• ফুটবল

ইউরোপিয়ান সুপার লীগ , রাজনীতি এবং ব্যবসা

পোস্টটি ১২০৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সাম্প্রতিক ইউরোপিয়ান সুপার লীগ নিয়ে শুধুমাত্র ফুটবল বিশ্বে নয় পুরো বিশ্বে তোলপাড় চলছে! কিন্তু এই সুপার লীগ আয়োজনের পেছনের দুর্ধর্ষ রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক সমীকরণ আছে ।যেটা আমাদের অনেকের অজ্ঞাত!

আসুন জানার চেষ্টা করে কিসের জন্য,কারা এই এই ইউরোপিয়ান সুপার লীগ আয়োজন করছে এবং এর পেছনে উদ্দেশ্যই বা কি?

source:skysports
মুলত এই ১২ টি ক্লাবের সমন্বয়ে সুপার লীগ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা

ওয়াল স্ট্রিট দানব এবং আমেরিকান বিনিয়োগকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক জেপি মর্গান উয়েফা সুপার লিগের প্রধান হোতা! এই টুর্নামেন্টের জন্য ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে তারাই মূলত! ব্রেক্সিটের কারণে জেপি মর্গান ব্রিটেন থেকে তাদের ব্যাবসা তুলে জার্মানিতে স্থানান্তর করতে হচ্ছে। এই ক্ষতির কিয়দাংশ সুপার লীগ করে সামাল নেওয়া,সাথে বিরাট অর্থনৈতিক ফায়দা তোলা অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে জেপি মর্গানের। জেপি মর্গানের সাথে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা পৃথিবীতে খুব কম আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আছে।

source :nypost
ইউরোপিয়ান সুপার লিগে ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে জেপি মরগান

রিয়াল মাদ্রিদের অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী এবং ঘরের লোক স্প্যানিশ বিলিয়নিয়ার বোর্জা প্রাদো এই টুর্নামেন্টের অন্যতম বিনিয়োগকারী! তিনি আবার পেরেজের ব্যাবসায়িক পার্টনার এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু।তবে পেরেজ এবং বোর্জা প্রাদো শুধু মাত্র সামনের ক্রীড়নক। ইউরোপিয়ান সুপার লীগ আয়োজনে তাদের ভূমিকা অনেকটা মিডিয়া ম্যানেজারের।

source: https://www.lainformacion.com/opinion/daniel-toledo/borja-prado-oscar-al-mejor-secundario-en-el-drama-de-endesa/6493368/
পেরেজ   ও বোর্জা প্রাদো

বিটি স্পোর্টস এবং স্কাই স্পোর্টস এর দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের একটা দফারফার যোগসূত্র হতে পারত এই সুপার লীগ! ইপিএল এর জন্য প্রায় এক বিলিয়ন ডলার, ইউরোপা,এবং চ্যাম্পিয়নস লিগের জন্য ১.২ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে চার বছরের ব্রডকাস্টিং রাইটস কিনে স্কাই স্পোর্টসকে একেবারে খোঁড়া করে দিয়েছে বিটি স্পোর্টস। এই ক্ষতি পোষানোর জন্য হলেও ও স্কাই স্পোর্টস এর নতুন আমেরিকান মালিক সুপার লীগের অন্যতম ছায়া উদ্যোক্তা।তবে সুপার লীগের কমিটির প্ল্যান ভিন্ন টিভি রাইটস নিয়ে! কয়েকটা মিডিয়া মুঘলকে টিভি রাইটস দিয়ে মুনাফা বাড়ানো মূল লক্ষ্য এবং সাথে বিটি স্পোর্টস এর একচেটিয়া প্রভাব কমানো। কারণ বিটি স্পোর্টস যুক্তরাজ্যের মালিকানাধীন। গুঞ্জন আছে কোমকেস্ট এবং আমাজন ও অনলাইন প্লাটফর্ম হিসেবে যোগ দিতে পারে সম্প্রচার যুদ্ধে। সুপার লীগের উদ্যোক্তাদের প্ল্যান মূলত একসাথে অনেক প্লাটফর্ম দিয়ে সম্প্রচার করিয়ে মিডিয়া থেকে কয়েক গুণ বেশি মুনাফা উঠিয়ে নেওয়া এবং নব্য আমেরিকান মালিকানাধীন স্কাই স্পোর্টসকে হাইপে তুলে দেওয়া।হ্যা আমাজন,কোমকেস্ট(এনবিসির মালিকানাধীন), স্কাই স্পোর্টসের মালিকানা এখন আমেরিকান,সকলের মাঝে যোগসূত্র রয়েছে।

https://www.broadbandchoices.co.uk/reviews/bt-sport-vs-sky-sports
যুদ্ধ চলছে বিটি স্পোর্টস বনাম স্কাই স্পোর্টস

