• ফুটবল

ব্যাটল অব সান্তিয়াগো ও ফুটবলে কার্ডের প্রচলন

পোস্টটি ১৮৪৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
ফুটবল খেলাটা প্রকৃতপক্ষে একটা শিল্প। আপনি যদি নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন, মাঠে প্রতিটি খেলোয়াড় কি সুনিপুণ ভাবে দুই পায়ের জাদুতে ২২ সেন্টিমিটার ব্যাসের বল টা কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। সেই সাথে অসাধারণ সব ড্রিবলিং, পাসিং, থ্রোয়িং, ট্যাকলিং, ক্রসিং, ক্লিয়ারিং...সাথে নানান রকমের, নানান ধাঁচের বিভিন্ন শট তো আছেই। ২২ জন খেলোয়াড় ৯০ মিনিট ধরে মাঠে যেন এক পূর্ণাঙ্গ নান্দনিক শৈলী রচনা করে।
 
কিন্তু এ সুন্দর শৈল্পিক খেলাটিতেও  মাঝে মাঝে এমন কিছু নোংরা ঘটনা ঘটে, যা এর সৌন্দর্য পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়।
 
image_search_1615667636319
 
১৯৬২ সাল। সে বছর বিশ্বকাপের আসর বসে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ চিলিতে। সেবার চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে মোট ১৬ টি দেশ বিশ্বকাপে অংশ নেয়। গ্রুপ বি তে স্বাগতিক চিলির সঙ্গী হয়েছিলো ইউরোপিয়ান পরাশক্তি ইতালি, পশ্চিম জার্মানি ও সুইজারল্যান্ড। 
 
ফুটবল শক্তিতে বেশ পিছিয়ে থাকা দেশ চিলিতে বিশ্বকাপ হচ্ছে, ব্যাপারটি মেনে নিতে পারেনি তৎকালীন দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালি। গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে সেই চিলিরই মুখোমুখি হতে হয় ইতালিকে।
 
কিন্তু ম্যাচের আগেই এক নোংরা খেলায় মেতে ওঠে ইতালির কিছু সাংবাদিক। শুরুটা করেন দুই বিশিষ্ট ইতালিয়ান সাংবাদিক আন্তোনিও ঘিরেল্লি ও করাদো পিজিনেলি। ইতালির তৎকালীন সবচেয়ে বড় পত্রিকা "করিয়েরে দেল্লা সেরা"র সাংবাদিক ছিলেন আন্তোনিও ঘিরেল্লি। আর ফ্লোরেন্সের পত্রিকা "লা নাজিওনাল"এ লেখালেখি করতেন পিজিনেলি।
 
ম্যাচ শুরুর আগেই তারা দুজন চিলিকে নিয়ে লিখলেন অসংখ্য নোংরা কথা বার্তা। পিজিনেলি লিখলেন যে, চিলি অশিক্ষিত, মূর্খ, অপুষ্টিতে ভোগা দরিদ্র একটি দেশ। জঘন্য পিছিয়ে পড়া একটি দেশ, যার জনগোষ্ঠীর কাজই হল মদ খাওয়া। আর দেশটা সম্পূর্ণরূপে একটা পতিতালয়। ওদিকে ঘিরেল্লি লিখলেন, ১৯৬০ সালে ইতিহাসের ভয়ংকরতম ভূমিকম্পের শিকার হওয়া চিলি কিভাবে ১৯৬২ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারছে, সেটা তিনি ভেবে পান না। তাদের বিশ্বকাপ আয়োজন করতে চাওয়া আর বেনিতো মুসোলিনির লণ্ডনে বিমানবাহিনী পাঠিয়ে বোমা ফেলা একই কথা (মুসোলিনি কখনো লণ্ডনে বিমানবাহিনী পাঠিয়ে বোমা ফেলেননি)। পশ্চাৎপদ এক দেশ চিলি, যেখানে ফোন কাজ করেনা। পুরো দেশের মধ্যে ৭০০টা হোটেলের বিছানা আছে। আর সেখানে ট্যাক্সি পাওয়া আর বিশ্বাসী স্বামী পাওয়া একইরকম কঠিন।
 
তাদের নোংরা কথা বার্তায় ক্ষেপে উঠলেন চিলির সাংবাদিকরাও। মুসোলিনির কুখ্যাত ইতিহাস, ইতালিয়ান ফুটবলে ম্যাচ পাতানোর অসংখ্য নোংরা কুকীর্তি ও ডোপিং কেলেঙ্কারি নিয়ে লেখালেখি শুরু করলেন তাঁরা। ইতালিকে আখ্যায়িত করলেন একটি মাফিয়া, ফ্যাসিস্ট আর ড্রাগ আসক্ত দেশ হিসেবে। 
 
image_search_1615667680357
 
ব্যাপারটি শুধু লেখালেখির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। চিলির লোকেরা ইতালির প্রতি এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে গিয়েছিল যে সান্তিয়াগোর রাস্তায় একজন আর্জেন্টাইনকে ইতালিয়ান ভেবে তারা বেধড়ক পিটুনি দেয়। 
 
ফলে এ ম্যাচটি যে স্বাভাবিকভাবে শেষ হবেনা সেটা অনুমান করাই যাচ্ছিল। তাই ইতালিয়ানরা ফিফার কাছে স্প্যানিশ রেফারির বদলে একজন ইংলিশ রেফারি দেওয়ার আবেদন করে। ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পান ইংলিশ রেফারি কেন অ্যাস্টন। 
 
এটি যে বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম কুৎসিত একটি ম্যাচ হতে যাচ্ছে, তা ম্যাচ শুরুর পরপরই আঁচ পাওয়া যেতে থাকে। ম্যাচের ১২ সেকেন্ডেই প্রথম ফাউল দেখে এই ম্যাচ। অতঃপর ১২ মিনিটের মাথায় চিলির হনোরিনো ল্যান্ডাকে ফাউল করার দায়ে ইতালিয়ান মিডফিল্ডার জর্জিও ফেরিনিকে মাঠ থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন রেফারি অ্যাস্টন। কিন্তু রেফারির কথা বুঝতে না পেরে ফেরিনি মাঠ থেকে বের হতে না চাইলে পরে পুলিশ এসে তাকে মাঠ থেকে বের করে নিয়ে যায়। এরপর চিলির লেফট উইঙ্গার সানচেজ ইতালির ডিফেন্ডার মারিও ডেভিডকে একটা ঘুষি মারে, যা রেফারি কেন অ্যাস্টনের চোখ এড়িয়ে যায়। পরে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে মারিও ডেভিড সানচেজের মাথায় একটা লাথি মারার চেষ্টা করে। আর সেটা দেখে ফেলেন কেন অ্যাস্টন। আর তা দেখে ডেভিডকে বের করে দেন মাঠ থেকে।
 
ইতালির আর্জেন্টাইন-বংশোদ্ভুত স্ট্রাইকার হামবার্তো মাশ্চিওকে 'প্রতারক' বলে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেন এই সানচেজই, কিন্তু সেটাও অ্যাস্টনের চোখ এড়িয়ে যায়। পুরো ম্যাচে ফুটবল খেলার প্রতি একটুও মনোযোগ ছিলোনা কোনো দলের। উভয় দলেরই মূল লক্ষ্য ছিল কিভাবে প্রতিপক্ষকে আঘাত করা যায়। পুরো ম্যাচে তিনবার পুলিশকে মাঠে এসে পরিস্থিতি শান্ত করতে হয়েছিল।
 
পরবর্তীতে ইংলিশ রেফারি কেন অ্যাস্টন এই ম্যাচ সম্পর্কে বলেন, “আমি সেদিন কোন ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করিনি, আমি সেদিন একটা মিলিটারি যুদ্ধের আম্পয়ার হিসেবে কাজ করছিলাম।”
 
image_search_1615667719644
 
বিবিসি’র সাংবাদিক ডেভিড কোলম্যানের মতে, এই ম্যাচটা ছিল ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ম্যাচ, ফুটবলের সবচাইতে জঘন্যতম প্রদর্শনী হয়েছিল এই ম্যাচেই।
 
তার চার বছর পরের কথা। বিশ্বকাপ ১৯৬৬। সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ড। ম্যাচের এক পর্যায়ে বেশ কঠিন এক ফাউল করেন আন্তোনিও রাতিন। তাকে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন রেফারি রুডি ক্রেইটলেন। ইংরেজিতে রাতিন রেফারির কথা না বুঝে দাঁড়িয়ে রইলেন মাঠেই। পরে হাতের ইশারায় বুঝতে পারলেন। এমন ঘটনা তখন ঘটতো প্রায়শই।
 
তবে রাতিন যখন মাঠ ছাড়ছিলেন তখন নালিশ জানান, এমন ফাউল তো ইংলিশ খেলোয়াড়রাও করেছে। দুইজন খেলোয়াড়ের করা ফাউলের কথা উল্লেখ করেন তিনি। তবে ইংলিশ দুই খেলোয়াড়ের ফাউল একই রকম হলেও ভয়াবহতা কিছুটা কম ছিলো। কিন্তু এ যুক্তি মানতে নারাজ আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। শেষ পর্যন্ত মানলেও ক্ষোভটা থেকেই যায়।
 
image_search_1615667821796
 
চিলি বিশ্বকাপের পর এবার আবারও একই রকম বিতর্ক সৃষ্টির বিষয়টি ব্যাটল অব সান্তিয়াগোর রেফারি অ্যাস্টনকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। বিশ্বকাপ নানান দেশের, ভাষার, সংস্কৃতিরও মিলনমেলা। রেফারির ভাষা মাঠের খেলোয়াড়েরা না-ও বুঝতে পারেন। তাই এ সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে থাকেন তিনি।
 
এসব ভাবতে ভাবতেই একদিন গাড়ি চালাচ্ছিলেন তিনি। কিংস্টন হাইস্ট্রিটে ট্র্যাফিক সিগনালে আটকা পরে গাড়ি। আর সিগনালে তাকিয়েই বুদ্ধিটা মাথায় খেলে যায়। সবুজ বাতি মানে চলতে থাকো। লাল বাতি মানে থেমে যাও। মাঝে ক্ষণিকের জন্য হলুদ বাতি জ্বলে। মানে সতর্ক থাকো, এখনই জ্বলবে সবুজ বাতি। তখনই ভাবলেন মাঠেও তো খেলোয়াড়দের এভাবে সতর্ক করা যেতে পারে।
 
তার ভাবনার কথা ফিফার কাছে জানান অ্যাস্টন। আর ফিফাও তার কথার গুরুত্ব দেয়। ১৯৭০ সালে প্রথমবার মেক্সিকো বিশ্বকাপে পরীক্ষামূলক ভাবে কার্ড ব্যবহার করা হয়। তবে সে বছর কেউ লাল কার্ড পায়নি। ১৯৭৪ সালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে চিলির কার্লোস কাসজেলি বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম লাল কার্ডটি দেখেন। এরপর এর উপকারিতা দেখে নিয়মিতই ব্যবহার হয়ে আসছে ফুটবলে।
 
তারপর থেকে আজ অবধি এই কার্ডের ব্যবহার কে কেন্দ্র করে ঘটেছে অসংখ্য অদ্ভুত ও স্মরণীয় ঘটনা। তার মধ্যে ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইতালিয়ান ফুটবলার মার্কো মাতেরাজ্জিকে মাথা দিয়ে ধাক্কা দেওয়ার দায়ে ফ্রান্স অধিনায়ক জিনেদিন জিদানকে দেখানো লাল কার্ডের ঘটনা তো কিংবদন্তিই হয়ে আছে। অনেকের মতে এ লাল কার্ডের জন্যই সেবার বিশ্বকাপ হাতে তুলতে পারেনি ফ্রান্স।
 
image_search_1615667970300
 
সম্প্রতি ফিফা লাল ও হলুদ কার্ডের পাশাপাশি সবুজ কার্ডেরও প্রচলন করেছে। তবে এটা শাস্তিস্বরূপ না, বরং পুরস্কার স্বরূপ ব্যবহার করা হবে। ইতালির ফুটবলের দ্বিতীয় বিভাগ সিরি বি তে এর ব্যবহার ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। ম্যাচে ফেয়ার প্লের পুরস্কার স্বরূপ দেওয়া হচ্ছে এ সবুজ কার্ড। আর মৌসুমে সবচেয়ে বেশি যিনি সবুজ কার্ড দেখবেন, মৌসুম শেষে তাকে বিশেষ সম্মাননায় পুরস্কৃত করা হবে।
 
লাল-হলুদ-সবুজ নানান রঙের কার্ডের ব্যবহার সত্যিকার অর্থেই ফুটবলকে করেছে আরও রঙিন, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল।