টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য এখানেই!
পোস্টটি ২১৭৪ বার পঠিত হয়েছে
টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্যটা কোথায় ? এই প্রশ্নের উত্তর গেল দুইদিনে পাওয়া গেছে। লর্ডসে ভিরাট কোহলির হাত ফসকে বেরিয়ে যাওয়া বাটলারের ক্যাচ আর স্যাবিনা পার্কে হাসান আলি ও রিজওয়ানের মিস করা ক্যাচের প্রেক্ষাপট একত্র করলে, যারা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা নিশ্চিত পেয়ে যাবেন আশা করি।
ভিরাটের মিস করা ক্যাচে ইংলিশ ড্রেসিংরুম হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও তাতে আর শেষ রক্ষা হয়নি। যেই সিরাজের বলে মাঠে নতুন প্রাণ পেয়েছিলো বাটলার, সেই সিরাজেই বাইশ গজে প্রাপ্ত প্রাণের এপিটাফ দেখতে হয়েছে। অর্থ্যাৎ, ক্যাচ মিস করেও ভাগ্য পুড়তে দেয়নি ভারত। বরঞ্চ, নতুন উদ্যমে সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। টেস্টে ক্রিকেটে টিকে থাকতে হলে এই ঘুরে দাঁড়ানোর বিকল্প আরকিছুই নেই।
অন্যদিকে, ক্যাচ মিসে নিজেদের কপাল পুড়ে সিরিজের বাকি ম্যাচগুলোতে মানসিকভাবে পিছিয়ে গেল পাকিস্তান। টেস্টের শেষদিনের রোমাঞ্চ পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক রোমাঞ্চকর পরিস্থিতিকেও এক নিমিষেই হার মানিয়ে দেয়। নাতো, উইন্ডিজ ভাবতে পেরেছিলো ছয় উইকেট হারিয়ে ১৬৮ রানের টার্গেটকে পাহাড়সম বানিয়ে তারা জয়লাভ করতে পারবে! নাতো ইংলিশরা ভেবেছিলো ভারতের টেলএন্ডাররা তাদের বিপক্ষে ২০০ এর বেশি টার্গেট ছুঁড়ে দিতে পারবে।
আসলে টেস্ট ক্রিকেটের বৈশিষ্ট্য এমনই। অভাবনীয় বা অকল্পনীয় সকল ঘটনা ঘটে বসে এখানে। আর দু-চারটা ওডিআই কিংবা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মতো দ্রুত ফলাফল এখানে বেরিয়ে আসেনা। ব্যাপক সাধনা করতে হয় ফলাফলের জন্য। ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টে ম্যাচের মোড় ঘুরে যায় ভিন্নদিকে। টেস্ট ক্রিকেটের এই রূপগুলোই 'ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা' এই প্রবাদের সার্থকতাও প্রমাণ করে দেয় এক ঝলকে।
ক্রিকেটের আরকোনো ফরম্যাটের সাথে তাই টেস্টের তুলনা চলেনা। টেস্ট সবসময় অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করে। টেস্ট ক্রিকেটের টিকে থাকা বা অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কায় থাকা ব্যক্তিরা এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন টেস্ট টিকে থাকলেই বেঁচে থাকবে ক্রিকেট। দ্রুত ফলাফল আশা করলে টেস্ট ক্রিকেট আপনার জন্য নয়। লর্ডসের গ্যালারি খেয়াল করলে দেখবেন — 'কফির কাপ হাতে টেস্টের ফলাফলের দীর্ঘ অপেক্ষায়ও ইংলিশ ম্যানদের ক্লান্তি নেই।'
দুদিনের দুটো ম্যাচের ভাগ্য পাল্টে দেওয়ার পেছনেই টেলএন্ডারদের ভূমিকা ছিলো যতটুকু মুখে প্রকাশ করা যায়, তারচেয়েও কয়েকগুণ অধিক। দল হিসেবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে হলে টেলএন্ডারদের ব্যাটিং করতে জানা বা দলের প্রয়োজনে ব্যাট হাতেও অবদান রাখার কোনো বিকল্প নেই। ভারতের টেলএন্ডাররা ইদানীং নেটে ব্যাট হাতে বেশ সময় ব্যয় করলেও কিমার রোচ কবে শুরু করলেন! তা বোধহয় আমাদের কারোই জানা ছিলোনা। হয়তো, নেটে ব্যাটও ধরে দেখেননি তিনি, এরপরেও প্রয়োজনের মূহুর্তে জাত ব্যাটসম্যানই বনে গেলেন। জাত ব্যাটসম্যানরাই ফিল্ডারদের কাছ থেকে সুবিধা পেয়ে থাকেন বা আদায় করে থাকেন, রোচও পেলেন হাসান আলি আর রিজওয়ানের ভুলে। সুবিধা আদায় করেই — উইন্ডিজ ড্রেসিংরুমের সবার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনলেন।
একইভাবে, লর্ডসে বাটলারেরও তো ক্যাচ মিস হয়েছে, ফিল্ডারের নাম ভিরাট হলেও, দিনশেষে ম্যাচ জয়ের বা ড্রয়ের নায়কের নাম আর বাটলার হয়নি। ক্রিকেটের ফরম্যাটটা টেস্ট বলেই, একেবারেই ব্যতিক্রম এক বাটলারের দেখা লর্ডসের বাইশ গজে মিললেও তার পতনটা সিরাজেই লেখা ছিলো। জয়টাও শেষমেশ লিপিবদ্ধ হয়ে যায় ভারতের খাতায়। চতুর্থ দিনের শেষপর্যন্ত যে ম্যাচের চালকের আসনে ইংল্যান্ডকে বিবেচনা করা হয়েছিলো, সেই চালককে হটিয়ে দিয়ে চালক-হেল্পারের দায়িত্ব বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাটিংয়ে ভাগাভাগি করে নেয় বুমরাহ আর শামি। তাদের ৮৯ রানের জুটিই মূলত ইংলিশদের পঞ্চাশ ভাগ আশা নিরাশায় রূপান্তর করে দেয়। এটাই টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য! যা ভাবা হয়, তা না হয়ে — তৈরি হয় এক ভিন্ন পরিস্থিতি।
ভিরাট রিভিউ নষ্ট করে সমালোচনার শিকার, এই ম্যাচ ড্র কিংবা হারতে হলে তার হাত থেকে ফসকে যাওয়া ক্যাচের দায় এড়ানোর বিন্দুমাত্র সুযোগ ছিলোনা। সমালোচনা হওয়ার সেই সুযোগ তৈরি হতেই দেননি, ওভার দ্যা উইকেটে বুমরাহর বলে রবিনসনের বিপক্ষে এলবিডব্লুর আবেদনের রিভিউ সফল করে ভারতকে পুনরায় খেলায় ফেরানোয়। পেন্ডুলামের মতো ম্যাচকে ঘুরতে দেননি। সময় ফুরিয়ে যাবার আগেই তথা দিন শেষ হওয়ার পূর্বেই দলকে জয়ের স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন।
টেস্ট ড্র হলে প্রশংসায় ভাসতেন বাটলার, দলের জয় নিশ্চিত করতে না পারলেও তিনি নায়ক হওয়ার উপলক্ষ তৈরি হয়েছিলো। আবার, জয় ব্যাতীত অন্যকোনো ফলাফল হলে ভিরাট বনে যেতেন পুরোপুরি খলনায়ক। ক্রিকেটের আর দুই ফরম্যাটে ম্যাচ ড্র হলে খলনায়ক হওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা, টেস্ট রোমাঞ্চে ঠাসা বলেই এখানে নাটক জন্ম নেয় প্রতিমূহুর্তে। টেস্ট ড্র হলে বাটলার নায়ক হতে পারতেন। কিন্তু, বাটলারের ক্যাচ গেলে দেওয়া ভিরাট হতেন খলনায়ক।
পাকিস্তানের রিজওয়ান আর হাসান আলি অবশ্য ম্যাচ চলাকালীন নায়ক হলেও এর রেশ তারা ধরে রাখতে ব্যর্থ। হাসান তিন উইকেট নিয়ে উইন্ডিজদের শেকলে বেঁধে রাখতে সমর্থ হলেও, পরবর্তীতে উইন্ডিজদের জয়ে মুখ্য ভূমিকায় নিজের নামটাও জুড়ে দেন রোচের সহজ ক্যাচ লুফে নিতে না পেরে। ওয়ারিক্যানের টপ এইজ বলকে উইকেটের উল্টো পাশে দৌঁড়ে প্রায় বাউন্ডারি পর্যন্ত পৌঁছে বাজ পাখির মতো ঝাপিয়ে যেই অসাধারণ ক্যাচ নিয়েছেন রিজওয়ান, তাতে মুগ্ধ ইয়ান বিশপ তাকে 'ব্রিলিয়ান্ট' বলতে কার্পণ্য করেননি।
অথচ, এই রিজওয়ানই আবার খলনায়কে রূপান্তরিত হোন। যেই হাসান আলি রোচের ক্যাচ ছেড়েছিলেন, সেই হাসান আলির বলেই রোচের এইজ রিজওয়ান গ্লাভসে আটকাতে না পারায় চার হয়ে যায়। ইয়ান বিশপ ফিরিয়ে নেন আগের কথা — 'Is Rizwan from hero to zero ? Or I'm being harsh ?' বিশপ কঠোর বা নিষ্ঠুর যাই হোক! টেস্ট ক্রিকেট আপনাকে এভাবেই রূপ পাল্টে সুখের ভেলা থেকে মূহুর্তেই ঠেলে দুঃখের সাগরে ডুবিয়ে মারবে। অবিশ্বাস্য এক ক্যাচ লুফে রিজওয়ান স্বপ্নের ঘোরেই বিচরণ করছিলেন সম্ভবত। কিন্তু, হাসান আলি আর তার ভুলেই উইন্ডিজ ম্যাচ জিতে নিয়েছে। পাকিস্তানের হাসি মাঠে টিকেনি বেশিক্ষণ। নায়ক হতে যাওয়া হাসান ও রিজওয়ান চোখের পলকেই খলনায়কের কাতারে। কিমার রোচের ব্যাটসম্যানসুলভ ব্যাটিংই বাধ্য করেছে পাকিস্তানীদের মাঠে ভুল করতে।
এদিক দিয়ে ভারত ভুল করেও শেষপর্যন্ত লড়ে ম্যাচ ছিনিয়ে এনেছে। মৃত বাবার স্বপ্ন পূরণে ২০২০ সালে ভারতের সাদা পোশাকে মাঠে নামা সিরাজ এখন মূর্তিমান আতঙ্ক যেকোনো প্রতিপক্ষের কাছেই। ভারতে হোক আর বিলেতে, সিরাজ এখন সবখানেই বরাবর চোখে চোখ রেখে লড়ে যান। দুই ইনিংসে ৮ উইকেট শিকার করেও লাল বলের রাজা এন্ডারসনের চেয়েও বেশি শিকার তার দ্বিতীয় টেস্টে। শামি, ইশান্ত আর বুমরাহর পাশে দাঁড়ালেও সিরাজকেই সাফল্যে উঁচু দেখা যাচ্ছে। নিখুঁত বোলিংয়ে মোড় ঘুরিয়েছেন ম্যাচের। ইংলিশদের স্লেজিংয়ের দাঁতভাঙা জবাব দিয়ে নিজের বিশালতা প্রমাণ করলেন।
সাধারণত, ওডিআই ক্রিকেটে টেলএন্ডারদের ব্যাটিং করে ম্যাচ জেতাতে তেমন দেখা যায়না। টেস্টেও যে হরহামেশা দেখা যায় সেটাও না! এরপরেও যতটুকু যায়, তা ওডিআইকে ছাপিয়ে চলে যায় অনেক উঁচুতে। টেস্টের উইকেটের ধরন, ফিল্ড সেটাপ সবকিছুই থাকে টেলএন্ডারদের বিরুদ্ধে। সেখানে তো নিয়মিতই খাবি খায় ব্যাটসম্যানরা। উইকেট কিপারের পাশে তিন স্লিপ আর তার পাশে গালির ফিল্ডার, পয়েন্টের ফিল্ডার, লেগ স্লিপকে ফাঁকি দিয়ে ১৪০+ গতিতে ছুটে আসা প্রতিটা বাউন্সার, ইনসুইং, আউটসুইনং ডেলিভারি লড়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জয়ের স্বাদ নেওয়ার নামই টেস্ট ক্রিকেট।
ওডিআই আর টি-টোয়েন্টির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পরিশ্রম করে টেস্ট ম্যাচ জয় করতে হয়। কষ্টার্জিত জয়ে তাই আনন্দের পাল্লাও ভারি হয় ঢের। নিঃসন্দেহে তাই বলা যায় পরপর দুইদিন টেলএন্ডারদের কল্যাণে উইন্ডিজ আর ভারতের জয়ের আনন্দের মাত্রাও আকাশচুম্বী। এই আনন্দ তো আর ওডিআই কিংবা টি-টোয়েন্টিতে যাওয়া যায়না, যায় শুধু টেস্টে। এই কারণেই টেস্ট ক্রিকেট ব্যাতিক্রম। আর টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্যটাও ঠিক এখানেই।
- 0 মন্তব্য