সম্প্রচার যুদ্ধ মূলত যুক্তরাষ্ট্র বনাম যুক্তরাজ্যের। বিটি স্পোর্টস বনাম স্কাই স্পোর্টস।

ফুটবল নামক লাভজনক ব্যবসায় আমেরিকান ব্যাবসায়ীরা বরাবর পিছিয়ে,এই ব্যাবসায় নেমে পড়া অন্যতম উদ্দেশ্য হতে পারে সুপার লীগের পেছনে। উয়েফা সুপার লীগের কাঠামোর পেছনে অনেক বছরের শ্রম,বিনিয়োগ জড়িত।

এখন বিশ্বের প্রধান প্রধান ক্লাবগুলোর মালিক কারা খোঁজ করলে দেখবেন বড় বড় তেল,গ্যাস,খনিজ সম্পদ উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো,এখন বিনিয়োগকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছুটছে কাঠামোকে ধরে টান দিতে। ফুটবল ক্লাবের আড়ালে মূলত ব্যাবসায়ীরা তাদের সাম্রাজ্য লুকিয়ে রাখে,যেটা আমাদের অনেকের অজানা!

ম্যানইউ, লিভারপুলের বর্তমান মালিকপক্ষ সরাসরি আমেরিকান বিনিয়োগ ব্যাবসার সাথে জড়িত। চেলসির মালিক রাশিয়ান হলেও তার বিরাট বিনিয়োগ ইউরোপ জুড়ে এবং তার মাইনিং ব্যবসার প্রধান ক্রেতা ইউরোপে,তার ইজরাইলের নগরিকত্ব ও আছে ব্যাবসায়িক সুবিধার জন্য। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ইপিএল এর প্রত্যেকটা ক্লাব কেন বিশ্বের অধিকাংশ আলোচিত ক্লাবের মালিক পক্ষ বড় বড় ধনকুবরা। এদের কাছে ব্যবসা বড় ফুটবলের চাইতে,এবং এরা সাম্রাজ্য বাড়তে ফুটবল কিংবা ক্লাব ব্যবসায় বিনিয়োগ করে।

https://www.gazprom.com/f/1/gazprom-logo-en-3.png
ফুটবলকে ব্যবসা সম্প্রসারণের কাজে লাগিয়েছে গ্যাজপর্ম

রাশিয়ান গ্যাস ও খনিজ উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাজপর্ম
পুরো ইউরোপে কয়েকটি ক্লাবের সরাসরি এবং ছায়া মালিকানায় আছে।শালকে জিরো ফোর, রেড স্টার বেলগ্রেড, জেনিত সেন্ট পিটার্সবার্গ (মালিক+ স্পন্সর) এবং চেলসির অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী। সবচেয়ে মজার ব্যাপার গ্যাজপর্ম হচ্ছে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং বিশ্বকাপের প্রধান স্পন্সর। রাশিয়ান কোম্পানিগুলো নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে গোপনে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে ফুটবল বিশ্বে।
জার্মানির প্রধান ক্লাবগুলোর অধিকাংশ প্রধান স্পন্সর রাশিয়ান এবং কিছু ক্লাবের মালিক রাশিয়ান,সেজন্যই মূলত জার্মানির কোন ক্লাব যোগ দিবেনা সুপার লিগে,যদিও জার্মানির ক্লাব গুলোয় সমর্থকদের মতামতের গুরত্ব আছে বা ক্লাবের সিদ্ধান্তে ফ্যানদের ভোটের বিশেষ গুরুত্ব আছে! জার্মানি ই ইউর সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ এবং তাদের ফুটবল ফেডারেশনের উপর সরকারের প্রভাব অনেক বেশি। ফলে স্বভাবত ই ইউ এবং জার্মান সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে সুপার লীগে অংশ নিবেনা বুন্দেসলিগার কোন দল।

ইউরোপের কয়েকটি দেশে রাশিয়ান কোম্পানি গুলো ক্লাব কিনে বসে আছে তাদের ব্যাবসার পরিধি বাড়ানোর জন্য,আমেরিকান বিনিয়োগকারীরা গত কয়েক দশকে অনেকগুলো ইয়োরোপের অনেকগুলো প্রধান ক্লাবের মালিক হয়েছে তাদের ব্যাবসায়িক সাম্রাজ্যের বিস্তারের জন্য। এই অথচ আমরা বোকা ফ্যানরা এই রাজনীতি বা ব্যবসা ধরতে পারিনা।

রাশিয়ানদের একচেটিয়া ব্যাবসায় ভাগ বসাতে মূলত আমেরিকান বিনিয়োগকারীদের দৌড়ঝাঁপ করে মাঠে নামা উয়েফা সুপার লীগ আয়োজনের জন্য, যদিও মাঠের অনেক কারণ দায়ী সুপার লীগ আয়োজনের জন্য।আমেরিকা এবং তাদের বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্য যেকোন মূল্যে ফুটবলের বিলিয়ন ডলারের মার্কেট দখল করা ।

এই যুদ্ধটা মূলত আমেরিকা আর রাশিয়ার আরেক যুদ্ধ, সাথে ইইউ,ব্রিটেন ও আছে। ইইউ,ব্রিটেনের সাম্প্রতিক বেক্সিট ইস্যুতে ভয়াবহ মতবিরোধ থাকলেও সুপার লীগ ইস্যুতে উভয়ই একাট্টা! কারণ ইউরোপিয়ান সুপার লীগ হলে ইউরোপিয়ান লীগগুলো বিরাট আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে,সাথে তাদের অর্থনীতি বিরাট ধাক্কা খাবে। কারণ তো সবাই জানেন।ফলে স্বভাবত ব্রিটেন এবং ইইউ এই সুপার লীগের বিপক্ষে থাকবে নিজেদের আর্থিক দিক বিবেচনা করে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক ধনকুবের মালিকানা আছে ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে ,তবে তারা বৈশ্বিক রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক।

https://i.guim.co.uk/img/media/fc0bd212ff299e3c053924f2908797e1cb03a89c/0_75_2216_1330/master/2216.jpg?width=1200&height=1200&quality=85&auto=format&fit=crop&s=45cfad3254be362b346287ed8ff2b807
ব্রেক্সিট ইস্যুতে ই ইউ ব্রিটেনের সম্পর্ক সাপে নেউলে হলেও সুপার লীগ ইস্যুতে একাট্টা উভয় পক্ষ

তবে অনেক ক্লাব ইতিমধ্যে সুপার লীগ থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে বিশেষ করে ইপিএলের ক্লাবগুলো। যেসকল ক্লাব সরে গিয়েছে তাদের প্রত্যেকের মালিকের তেল অথবা মাইনিং বিজনেস আছে, ইউরোপের দেশগুলো তাদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা।একটা ক্লাবের জন্য মালিকপক্ষ তাদের ব্যবসার সাম্রাজ্যের বারোটা বাজাবে না। ইইউ অনেক শক্তিশালী, ইইউ উয়েফার স্বার্থে সর্বোচ্চ লড়বে, উয়েফাকে টেক্কা দেওয়া অনেক কঠিন হবে ক্লাবগুলোর। তবে যে সকল ক্লাবের তেল,গ্যাস কিংবা মাইনিং ব্যবসা নেই কিংবা থাকলেও ইউরোপমুখী না তারা হাল ছাড়বেনা।রাশিয়া,আমেরিকা উভয়ই সুপার লীগ যুদ্ধে একে অপরের ঘোর বিরোধী এবং উভয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় পেছন থেকে কলকাঠি নাড়বে। বরং ইইউ, ব্রিটেন,রাশিয়া একাট্টা হবে থাকবে সুপার লীগ রুখে দিতে,তাই সুপার লীগের বর্তমানে ভবিষৎ শূন্য আপাতত! সর্বোচ্চ প্রতিরোধের মুখে এ যাত্রায় হয়ত উয়েফা সুপার লীগ বাতিল হয়ে যাবে।

শুধু ফুটবল দেখলে হবে না এখানে রাজনীতি, অর্থনীতি দেখতে হবে,খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করতে হবে।ফুটবলের আড়ালে এই যুদ্ধ আমরা ফুটবল ফ্যানরা দেখিনা বা দেখার চেষ্টা করিনা। ফুটবল আমাদের কাছে হয়ত আবেগ কিংবা নিছক বিনোদন কিন্তু পরাশক্তি ও ধনকুবদের কাছে ব্যবসা,রাজনীতি কিংবা সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার।