• ফুটবল

এই কান্তে, সেই কান্তে!

পোস্টটি ১০৩০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

মস্কোর সে সন্ধ্যা। 

লুঝনিকি স্টেডিয়ামের বর্ণালি আলোয় মাতোয়ারা পুরো ফরাসি জাতি। বিশ্বজয়ের আবেগ, উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা উল্লাস- সে এক ভিন্ন রকমের ব্যাপার! 

১৯৯৮ সালের পর অপেক্ষার বিশ'টা বছর। সেবার ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে জিদানের হাতে উঠেছিলো সোনার হরিণ বিশ্বকাপ। ২০ বছর পর, কি দারুণ এক বিশ্বকাপ জয়! একে একে সবাই বিশ্বকাপ ট্রফিতে চুমু দিচ্ছে, নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলছে। তাদের আজ বড় আনন্দের দিন। পুরো বিশ্বকাপে ব্যর্থ অলিভিয়ের জিরুদ'ও সামিল হয়েছেন আনন্দোৎসবে; তাকে বরং অন্যদের চেয়ে বেশিই উল্লসিত মনে হচ্ছে। এই বিশ্বজয়ীদের মিছিলের কোথাও যাকে দেখা যাচ্ছে না তিনি এনগোলো কান্তে! 

জিরুদ একটা সময় কান্তে'কে ডেকে আনলেন; 'এই নাও ধরো। বিশ্বকাপটা উঁচিয়ে ধরো। এবার তোমার পালা।' 

কান্তে তবু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। লজ্জায় তার চোখমুখ কেমন দেখা যাচ্ছে। বিশ্বকাপ'টা হাতে নিলেন কান্তে; কিন্তু কি বিপদ! অন্যদের মতো তিনি কতশত ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে পারলেন না। পিছন থেকে গ্রিজম্যান বলে উঠলেন, 'তুমি বরং বসে-ই ছবি তুলো কান্তে।' 

সবার অনুরোধ রাখতে বিশ্বকাপ'টা তুলে ধরলেন কান্তে। শতশত ক্যামেরা তাকে তাক করে আছে। বিশ্বজয়ের এক হিরো'কে ক্যামেরাবন্ধী করতে উৎসুক ফটোগ্রাফারদের আগ্রহের শেষ নেই। 

অথচ এই কান্তে আজ এখানে থাকার কথা ছিল না। 

২০ বছর আগের কথা। ১ম বারের মতো বিশ্বকাপ জেতা ফ্রান্স দলের বাঁধভাঙ্গা উল্লাস চলছে। ৭ বছর বয়েসী কান্তে তখন স্টেডিয়ামের বাইরে দর্শকদের ফেলে দেয়া ময়লা- আবর্জনা সংগ্রহ করতে ব্যস্ত! 

প্যারিসের পার্শ্ববর্তী ঘনবসতি রুয়েল ম্যালমাইসনের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম- বেড়ে উঠা; খুব অল্প বয়সেই পিতার মৃত্যু, চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই একটা জিনিস কান্তের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়- বড় হতে হলে অনেক কষ্ট করতে হবে; এছাড়া কোনো উপায় নাই। 

কষ্ট তো তখন শুরু হয়, যখন সারাদিন ঠুকাইয়ের কাজ করে বাসায় ফিরে দুমুঠো খাবার তার জোটতো না। বাসায় বাসায় ক্লিনারের কাজ করতেন তার মা; ছেলেমেয়েদের ভালো করে খেতে দিতে না পারার আফসোস তাকে কাঁদাতো। 

কান্তে আবর্জনা সংগ্রহ করে খুব অল্প কিছু টাকায় সেগুলো দিয়ে আসতেন রিসাইক্লিং কারখানায়। 

'৯৮ বিশ্বকাপের পর কান্তের মনে ফুটবলার হওয়ার এক অদ্ভুতুড়ে বাসনা দেখা দিলো। সাত বছর বয়েসি কান্তের চোখে হিরো মানে জিদান, থিয়েরি- থুরাম, ভিয়েরা কিংবা আনেল্কা! কান্তে ভাবলেন, এদের সবাই তো ভিন্ন দেশ থেকে এসে ফ্রান্সের হয়ে খেলে বিশ্বকাপ জেতা ফুটবলার; তবে আমি কেন হতে পারবো না? 

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কান্তের লেগেছে অন্তত বছর দুয়েক। সময় পেলে টুকটাক ফুটবল খেলা কান্তের চোখেমুখে একজন ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন- আর দেহ জানে তার হাঁড়ভাঙ্গা খাটুনির খবর। জেএস সারেসনেসে'র ইয়ুথ ক্লাবে সেবার নামটা লিখেই ফেললেন কান্তে। দলের সবচেয়ে খাটো অথচ সবচেয়ে ফোকাসড বালক হিসেবে তাকে অল্পতেই সবাই চিনে ফেললো! তারপর কেটে গেলো এগারো'টি বছর। 

সারাদিন মাঠে পড়ে থাকা, ট্যাকেল আর ইন্টারসেপশনের ওস্তাদ হয়ে উঠা কান্তের উপর চোখ পড়লো থার্ড ডিভিশনের ক্লাব বৌল্গনের! সেখানের দুই বছর তার জীবন পালটে দিলো। লীগ ওয়ানে সিয়েনে দু'বছর খেললেন; তারপর উত্থান হলো এক দানব কান্তের! ২০১৫ সালে লেস্টার সিটিতে এসেই জিতলেন ঐতিহাসিক লীগ শিরোপা; পরের বছর চেলসির হয়ে আবারো লীগ শিরোপা! বদলে যেতে লাগলো কান্তের মহাকাব্যিক অধ্যায়ের। 

মাঠ কি মাঠের বাইরে সর্বদা হাসিমুখ এই আপাদমস্তক মানুষের পুরোটাই সরলতায় ভরপুর। বিনয়ী মনোভাব তাকে সবার থেকে আলাদা করেছে। রক্তমাংসে গড়া সব মানুষের কিছুটা রাগ, অহংকার আর ব্যতিক্রমতা তো থাকেই; কান্তের বেলায় এই নীতি যেন প্রযোজ্য না। 

ঠুকাইয়ের কাজ করে বড় হওয়া; নিজ দক্ষতায়, মেধায় আর পরিশ্রমে বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি ক্লাবের হয়ে খেলা- সপ্তাহিক ১ লাখ ২০ হাজার পাউন্ডের বেতন; অথচ কান্তে মানুষটা রয়ে গেলেন সেই গম্ভীর, সরলমনা! কমদামী পুরনো গাড়ি চালিয়ে আসেন ট্রেনিং গ্রাউন্ডে; সর্বদা মনোযোগী থাকেন প্রেক্টিস সেশনে। দলকে জেতানোর জন্য খেলেন; দৌড়ান চিতার মতো। তবে হ্যাজার্ড মজা করে তাকে নাম দিয়েছেন ইদুঁর: দ্যা র‍্যাট! মাঠে তাকে পাওয়া যায়না এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। 

এ এক ভিন্ন কান্তে। 

যে কান্তের উত্থানে খুব কম মানুষ সাক্ষী ছিলো। খুব কম মানুষ তাকে বিশ্বাস করেছিলো। তবে পরিশ্রমের সর্বোচ্চ সাফল্য থেকে বিধাতা তাকে বঞ্চিত করেন নি। ঠুকাই থেকে ব্যালন ডি'ওর মঞ্চে গেছেন; চ্যাম্পিয়নস লীগ থেকে বিশ্বকাপের মঞ্চ; সবখানে মাতিয়েছেন। আলোচনায় এসেছেন- থেকেছেন নীরবে।

লুইঝনিকি স্টেডিয়াম, ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই। কান্তের হাতে বিশ্বকাপ। আফসোস- বাবা তার পাশে দাঁড়িয়ে নেই; যে বাবা ছোটবেলায় কান্তে'কে বলেছিলেন- দেখিস বাবা, তুই একদিন সবাইকে ছাড়িয়ে যাবি।' মুখভর্তি হেসে দাঁত বের করে দিয়ে কান্তে আজ জানান দিলেন- তিনি অনেক'কেই ছাড়িয়ে গেছেন। আমার শুধু ভাবতে অবাক লাগে- এই কান্তে, আর সেই কান্তে! 

- আহমদ আতিকুজ্জামান।