• ফুটবল

কাগজে কলমে ছিলেন রাইটব্যাক গার্দিওলার হাত ধরে হয়ে গেলেন প্লেমেকার! গল্পটা জোয়াও ক্যান্সোলোর

পোস্টটি ৭৯৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

একজন ইনভার্টেড উইংব্যাক জোয়াও ক্যান্সেলো যাকে গার্দিওলা বানিয়েছেন প্লে মেকার। আজকের লেখাটাও তাকে নিয়েই।

ছবি: ক্যান্সেলোimages - 2021-11-04T041709.497

ফুটবল যুগে যুগে পরিবর্তন চলমান, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সব বিষয় যুক্ত হচ্ছে ফুটবলে। নতুন নতুন ফর্মেশন আর ট্যাকটিকস দিয়ে খেলাটাকে সুন্দর করে তুলছে এক একজন ট্যাকটিশিয়ান। ১৯২৫ এর পর থেকে ফুটবলে নতুন ফর্মেশন যুক্ত হতে থাকে, ম্যানেজারা সফল্য বের করতে তার পছন্দের ফর্মেশনে দল গঠন করেছেন। আর এই ফর্মেশনে আবিস্কারের যাত্রাও একটা সময় থেমে গিয়েছে। গত ২৫/৩০ বছরে আর নতুন কোন ফর্মেশন ফুটবলে যুক্ত হতে দেখা যায় নাই। ঐ ৪-৩-৩, ৪-৪-২, ৪-২-৩-১, ৩-৫-২... এগুলাই ঘুরে ঘুরে ব্যবহার হচ্ছে। কিছুদিন আগে থিয়াগো মোত্তা ২-৭-২ ফর্মেশনের তত্ব নিয়ে হাজির হয় যদিও এটা এখনো কল্পনা মাত্র, মাঠে ব্যবহার আর এ সিস্টেমের সাফল্য ব্যর্থতা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।

ফর্মেশন ঠিক থাকলেও ভেতরে ভেতরে ঠিকই পরিবর্তন চালিয়ে যাচ্ছেন ট্যাকটিশিয়ানরা। আধুনিক ফুটবলের বড় ট্যাকটিশিয়ানদের একজন হচ্ছেন পেপ গার্দিওলা , যিনি তার ফুটবলীয় জ্ঞান দিয়ে নতুন কিছু না কিছু দেখিয়ে চলেছেন  ঠিক একই পথ ধরে গার্দিওলা এবার ক্যান্সেলো ব্যবহারের মাধ্যমে দেখিয়েছেন একজন উইংব্যাক কিভাবে ডিফেন্স কাভারের সাথে প্লে মেকিং কাজে অংশগ্রহণ করনো যেতে পারে।

প্রথমে জানা যাক ইনভার্টেড উইংব্যাক আসলে কি?
ডিফেন্সিভ দিকে ইনভার্টেড উইংব্যাক অবস্থান ট্রেডিশনাল উইংব্যাকের মতই। শুধু এ্যাটাকে উঠার কাজে রয়েছে ভিন্নতা। ন্যাচারাল উইংব্যাক যেমন এ্যাটাকে ওভারল্যাপ রান নিয়ে থাকে, ইনভার্টেড উইংব্যাক সেখানে হাফ স্পেস ধরে ডিপ মিডে অবস্থান করে মিডফিল্ডে একটা আপশন বাড়িয়ে দেয়। আবার কখনো যদি কোন উইংগার নিজের পজিশন ছেড়ে ভেতরে চলে আসে তবে ইনভার্টেড উইংব্যাক সেই উইংগারের ফেলে আসা জায়গায় অবস্থান নিবে এবং উইংগারের মত আক্রমণ চালাবে। তবে এদের মূল কাজ হলো উইং থেকে সেন্টার মিডে রান নিয়ে মিডফিল্ড ওভারলোড করে উইংগারদের স্পেস তৈরি করে দেওয়া।

