতিতে অপরপ্রান্তে দ্রুত উইকেট পড়ে পরাজয় যখন চোখ রাঙানি দিচ্ছিলো তখন চরম মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে এক প্রান্ত আগলে রাখেন সাকিব। তিনি যেন পণ করেই নেমেছিলেন দলকে জিতিয়ে তবেই মাঠ ছাড়বেন। বাংলাদেশের ইনিংসের শেষ ১৯ ওভারে বাউন্ডারি এসেছে মাত্র তিনটি, মাঝের ১৪ ওভারে তো একটিও বাউন্ডারি নেই। তাতে কী, সাকিব নিজের গেম সেন্সের দারুন নিদর্শন দেখিয়েছেন এ সময়ে। সাদা বলের ক্রিকেট মানেই যে শুধু চার-ছয়ের খেলা নয় সেটির আদর্শ প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকবে এ ইনিংসটি। ওয়ানডে ক্রিকেটের তিনটি পর্যায়ের সব চেয়ে লম্বা যে পর্যায় মিডল ওভার্স- অর্থাৎ একাদশ থেকে চল্লিশতম ওভার- সে সময়ে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের প্রধান সমস্যা স্ট্রাইক রোটেট করতে না পারা। প্রথম পাওয়ার প্লেতে ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার সুযোগ নিয়ে ব্যাটসম্যানরা দ্রুত রান করতে পারলেও মাঝের ওভারগুলোতে রানের চাকা শ্লথ হয়ে যাওয়াটাই বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে স্বাভাবিক ব্যাপার। সাকিবের ইনিংসের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ব্যাপার ছিলো এই স্ট্রাইক রোটেশন। টেলরের ছড়িয়ে দেওয়া ফিল্ডিংয়ের সর্বোচ্চ সুযোগ নিয়ে বড় শট খেলে বাউন্ডারি না মেরে বরং গ্যাপ বের করে সিঙ্গেল-ডাবলস নিয়ে রানের চাকা দারুণভাবে সচল রেখেছেন সাকিব। মন্থর উইকেটে আরো একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়- বল যখন ঠিকমতো ব্যাটে আসে না ব্যাটসম্যান তখন চাপে পড়ে বাড়তি কিছু করতে চেয়ে ভুল শট খেলে উইকেট বিসর্জন দিয়ে আসেন। নিজের স্মার্টনেস দিয়ে জিম্বাবুয়ের ফিল্ডারদের সাথেও দারুন মানসিক খেলা খেলে প্রতিপক্ষের দিকে বরং চাপটা ট্রান্সফার করে দিয়েছেন সাকিব। শট খেলেই দ্রুত রান নেওয়ার চেষ্টা করায় ফিল্ডার তাড়াহুড়ো করে মিস ফিল্ডিং করলে সাকিব ১ রান কে ২ রান বা ২ রানকে ৩ রানে পরিণত করার প্রতিটি সুযোগ ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছেন। এমনকি বয়সে অনেক নবীন সাইফুদ্দিনের চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুটেছেন রান নিতে। অভিজ্ঞতার মূল্য যে ক্রিকেটে কত বেশি সেটিও তিনি আজ বুঝিয়েছেন। সাইফুদ্দিন যখন ৩ রান নিয়ে ক্রিজে ব্যাট প্লেস করেও প্রায় ১০ গজ সামনে চলে গেছেন, সাকিব তখনো মরিয়া হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যদি ওভার থ্রো থেকে অতিরিক্ত এক রানের সুযোগ পাওয়া যায়। এসব আপাত দৃষ্টিতে ছোটোখাটো কিন্তু দারুন কার্যকর মুহূর্তগুলোই বড় খেলোয়াড় আর সাধারণ খেলোয়াড়দের পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। 

চাপের মুখে ম্যাচ জেতানো সাকিবের জন্য নতুন কিছু না, এ ধরণের পরিস্থিতিতে আগেও ম্যাচ জিতিয়েছেন সাকিব। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের সাথে পর্বতসম চাপে তো চোখ ধাঁধানো সেঞ্চুরিও করেছেন। বিপরীতে এ ম্যাচে ৪ রানের জন্য তিন অংক ছুতে না পারলেও এই রানের মাহাত্ম কত বেশি সেটি বোঝা যাবে এ তথ্য থেকে-সাকিবকে হিসেবের বাইরে রাখলে বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান ত্রিশ রানও করতে পারেনি। এ ইনিংসটি আরো একটু বিশেষত্ব পাচ্ছে দলগত চাপের পাশাপাশি ব্যাটিংয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সাকিবের ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের কারনে। হোক না প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, উঠতি ক্রিকেটারদের জন্য চাপের মুখে মন্থর উইকেটে কীভাবে ব্যাট করতে হয় সাকিবের ৯৬ রানের ইনিংস তার একটি ট্যাকটিক্যাল মাস্টারক্লাস বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।