• ফুটবল

ক্রিস্তফ গালতিয়ে অ্যান্ড হিজ ম্যাজিক

পোস্টটি ১২২৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

তিনি এলেন, তিনি দেখলেন, তিনি জয় করলেন। শেক্সপিয়রের বিখ্যাত ট্রাজেডি 'জুলিয়াস সিজার' এর বিখ্যাত সংলাপ। ক্রিস্তফের ক্ষেত্রেও সংলাপ টা খুব খাটে। হাতে যেন তার জাদু আছে। তিনিও আসলেন, হাতের জাদুর ছোঁয়ায় মুহূর্তে বদলে ফেললেন পুরো চিত্র, অতঃপর জিতে নিলেন।

হ্যাঁ, জাদুই বটে। লিগ ওয়ানে পিএসজির একক আধিপত্যের এ যুগে ধুঁকতে থাকা এক ক্লাব নিয়ে তাদের পরাভূত করে লিগ শিরোপা জয়, এটি তো শুধু জাদু দ্বারাই সম্ভব।

২৬ আগস্ট, ১৯৬৬। ফ্রান্সের ফুটবলের শহর মার্সেইতে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ক্রিস্তফ গালতিয়ে। ছোটবেলায় তাঁর ইচ্ছা ছিলো বড় ফুটবলার হওয়া। সে লক্ষ্যে কিশোর বয়সেই জয়েন করেন স্থানীয় ও ফ্রান্সের সেরা ক্লাব অলিম্পিক ডি মার্সেই তে।

image_search_1622234701563
কিন্তু বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন তার পূরণ হয়নি। থিতুও হতে পারেননি কোনো ক্লাবে। ১৪ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারে গায়ে তুলেছেন সাতটি ক্লাবের জার্সি। অবশেষে ১৯৯৯ সালে স্থায়ীভাবে তুলে রাখেন বুটজোড়া।

গল্প কি তবে শেষ? একদম না। আসল গল্প তো শুরুই হলোনা।

ফুটবল ক্যারিয়ার কে বিদায় জানিয়েছিলেন গালতিয়ে, কিন্তু ফুটবল কে বিদায় জানাতে পারেননি। সেবছরই মার্সেই তে আবার যোগদান করেন তিনি। তবে এবার ফুটবলার হিসেবে নয়, এসিস্ট্যান্ট কোচ হয়ে।

তবে এবারও থিতু হতে পারেননি গালতিয়ে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত মার্সেই, এরিস ও বাস্তিয়ায় কাজ করেন তিনি৷ অতঃপর ২০০৪ সালে ফ্রেঞ্চ কোচ আলাইন পেরিনের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার সাথে ২০০৯ পর্যন্ত আল-আইন, পোর্টসমাউথ, সোশো, লিওঁ ও সেইন্ট-এতিয়েনে কাজ করেন।

অবশেষে ২০০৯ সালে এসে সেইন্ট-এতিয়েনের প্রধান কোচের আসনে বসেন গালতিয়ে। সেখানে প্রথম সিজনে কোনোরকমে দলকে অবনমনের হাত থেকে বাঁচান। এর পরে টানা সাত সিজন তার হাত ধরে সেরা দশে থেকে শেষ করে সেইন্টরা, এরমধ্যে চারবার যায়গা পায় ইউরোপিয়ান কম্পিটিশনে। ২০১৩ সালে রেনে কে হারিয়ে ৩২ বছরের শিরোপা খরা কাটিয়ে কুপ ডি লা লিগ জয় করে গালতিয়ের সেইন্ট-এতিয়েন।

image_search_1622235331191
অতঃপর ২০১৭ সালে সেইন্ট-এতিয়েনের সাথে আট বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদায় নেন গালতিয়ে। আর এর অপেক্ষাতেই যেন ছিলো লিগ ওয়ানের আরেক ক্লাব লিল। তাই সুযোগটি লুফে নিতে একদমই দেরী করেনি তারা। সেবছর ডিসেম্বরেই গালতিয়েকে কোচের আসনে বসায় উত্তর ফ্রান্সের ক্লাবটি।

লিল ওএসসি তে তখন চলছিলো চরম সঙ্কট। কয়েক সিজন ধরে দলের পারফর্মেন্সের এমন হাল হয়েছিলো যে মনে হচ্ছিলো এবার লিগ টু তে অবনমন আর ঠেকানোই যাবেনা। ২০১৭ সালের মে তে দলকে বাঁচাতে নিয়ে আসা হয় আর্জেন্টাইন মাস্টারমাইন্ড কোচ মার্সেলো বিয়েলসা কে। কিন্তু বিয়েলসা ব্যর্থ হলেন পুরোপুরি। নতুন সিজনে শুরুর ১৪ ম্যাচে মাত্র তিনটি জয়ে লিগ টেবিলের তলানিতে চলে গেলো লিল। এর মধ্যে আরও কিছু ঘটনার জের ধরে অবশেষে বিয়েলসাকে কোচের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

অতঃপর ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭ লিলের নতুন কোচ হয়ে আসেন গালতিয়ে। এর মধ্যে লিলের ওপর জানুয়ারির ট্রান্সফার উইন্ডো তে নতুন প্লেয়ার সাইনিং এর ওপর আসে নিষেধাজ্ঞা। অবশেষে গালতিয়ের হাত ধরে সেবার কোনোরকমে অবনমনের হাত থেকে বেঁচে যায় লিল।

কিন্তু আর্থিকভাবে আরও বাজে অবস্থার সম্মুখীন হয় তারা। সামার ট্রান্সফার উইন্ডোতে বিক্রি করে দিতে হয় দলের সব কী প্লেয়ার গুলোকে। এদের মধ্যে ছিলো ইভেস বিসুমা, কেভিন মালকিট, ইব্রাহিম আমাদু, হামজা মেনদিল ও লেবো মোথিবা।

কিন্তু গালতিয়ের সাথে ছিলেন অভিজ্ঞ স্পোর্টিং ডিরেক্টর লুইস কাম্পোস। একদমই ভেঙে পড়েননি তারা। আবার দল সাজাতে শুরু করেন দক্ষ হাতে। ফ্রি ট্রান্সফারে দলে ভেড়ান রাফায়েল লিয়াও, জনাথান বাম্বা ও হোসে ফন্তে কে। পাঁচ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে পিএসজি থেকে নিয়ে আসেন জনাথান ইকোনে কে। তুরস্কের সেকেন্ড ডিভিশনের ক্লাব ইস্তানবুলস্পোর থেকে আনেন জেকি সেলিক কে।

১৮-১৯ সিজনের শুরু থেকেই মনে হচ্ছিলো এ যেন অন্য লিল। পুরো টিম যেন অন্য জীবন পেয়েছে। খেলার মধ্যে যেমন ছিলো সাবলীলতা, তেমনি সবার মধ্যে ছিলো জেতার প্রেরণা। কাউকে তোয়াক্কা না করে এগিয়ে যাচ্ছিলো দল। অবশেষে পিএসজির পেছনে দ্বিতীয় স্থানে থেকে লিগ শেষ করে গালতিয়ের দল। এবং সেই সাথে ২০১২ সালের পর প্রথমবারের মতো সরাসরি চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ালিফাই করে লিল।

image_search_1622234407617
আর এই অভাবনীয় সাফল্যের কারিগর তো তিনিই, সেই ক্রিস্তফ গালতিয়ে। সাফল্যের পুরস্কারও পেয়ে যান। সেবার লিগ ওয়ানের বর্ষসেরা কোচের পদক জিতে নেন গালতিয়ে।

খেলায় অভাবনীয় উন্নতি করলেও আর্থিক দৈন্যতা পিছু ছাড়েনি ক্লাবের। সাজানো গোছানো টিমটার ওপর ট্রান্সফার উইন্ডোতে আবার নেমে আসে কুঠারাঘাত। ছেড়ে দিতে হয় দলের প্রায় সব সেরা তারকাকে৷ নিকোলাস পেপে, থিয়াগো মেনদেস, রাফায়েল লিয়াও, ইউসুফ কোনে সহ দলের সেরা তারকা প্রায় সবগুলিকেই বিক্রি করে দিতে হয়৷ তবে আবারও শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামাল দেন গালতিয়ে আর কাম্পোস। তাদের পরিকল্পনামাফিক লিল দলে ভেড়ায় ভিক্টর ওসিমহেন, রেনাতো সানচেজ, তিমোথি উইয়াহ ও ইউসুফ ইয়াজিকিকে।

তবে এই মৌসুমে গতবারের মতো সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারেননি গালতিয়ে। এর মধ্যে নেমে আসে কোভিড প্যান্ডেমিক। তাই দলকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়ে কামব্যাক করানোর জন্য যথেষ্ট সময়ও পাননি। চ্যাম্পিয়নস লিগে গ্রুপের তলানিতে থেকেই তাদের যাত্রা শেষ হয়। কুপ ডি লা লিগের সেমিফাইনালে বিদায় নিতে হয় লিওঁর কাছে হেরে। কোভিড প্যান্ডেমিকের কারণে সেবার স্ট্যাট বিবেচনা করে লিগ পজিশন নির্ধারণ করা হয়। লিগে চতুর্থ হিসেবে মনোনিত হয় লিল, সেই সাথে চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা হারায়। যেতে হয় ইউরোপা লিগে।

পরের সিজনের শুরুতে ক্লাব ছাড়তে হয় এক সিজনেই দলের সবচেয়ে বড় তারকা হয়ে ওঠা ভিক্টর ওসিমহেনকে। সেই সাথে আর্সেনালে যোগ দেন গ্যাব্রিয়েল।

