• ফুটবল

পাবলো গাবি: বার্সার মাঝমাঠে নতুন ভরসা

পোস্টটি ১২৫০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

“ক্রিং ক্রিং ক্রিং...”

 

ফোনটা বেজেই চলেছে। কল আসছে, কেটে যাচ্ছে, আবার আরেকটা কল আসছে। ম্যানুয়েল ভাস্কো অবশ্য সেদিকে খেয়াল করার সময় পাচ্ছেন না। তিনি ব্যস্ত আছেন একদল বিদেশী সাংবাদিককে নিয়ে। একের পর এক সাক্ষাৎকার দিতে হচ্ছে, ছবি তুলতে হচ্ছে, ভিডিও চলছে, সব মিলে ফোন ধরার সময়টাই পাচ্ছেন না তিনি। কিন্তু এত ব্যস্ততার পরও এতটুকু বিরক্ত নন তিনি, বরং ভেতরে ভেতরে ভীষণ গর্বিত আর আনন্দিত তিনি। ম্যানুয়েল ভাস্কোর এই দারুণ গর্বের উপলক্ষ্য এনে দিয়েছেন তাঁর এক তরুণ ছাত্র। সেই ছাত্রটির নাম পাবলো মার্টিন পায়েজ গাভিরা, তবে পৃথিবী তাঁকে চেনে এখন ‘গাবি’ নামে।

 

গাবিকে এখন না চেনার কোন কারণ নেই। কাগজে কলমে বার্সেলোনার জুভেনিল-এ দলের এই খেলোয়াড় নিঃসন্দেহে চলতি মৌসুমে ফুটবলবিশ্বের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। বয়সটা সতেরো পূর্ণ হওয়ার আগেই কাতালান ক্লাবটির মধ্যমাঠের প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছেন, মূল দলেও হয়তো ‘পদোন্নতি’ পেয়ে যাবেন তাড়াতাড়িই। অভিষেক হয়ে গেছে স্পেন জাতীয় দলেও, নেশনস লিগের পারফরম্যান্স দিয়ে রীতিমতো মুগ্ধ করেছেন সবাইকে। ভোরের আকাশ যদি সঠিক পূর্বাভাস দেয়, লা মাসিয়ার আরও একজন গ্রাজুয়েটের পৃথিবী মাতানো এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

 Gavi

তবে লা মাসিয়া থেকে ‘স্নাতক’ সম্পন্ন করলেও, গাবির ফুটবলে হাতেখড়ি কিন্তু লা মাসিয়ায় নয়। ২০০৪ সালে আন্দালুসিয়ার লস পালাসিওসে জন্মগ্রহণ করার পর ফুটবলের হাতেখড়িটা হয়েছে রাস্তায়, আর দশজন স্বাভাবিক ফুটবলারের মতো। প্রতিবেশীরাও সারাক্ষণ বাড়ির পাশের রাস্তায় বলে লাথি মারতে দেখতেন ছোট্ট গাবিকে। এরপর লিয়ারা বালোম্পিয়ে নামক স্থানীয় ক্লাবেই প্রথম খেলা শুরু করেন গাবি, পরে যোগদান করেন স্প্যানিশ ফুটবলের পরিচিত নাম রিয়াল বেটিসের ইয়ুথ একাডেমিতে। রিয়াল বেটিসের যুবদলের হয়ে মোট ৯৬ গোল করেন গাবি, এরপরই নজরে আসেন ভিয়ারিয়াল, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার মতো বড় দলগুলোর স্কাউটদের। প্রথম দেখাতেই মেরুন-নীল জার্সিটাকে পছন্দ করে ফেলেন গাবি, বাবাকে বলে এগারো বছর বয়সে ভর্তি হয়ে যান লা মাসিয়ায়। লস পালাসিওসে পরিবারকে ছেড়ে এসে লা মাসিয়ায় একা একা থাকাটা প্রথম দিকে খুব কষ্টকর ছিল গাবির জন্য। তবে যতই সময় গড়াতে থাকে, ততই বুকের মধ্যে পুষে রাখা একটা ছোট্ট স্বপ্ন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, আর সেই স্বপ্নের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যেতে থাকে পরিবারকে ছেড়ে একার কষ্টটা। বার্সেলোনার জার্সি পরে বল পায়ে বিশাল ন্যু ক্যাম্পের সবুজ ঘাসে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন!

