• ফুটবল

কি হেতু তুরিনের বুড়িদের ছন্দপতন!

পোস্টটি ১৪৯৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

 

জুভেন্টাসকে ইতালিয়ান ভাষায় ডাকা হয় 'লা ফিদানজাতা দি ইতালিয়া' নামে। যার অর্থ দ্যা গার্লফ্রেন্ড অব ইতালি! এই গার্লফ্রেন্ড যদি সিরি-আর টপ ফোরে থেকে ইউরোপের সর্বোচ্চ আসর চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ালিফাই করতে না পারে, তাহলে এর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ আর কিছুই হতে পারে না এই মুহূর্তে ফুটবল দুনিয়ায়। তবে বিষয়টা আরো বিতর্কিত হতে বাধ্য, যখন জুভেন্টাস দলেই অন্যতম শীর্ষ তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো খেলেন। আফসোসের রেখা গাঢ় হয়ে এসেছে চলতি মৌসুমের প্রতিটা ম্যাচে।

 

ইতালিয়ান সিরি-আর বিগত নয় মৌসুমে ধারাবাহিক চ্যাম্পিয়ন জুভেন্টাসের টাইটেল চেজিং তো দূরের কথা, চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ালিফাই করতেই যেন হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তিন ম্যাচ হাতে রেখে এসি মিলানের কাছে - গোলের হার ব্যর্থতাকে আরো স্পষ্ট করে দিয়েছে। দলের রেপুটেশন আর আর্থিক টানাপোড়েন যেন সমান্তরালে এসে দাঁড়িয়েছে। ক্লাবের এই দুরবস্থায় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো থাকবেন কি থাকবেন না, তা নিয়ে ভক্তদের মনে শঙ্কা জেগেছে। পিরলো অবশ্য খানিক ভয়ই পেয়ে গেছেন, পরবর্তীতে কোচ হিসেবে নিজের সেরাটা দেবেন, সেই আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু কি কারণে উয়েফা ক্লাব ্যাঙ্কিংয়ে চারে থাকা (সর্বশেষ সংস্করণঃ ২২ এপ্রিল, ২০২১) জুভেন্টাসের এই অধঃপতন, তা খানিক বিশ্লেষণ করা যাক।

 

দায়ভার কি একা পিরলোর!

 

ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ডিপ-লাইং প্লে মেকার আন্দ্রে পিরলো দ্যা ওল্ড লেডিদের হয়ে খেলেছেন চার মৌসুম (২০১১-১৫), ১১৯ ম্যাচে করেছেন ১৬ গোল। গেল বছরের আগস্ট একই দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন পিরলো, বছরের শুরুতে কোচিং করিয়েছেন জুভের অনুর্ধ্ব-২৩ দলকে। জুভেন্টাসের বর্তমান অবস্থার জন্য পিরলোকেই দায়ী করছেন সিংহভাগ ভক্ত। ৪১ বছর বয়সী পিরলো কোচ হিসেবে আনাড়ি - এমন বক্তব্য তাদের। নিজের খেলোয়াড়ি পেশায় কি না পেয়েছেন তিনি! ফিফা বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে এসি মিলানের হয়ে দুটো চ্যাম্পিয়নস লিগসহ কত শত ব্যক্তিগত অর্জন। আন্দ্রে পিরলোর অ্যাসিস্টেই তার দল জিতে ফিরতো গুরুত্বপূর্ণ সব ম্যাচ। কিন্তু কোচ হিসেবে কতটা সফল তিনি!

চলতি বছরের জানুয়ারিতে নাপোলিকে - গোলে হারিয়ে জুভেন্টাস জেতে ইতালিয়ান সুপার কাপ, যা কোচ হিসেবে পিরলোর প্রথম শিরোপা জয়। অন্যদিকে, ৩৫ ম্যাচে ৬৯ পয়েন্ট নিয়ে সিরি- টেবিলের পাঁচে অবস্থান করছে জুভেন্টাস। এক পয়েন্ট এগিয়ে চারে নাপোলি। 

         02

 

অনভিজ্ঞগতাঃ খেলোয়াড় হিসেবে যতটাই দক্ষ হোক না কেন পিরলো, কোচ হিসেবে কোনোরকম অভিজ্ঞতা ছাড়াই জুভেন্টাসের দায়িত্ব হাতে নিয়েছিলেন। থিয়েরি অঁরি, ল্যাম্পার্ডের মতো তুখোড় খেলোয়াড়রাও কিন্তু কোচ হিসেবে মোটামুটি ব্যর্থই ছিল, তাঁদের কাতারেই পিরলোকে ধরা যায়। জুভেন্টাসের মতো এলিট ক্লাবে খেলার সুযোগ রাতারাতি আসে না, তাহলে এই দলটায় রাতারাতি কোচ নিয়োগের বিষয়টাও কি মানানসই?

বয়স হোক যেমন তেমন, অভিজ্ঞতা লাগে বটে। যেমন, আসন্ন মৌসুমে টপ ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের দায়িত্ব নিতে যাওয়া বছর বয়সী জুলিয়ান নাজেলসম্যান ফুটবলীয় বুদ্ধি খাটিয়ে, যথার্থ টেকনিকাল হয়েই সামলেছিলেন রেড বুল লাইপজিগকে, ফলশ্রুতিতে প্রথম বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিতে উঠেছিল তাঁর দল (২০১৯-২০) দল থেকে বেরিয়ে এসেছিলো টিমো ভার্নার, মার্সেল সাবিতজারদের মতো প্রতিভা।

ভুল ফরমেশনঃ বর্তমানে -- ফরমেশনকে স্ট্যান্ডার্ড ধরে দলকে খেলান বেশিরভাগ কোচ। ক্ষেত্রবিশেষে --- ফর্মেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কেউ কেউ। জুভেন্টাসকে পিরলো সাজিয়েছেন -- তে, যেখানে মূল সমস্যাই দেখা দিয়েছে তার মিডফিল্ড, অ্যাটাক বিল্ড আপে বল হারাতো তারা নিয়মিতই। দলের এসেনশিয়াল রাইট ফুটেড মিডফিল্ডার অ্যারন রামসে নামেন নি নিয়মিত, বেন্তাকুর ছিলেন করোনা পজিটিভঅন্যদিকে, মোরাতা, রোনালদো, দিবালাকে একসাথে নিয়ে ফ্রন্ট লাইন সাজালে অ্যাটাকে বেশ সুবিধা করতে পারতো দলটা।

চাইলেই পিরলো ফ্লুইড ফরমেশনে দলকে খেলাতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেদিকটা একেবারেই নজরে রাখেন নি। উল্টো জটিল কিছু ফিলোসোফি দিয়ে ম্যাচ জেতার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালান, যা তাঁর খেলোয়াড়দের সাথে যায় নি কোনোভাবেই। জুভেন্টাস খুবই ধীর গতিতে খেলেছে, কনসিসটেন্সির অভাবে প্রচুর ভুল পাসিং আর শট মিসের মতো ঘটনা ঘটেছে। মিরালেম পিয়ানিকের মতো অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের অভাবও ভুগিয়েছে জুভেন্টাসকে।

 03

 

একক নির্ভরশীলতাঃ রোনালদোর উপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলো পুরো স্কোয়াড। ব্যক্তিগত ভাবে নিজেদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা খুব কম খেলোয়াড়কেই করতে দেখা গিয়েছে। না ছিল ক্রিয়েটিভ পাস, না ছিল প্রগ্রেসিভ ড্রিবলিং! এই দলটায় একটা ভালো গোলকিপারের দারুণ প্রয়োজন ছিল। তিন লাতিন ডিফেন্ডার দানিলো, সান্দ্রো, কুয়াদ্রাদোকে খুব একটা একটিভ পাওয়া যায় নি, যদিও দলের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট কুয়াদ্রাদোর। তবুও, এই মৌসুমে লিগে ৬৭ গোল করার বিপরীতে জুভেন্টাস গোল খেয়েছে ৩৪টা, প্রায় অর্ধসংখ্যক। বুফন, কিয়েলিনির মতো বয়সের ভারে ন্যুব্জ থাকা খেলোয়াড়দের উপর এখনও ভরসা করাটাকে ভিত্তিহীন মনে করছেন অনেকে।

রোনালদো এবং দিবালা হচ্ছেন দলের হাই প্রোফাইল টপ ভ্যালুয়েবল ফুটবলার, যাদের চুক্তি ২০২২ পর্যন্ত। দিবালাকে নামানো হয়েছে মাত্র ২২ ম্যাচে, গুঞ্জন রটেছে, পাড়ি জমাবেন ইংল্যান্ডে। চলতি মৌসুমে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো একাই করেছেন ২৭ গোল, পুরো দলের মোট স্কোরের ৪৫ শতাংশ। সি আর সেভেনের মতো একজন খেলোয়াড় খেলবেন ইউরোপাতে, এটা যেকোনো দিক দিয়েই অবিশ্বাস্য। যা আমার, আপনার বা রোনালদো, কারোরই কাম্য নয়।

04

 

আর্থিক অবস্থাঃ এবার আসি আর্থিক সঙ্গতির কথায়। ফোর্বসের তথ্যমতে, তুরিনের এই দলটা বিশ্বের ধনী ক্লাবের তালিকায় এগারোতে, যাদের আনুমানিক ভ্যালু .৯৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে আয় ছিলো ৪৪১ মিলিয়ন (প্রায়) এদিকে করোনা মহামারির ধাক্কায় সর্বপ্রথম বিপর্যস্ত হয় ইতালি, ক্লাবগুলোর দেনা কাটিয়ে উঠতে এখনো হিমশিম খাওয়া লাগছে। তার উপর জুভেন্টাস যদি এবার চ্যাম্পিয়নস খেলতে না পারে, তবেড়সড় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে ক্লাবটাকে, তা বলাই বাহুল্য।

তাহলে, আন্দ্রে পিরলোই কি সমস্যার মূল? নাকি জুভেন্টাস বোর্ড প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে আগনেলি এবং তার ম্যানেজমেন্টের উদাসীনতাই সব, যেখানে অনুর্ধ্ব ২৩ দলের কোচের দায়িত্ব নেবার মাত্র দিনের মাথায় তারা পিরলোকে জুভেন্টাস ফার্স্ট টিমের কোচের আসনে বসালো? এমনকি ইন্টার মিলান, নাপোলির মতো দলের সাথে তাল মিলিয়ে কয়েকটা ইউজফুল সাইনিংও করাতে পারলো না মৌসুমের শুরুতে!