চাহিদা থাকলেও ইনভার্টেড উইংব্যাক সব ফর্মেশনে ব্যবহার করা যায় না, এমন কি টপ লেবেল ফুটবলের বাহিরে এই রোলে কাউকে ব্যবহার দেখা যায় না। সিটিতে ক্যান্সেলোর পাশাপাশি ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে ট্রিপিয়াকে সাউথগেট ইনভার্টেড উইংব্যাক হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়, আবার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের লুক শ ইঞ্জুরিতে অপশন না পেয়ে সোলশায়ার ব্রান্ডন উইলিয়ামস কে ইনভার্টেড উইংব্যাক হিসেবে তুলে এনেছিলেন। সাধারণত ৪-৩-৩, ৪-২-৩-১ , ৩-৪-২-১ এই সব ফর্মেশনে ইনভার্টেড উইংব্যাক ব্যবহার করতে দেখা যায়।

 

গার্দিওলার সিস্টেমে উইংব্যাক : বর্তমানে আমরা গার্দিওলাকে যেভাবে‌ খেলাতে দেখি এটার প্রথমবার দেখা গিয়েছিল তিনি যখন বার্সা ছেড়ে বায়ার্ন মিউনিখ যোগ দেন। গার্দিওলা যখন ট্রেবল জয়ী বায়ার্নের যোগ দেয় তখন তাদের দলে দুই ট্রেডিশনাল ফুলব্যাক ছিলেন ডেভিড আলাবা আর জার্মান লিজেন্ড ফিলিপ লাম। গার্দিওলা এখানে এক বড় পরিবর্তন আনলেন দুই ট্রেডিশনাল ফুলব্যাকে বানালেন ইনভার্টেড উইং ব্যাক। তখন সিস্টেমটা এমন দাড়ালো যে দুই পাশে দুই এ্যাটাকিং উইংগার রোবেন-রিবেরি, ২ জন নম্বর টেন গোৎসা - মুলার এবং সেন্টার ফরোয়ার্ডে মানজুকিচ ৫ জনের এ্যাটাকিং লাইন আপ গঠন করেন। আলাবা - লাম নিজেদের পজিশন থেকে বেরিয়ে ইনভার্টেড উইংব্যাকের মত হাফ স্পেসদিয়ে ডিপ মিডে পজিশন নিত। দুই সেন্টারব্যাকের সাথে টনি ক্রুস নিচে নেমে ৩ জনের ডিফেন্স লাইন তৈরি করত কাউন্টার এ্যাটাক নষ্ট করতে। বায়ার্নের অন দ্যা বল ফর্মেশন দাঁড়াত ৩-২-৫ যেখানে দুই ফুলব্যাকে মিডফিল্ডে নিয়ে এসেছিলেন গার্দিওলা। গার্দিওলার দেওয়া এ কাজের জন্য ডেভিড আলাবা এখনো বেশ ভার্সেটাইল প্লেয়ার যাকে ফুলব্যাক, উইংব্যাক, মিডফিল্ড, সেন্টারব্যাক সব পজিশনে চোখ বন্ধ করে খেলানো যায়।

ছবি: গার্দিওলার প্রথম মৌসুমে বায়ার্নের লাইনআপimages - 2021-12-28T224434.029

 

গার্দিওলা তার নতুন সিস্টেমে বায়ার্ন কে নিয়ে ভালোই এগুচ্ছিলেন কিন্তু এ সিস্টেমের বড় ধাক্কাটা খায় তার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে। এ্যাটাক ওভারলোড করায় মিডফিল্ড আর ডিফেন্সে তৈরি হয় বড় বড় স্পেস যেটা দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের কাউন্টার এ্যাটাক ভেস্তে দেয় বায়ার্নের‌ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে উঠার স্বপ্ন।

ছবি : চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিফাইনালে বায়ার্নের বিপক্ষে রোনালদোimages - 2021-12-28T232638.897

 

পেপের ম্যানসিটির উইংব্যাক সিস্টেম: ম্যানসিটিতে আসার পর ২০১৭/১৮ সিজনে 57 মিলিয়ন খরচ করে মোনকো থেকে ধরে অনেন লেফটব্যাক বেঞ্জামিন মেন্ডিরে। দুই ট্রেডিশনাল উইংব্যাক দিয়ে অন দ্যা বল সেট করেন ৩-১-৪-২ ফর্মেশন কিন্তু মেন্ডির অতিরিক্ত ইঞ্জুরি প্রবণতা গার্দিওলাকে দ্রুত বিকল্প কিছু ভাবতে বাধ্য করে। গার্দিওলার হাতে বিকল্প অপশন ছিল দুই লেফট ফুটেড ফাবিয়ান ডালফ আর সিটি একাডেমির তরুণ জিনচেংকো। উভয়েই ছিল মিডফিল্ডার এখানে তাদের গার্দিওলা বানালেন উইংব্যাক। সিস্টেমটা বায়ার্নের ৩-২-৫ মত তবে পার্থক্যটা হচ্ছে বায়ার্নে পজিশন হাতে থাকার সময় টনি ক্রুসকে যেখানে সেন্টারব্যাকদের সাথে নিচে থাকতে হত সিটিতে গার্দিওলা আর নিচে কাউকে ব্যবহার করে নাই ফলে দুই উইংব্যাক ডালফ - ওয়ালকারের সাথে ফার্নান্দিনহো তিন জনের মিডফিল্ড তৈরি করত যাতে আরো বেশি অপশন থাকে পাস আর বল বাড়ানোর ক্ষেতে। সিটিতে অন দ্যা বল ফর্মেশন দাঁড়াত ২-৩-৫। ম্যান সিটির ডমিনেট আর ১০০ পয়েন্ট নিয়ে লীগ শেষ করার পেছনে একটা বড় হাত ছিল তার উইংব্যাকের।

উইংব্যাক ক্যান্সেলোর প্লে মেকার হিসেবে ব্যাবহার: ২০২০ পেপ আরো একটা বড়সর পরিবর্তন আনেনে তার সিস্টেমে। যখন তিনি হাতে পান একজন পারফেক্ট ইনভার্টেড উইংব্যাক জোয়াও ক্যন্সেলোকে। ক্যান্সেলোর ট্যালেন্টের প্রতিটা ইঞ্চি সঠিক ভাবে তিনি কাজে লাগিয়েছেন আর ক্যান্সেলোকে বানাইছেন উইংব্যাকের পাশাপাশি প্লে মেকার। জুভেন্টাস থেকে রাইটব্যাক হিসেবে আসলেও পেপ তাকে বেশিরভাগ সময় সেট করেন লেফটব্যাক পজিশনে। 2020 এ পেপ তার সেন্টার ফরোয়ার্ডকে মাঝখানে রেখে দুই উইংগার কে ওয়াইড পজিশনে সেট করেন, নিচে নম্বর ১০, একটু পেছনে নম্বর ৮ ডিফেন্সিভ মিডের সাথে ক্যন্সেলো যুক্ত হয়ে ডায়মন্ড শেপে ৪ জনের মিডফিল্ড লাইন তৈরি করে। যেটা গার্দিওলাকে মিডফিল্ড শাসন করতে বড় সাহায্য করে। কেন দল যদি এই এক্সট্রা‌ মিডফিল্ড লাইন ভাংতে উপরে উঠে আসে তবে সিটির উইংগাররা ফাঁকা হয়ে যায়। আর সিটির উইং এ বর্তমানে আছে মাহরেজ, গ্রিলিশ,বার্নাডো,স্টারলিং, ফেরান তোরেস, ফোডেন যাদের ড্রিবলিং আর গোলস্কোরিং মারাত্মক, ফাঁকায় ছেড়ে দেওয়া মানে সুইসাইড করার মত ব্যাপার। 