 La Masía Talents: Pablo Páez, Gavi – Episode 21 | Barca Universal

ন্যু ক্যাম্পে খেলার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এই মৌসুমে, প্রথম গোলও পেয়ে গেছেন মেরুন-নীল জার্সিতে। এবার একটু গাবির খেলার ধরনের দিকে আলোকপাত করা যাক। গাবি খেলেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে, বার্সার প্রথাগত তিন মিডফিল্ডার কাঠামোর বাঁ পাশে থেকেই খেলা শুরু করেন তিনি, কিংবদন্তি আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা যে পজিশনে খেলতেন। মাঠের খেলায় গাবির সবচেয়ে বড় গুণ ‘পজিশনাল প্লে’, অর্থাৎ, বল পায়ে এগিয়ে যাওয়া সতীর্থের রেখে যাওয়া খালি স্থান তিনি দারুণভাবে পূরণ করতে পারেন, ফলে প্রতিপক্ষ দ্রুত আক্রমণে উঠতে পারে না। এছাড়া গাবির ভিশনও দারুণ, চমৎকারভাবে সতীর্থদের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, ফলে কেউ ফাঁকা স্থানে বা বক্সে রান নিলে তাঁকে দারুণভাবে পাস বা থ্রু বল বাড়িয়ে দিতে পারেন গাবি, বার্সেলোনার অপর দুই তরুণ সতীর্থ নিকো গঞ্জালেস আর রোনাল্ড আরাউহোকে এভাবে অ্যাসিস্টও করেছিলেন তিনি। এছাড়া গাবি নিজেও দারুণভাবে বক্সে রান নিতে পারেন। মধ্যমাঠে বল পেয়ে পাস দিয়ে দিতে পারেন একটু নিচে নেমে আসা উইঙ্গার বা ফরোয়ার্ডকে, এরপর ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে নিজেই দৌড়ে পৌঁছে যান প্রতিপক্ষের বক্সে, তৈরি করেন গোলের সুযোগ। এছাড়া বল পায়ে থাকা অবস্থায় নিজের দিকে টেনে নিতে পারেন প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের, ফলে দলের ফরোয়ার্ডরা ফাঁকা জায়গা পেয়ে যান। সব মিলে তরুণ মস্তিষ্কটাকে কাজে লাগিয়ে গাবি ম্যাচটাকে পড়তে পারেন অনেক প্রাপ্তবয়স্কের চেয়েও নিখুঁতভাবে।

 1357782166.0

গাবির ড্রিবলিং ক্ষমতাও দারুণ। দ্রুত চারদিক পর্যবেক্ষণ আর অসাধারণ পায়ের কাজ দিয়ে ধোঁকা দিতে পারেন নিজের চেয়ে শক্তিশালী ডিফেন্ডারকে। বুদ্ধির ছোঁয়া রাখেন এরিয়াল ডুয়েলেও। ‘অফ দ্য বল’, অর্থাৎ পায়ে বল না থাকা অবস্থায়ও খেলায় গাবির প্রভাব থাকে। দলের রক্ষণে সাহায্য করা, প্রতিপক্ষকে প্রেস করা, বল কেড়ে নেওয়া প্রতিটা কাজেই তিনি অংশ নেন। চমৎকার ‘ডিফেন্সিভ ওয়ার্করেট’ এর জন্য জাভি আর এনরিকের কাছেও প্রিয় তিনি। নেশনস লিগের সেমিফাইনালে ইতালির বিপক্ষে ম্যাচে কোচ লুইস এনরিকে মার্কো ভেরাত্তিকে মার্ক করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন গাবিকে। ভেরাত্তিকে বোতলবন্দী করে জাতীয় দলের জার্সিতে সেবারই প্রথম নিজেকে চিনিয়েছিলেন গাবি।

 Xavi on Gavi "He is the future of the club"

লা মাসিয়া, বার্সা আর স্পেনের যুবদলে খেলা, মূল দলে অভিষেক, বার্সার হয়ে প্রথম গোল প্রাপ্তি, গাবির ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছে রূপকথার মতো। কিন্তু বয়স যেহেতু মাত্র সতেরো, পা হড়কানোর আশঙ্কাটা ফেলে দেওয়ার মতো না। বড় কোন ইনজুরিতে পড়ার শঙ্কা আছে, তারকাখ্যাতিতে ভেসে নিজেকে হারিয়ে ফেলার শঙ্কা আছে, ফর্ম হারিয়ে ফেলার শঙ্কা আছে। গাবির ওপর এখনই তাই অতিরিক্ত প্রত্যাশা বা কাজের ভার চাপিয়ে না দেওয়াই বোধহয় ভালো, জাভি-এনরিকের পাশাপাশি দর্শক-সমর্থকেরাও সেটা নিশ্চয়ই বুঝবেন।

 The reason why Gavi plays with his bootlaces undone – Thick Accent

আর হ্যাঁ, বার্সেলোনার হয়ে প্রতিটা ম্যাচ খেলার পরই অন্তর্জালের দুনিয়ায় গাবির একটা ছবি ভেসে বেড়ায়। ছবিটা অনেকটা এমন, খোলা জুতোর ফিতা নিয়েও দৌড়াচ্ছেন, খেলছেন গাবি। গাবির প্রথম কোচ ম্যানুয়েল ভাস্কোর চোখে অবশ্য এটা নতুন কিছু না। সেই ছয় বছর বয়সী গাবিও যেমন জুতোর ফিতা লাগাতে পারতেন না, এখনকার সতেরো বছর বয়সী গাবিও পারেন না, তাতে অবশ্য তাঁর খেলায় কোন প্রভাব পড়ে না।

 

অবশ্য জুতোর ফিতা লাগাতে না পারলেও সমস্যা নেই, ভবিষ্যতে বড় বড় ট্রফির দু’পাশে মেরুন-নীল ফিতা লাগাতে পারলেই হবে! আর ছাত্রের ঐ সাফল্যের পরে সাংবাদিকদের অজস্র ফোনের ‘যন্ত্রণা’ সইতেও নিশ্চয়ই আপত্তি থাকবে না ম্যানুয়েল ভাস্কোর!