এবার গালতিয়ে নিয়ে আসেন আয়াক্স থেকে লোনে হিরেনভিনে অসাধারণ মৌসুম কাটানো তরুণ সেন্টারব্যাক এসভেন বোটম্যান কে। পাঁচ বছরের জন্য তার সাথে চুক্তি করে লিল। যোগ দিয়েই লিল ক্যাপ্টেন হোসে ফন্তের সাথে অসাধারণ ডিফেন্স জুটি তৈরি করেন বোটম্যান।

image_search_1622234563472

২০-২১ সিজনে চিরায়ত ৪-৪-২ ফর্মেশনে দলকে খেলানো শুরু করেন গালতিয়ে। সেটাকে মাঝে মাঝে পরিবর্তন করে নিয়ে যেতেন ৪-২-৩-১ এ। রক্ষণের ওপর দিলেন বিশেষ দৃষ্টি। উইং এ রাখলেন স্পিডি খেলোয়াড় ও দলকে কাউন্টার এটাকের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করলেন। সেই সাথে নজর দিলেন পজিশনাল স্ট্যাবিলিটি ও জোন মার্কিং এর ওপর। পজিশনাল স্ট্রাকচারের জন্যই এই সিজনে ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী ডিফেন্স গড়ে তোলে লিল।

বোটম্যান-ফন্তের অসাধারণ ইস্পাত কঠিন জুটি ছিলো প্রায় দূর্ভেদ্য। হোল্ডিং মিডে সুমারে ডিফেন্স কে আরও সলিড করে তুলেছিলেন। উইং ব্যাক হিসেবে আরাউজো ও সেলিক তাদের গতিকে কাজে লাগাচ্ছিলেন। মিডফিল্ডে যোগ হয়েছিলো জনাথান ডেভিড ও রেনাতো সানচেজের ক্রিয়েটিভিটি। রেনাতো একটু ডিপে থেকে বল তৈরি করে সেটা পৌছে দিতেন ডেভিডের কাছে। আর সেটাকে ইলমাজের কাছে পৌঁছে দিতেন বামবা। আর অবশেষে ইলমাজের ক্লিনিক্যাল ফিনিশ। এক নজরকাড়া ফুটবল উপহার দিচ্ছিলো লিল।

তরুণদেরও পর্যাপ্ত সুযোগ দিতেন গালতিয়ে। তার পরিচালনায় উইয়াহ, নিহাসি, লিহাদজি সহ অন্যান্য তরুণরাও তৈরি হয়ে যায় মূল টিমের জন্য। সময়মতো তাদের সবাইকেই তিনি ডাকতেন এবং তাতে ফলাফলও পাওয়া যাচ্ছিলো হাতে হাতে।

অবশেষে পূর্ণাঙ্গ সফলতা ধরা দিলো গালতিয়ের কাছে। ১৮ মাসের ব্যবধানে রেলিগেশন জোনে থাকা একটি দলকে যিনি চ্যাম্পিয়নস লিগে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি এবার ৪২ মাসের ব্যবধানে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থে গড়া তারকায় ঠাসা পিএসজিকে নাস্তানাবুদ করে সেই রেলিগেশনের দলটিকে অধিষ্ঠিত করলেন ফ্রান্সের চ্যাম্পিয়নের আসনে।

লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন হলো লিল। এক দশক পর আবার ঘরে উঠলো লিগ ওয়ানের রূপালী শিরোপা। এবং সেটাও গালতিয়ে করে দেখালেন কোনোরকম ইনভেস্টমেন্ট ছাড়া, বরং প্রতি মৌসুমে দলের সেরা খেলোয়াড়দের হারাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু তার সুচিন্তিত পরিকল্পনা, তার অসাধারণ ট্যাকটিকসের কাছে হার মেনে গেল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ইনভেস্টমেন্ট। তিনি আরও একবার প্রমাণ করে দিলেন ফুটবলে অর্থই সবকিছু নয়।

image_search_1622234601131
এই সামারে লিলের সাথে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই লিলের ইতিহাসের সেরা ম্যানেজারদের মধ্যে জায়গায় করে নিয়েছেন গালতিয়ে। এখন দেখার বিষয়, নতুন চুক্তি করে তিনি  লিলের সাথে কাজ করে যাবেন, নাকি যোগ দেবেন ইউরোপের বড় কোনো ক্লাবে।

আগামী দিনে লিলে তিনি থাকুন বা নাই থাকুন, তিন বছরে লুইস কাম্পোসের সাথে মিলে তিনি যা দেখালেন, এটা আমার কাছে স্রেফ ম্যাজিক। লিল ফ্যানরা কোনদিন তাকে ভুলবেনা, ভুলবেনা কোনো ফুটবল ফ্যানই।