ছবি: ক্যান্সেলোর বল টাচ ম্যাপimages - 2021-12-28T224615.154

বল বিল্ড আপে ক্যান্সেলো: গার্দিওলা বার্সা থেকেই পেছন থেকে বিল্ডআপ করে খেলাতেন। যেখানে প্রতিপক্ষের ফার্স্ট লাইন প্রেস ভাংতে তিনি বুসকেটস কে নিচে নামিয়ে আনতেন। ম্যানসিটিতে তিনি আর ডিফেন্সিভ মিড কে নিচে আনেননাই বরং ইনভার্টেড উইংব্যাক ক্যন্সেলো কে দিয়েই কাজটা করিয়ে নিচ্ছেন। বিল্ড আপের সময় ক্যান্সেলো ফুলব্যাক পজিশন ছেড়ে মিডফিল্ডে ঢুকে পড়ে সাথে পেছনে থাকা স্টোন - দিয়াজ- ওয়ালকার এবং এডারসনের সাথে বল বিল্ডআপে অংশ নেয়। অনেক টেকনিক্যাল আর পাসিং ভালো হওয়ায় সিটির বিল্ড আপ নষ্ট করা অনেক কঠিন হয়ে যায়। সিটের ডিফেন্স থেকে মিডে বল চালান করানোর কাজে ব্যবহার করা হয় ক্যান্সেলো কে।

বল মিডফিল্ডে আসার পর ক্যান্সেলো রদ্রির সাথে ডাবল পিভট গঠন করে‌। সাথে গুন্ডগান ডি ব্রুইনা যুক্ত হয়ে ৪ জনের মিডফিল্ড গঠন হয়। বল ফাইনাল থার্ডে আসার পর ক্যান্সেলো আসল খেলাটা বেরিয়ে আসে। পিভট ছেড়ে সে হাফ স্পেস ধরে ক্রিয়েটিভ পজিশনে উঠে আসে। ক্যান্সেলো যখন রাইট সাইডে থাকে তখন সে একজন Mezzala মত আচরণ করে। অসাধারণ সেন্স, পাসিং, লং বল, ক্রসিং আর টিমেটদের অবস্থান বুঝে ওভারল্যাপ আন্ডারল্যাপ রান, দু পায়ের সমান ব্যবহার পাশাপাশি ড্রিবলিং ক্যান্সেলো আরো ডেডলি করে তুলে। ক্যান্সেলো যখন লেফট সাইডে থাকে তখন একজন ইনভার্টেড উইংগারের মত আচরণ করে সে ক্রস তুলতে পারে, ড্রিবলিং করে বক্সের ভেতরে ঢুকতে পারে অথবা লং রেঞ্জ শুট করতে পারে।

ছবি: ২০/২১ প্রিমিয়ার লিগে ওপেন প্লে থেকে সম্ভব্য এসিস্টদাতা ৪ নম্বরে ক্যান্সেলোimages - 2021-12-28T224555.584

 

এটা গেল শুধু এ্যাটাকিং এর পাশাপাশি ক্যান্সেলো তার প্রাইমারি কাজ ডিফেন্সিভ ডিউটিও পালন করে, তার গতি সাহায্য করে প্রতিপক্ষের কুইক কাউন্টার এ্যাটাক থামাতে। বল ইন্টারসেপশনে রেট আগের সিজনগুলর তুলনা পেপ গার্দিওলার অধিনে ৩২% বৃদ্ধি পাইছে। বল হারানোর পর দ্রুত প্রেস করে পজিশন হাতিয়ে নিতে ক্যান্সেলো গার্দিওলার অন্যতম সেরা অস্ত্র।

 

ক্যান্সেলো এই সিজনের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ৫ ম্যাচে ২ গোল ৩ এসিস্ট করেছেন, লীগে ১৮ ম্যাচে ১ গোল ৪ এসিস্ট। ক্যান্সেলো যে টাইপের উইংব্যাক এমন উইংব্যাক বাজারে খুবই বিরল। ক্যান্সেলোর ভাগ্যও ভালো বলতে হয় যে সে তার পিক টাইমে পেপ গার্দিওলার কাছেই এসেছিল, অন্য কোন ম্যানেজার হয়ত তাকে এভাবে ব্যবহার করতে পারত না। ইনভার্টেড উইংব্যাক পজিশনের এক আদর্শ উদাহরণ হচ্ছে ক্যান্সেলো। একজন প্লেয়ারের একই সঙ্গে এতগুলা কাজ পারফেক্ট ভাবে সম্পন্ন করা আশ্চর্যজনক বটে।