• ফুটবল

অবিশ্বাস্য ফাইনালে মোহামেডানের জয়

পোস্টটি ৩২২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

বিশ্বকাপের ফাইনালের পুনঃমঞ্চায়ন নয়তো?

অবশ্য কোথায় গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ এর সর্বকালের সেরা ফাইনাল, আর কোথায় বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ের ১৯২ নম্বর দেশের ‘সামান্য’ ফেডারেশন কাপের ফাইনাল। তুলনাটা হয়তো হাস্যকর রকমের বাড়াবাড়ি হয়ে যায়।

কিন্তু আপনি যদি গতকাল বিকালে উপস্থিত থাকেন কুমিল্লার ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে, অথবা চোখ রেখে থাকেন ইউটিউবের লাইভে, অথবা অন্তত আজকের সংবাদমাধ্যমে বুলিয়ে থাকেন, আপনি নিশ্চিতভাবেই জানেন, আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচটা কোন অংশেই আর্জেন্টিনা-ফ্রান্সের ঐ ফাইনালের থেকে কম কিছু ছিল না। দর্শকের উপস্থিতির সাথে মাঠের খেলায় আক্রমণ, প্রতিআক্রমণ, গোল, পাল্টা গোল, পেনাল্টি, টাইব্রেকার, কী ছিল না গতকালের ম্যাচে! সব নাটকের শেষে নায়কের নাম সোলেমান দিয়াবাতে, চার চারটা গোল করে একা হাতেই শিরোপাটা ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন মোহামেডানের অধিনায়ক। 

বিরতির পর ৫৬ মিনিটে সোলেমান দিয়াবাতে মোহামেডানের হয়ে এক গোল শোধ করেন। তাঁর উদ্‌যাপনেই বোঝা যাচ্ছে, ম্যাচে ফিরতে কতটা মরিয়া ছিল মোহামেডান

(ছবি: প্রথম আলো)

নায়কের নামটা হতে পারতো আহসান হাবিব বিপুও। মূল গোলরক্ষক মোহাম্মদ সুজনের ইনজুরিতে বদলি হিসেবে নেমে টাইব্রেকারে দুটো শট ঠেকানো, এর মধ্যে একটা আবার বিশ্বকাপ খেলা দানিয়েল কলিনদ্রেসের, এই ম্যাচে তাঁর নায়ক না হওয়াটাই তো অস্বাভাবিক। অথবা ঐ কলিনদ্রেসের কথাই ধরুন, কিংবা ফাহিম, বা এমেকা, অথবা রহমত। প্রত্যেকেই তো গোল করেছিলেন এই ম্যাচে, আর প্রত্যেকের গোলের জবাব দিয়েছেন সাদা-কালোদের একজনই। সোলেমান দিয়াবাতে।

অথচ ম্যাচের শুরুটা একেবারেই তেমন ছিল না, অন্তত প্রথমার্ধ তো নয়ই। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ ছিল বটে, কিন্তু প্রতিপক্ষের গোলমুখের সামনে অপেক্ষাকৃত ক্ষুরধার দলটার নাম ছিল আবাহনীই। ফাহিম আর কলিনদ্রেসের গোলে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় আকাশী হলুদরা। কুমিল্লার ৩৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাটা তখন যেন আরেকটু বেড়ে গেছে আবাহনী সমর্থকদের গর্জনে।

৪৪ মিনিটে আবাহনীর হয়ে দ্বিতীয় আঘাতটি কলিনদ্রেসের। কোনাকুনি শটে গোল করে উদ্‌যাপন কোস্টারিকান ফুটবলারের

(ছবি: প্রথম আলো)

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই কৌশলে পরিবর্তন আনলেন মোহামেডানের কোচ আলফাজ আহমেদ। তাতেই আক্রমণের পর আক্রমণ করতে শুরু করে মতিঝিলপাড়ার দলটা। ফলাফলও চলে আসে হাতে হাতে। ৫৬ থেকে ৬০, এই পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুইবার আবাহনীর জালে বল জড়ান অধিনায়ক সোলেমান দিয়াবাতে। ‘ঢাকা ডার্বি’ তখন সমতায়, একটু আগেও ভীষণ হতাশ মোহামেডান সমর্থকেরা তখন উন্মাতাল।

কিন্তু খেলাটা যেহেতু ফাইনাল, এবং দলটার নাম আবাহনী, তারাই বা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের আচমকা প্রত্যাবর্তনের চাপে ভেঙে পড়বে কেন! ছয় মিনিটের মধ্যে গ্যালারির আকাশি অংশে আবারও উল্লাস, এবার এমেকার শটে পরাস্ত মোহামেডানের গোলরক্ষক মোহাম্মদ সুজন। 

হয়তো খেলার শেষটা তখনই হতে পারতো, কিন্তু বিধাতার চাওয়া ছিল অন্যরকম। ৮৩ মিনিটে কর্নার পেলো মোহামেডান। উড়ে আসা সেই কর্নার থেকে আবারও ম্যাচে ফিরলো সাদা-কালোরা, আবারও আনন্দের জোয়ার বয়ে গেলো গ্যালারিতে। উল্লাসের মধ্যমণির নাম তো আপনি জানেনই!

অতিরিক্ত ত্রিশ মিনিটের পনেরোতম মিনিটে আবারও সেই নায়ক এলেন মঞ্চে। আবাহনীর রক্ষণকে ছত্রখান করে দিয়ে যখন ছুটছেন দিয়াবাতে, তাঁর সামনে শুধুই আগুয়ান গোলরক্ষক শহীদুল আলম সোহেল। নিরুপায় সোহেল ফাউল করে বসলেন দিয়াবাতেকে। পেনাল্টি! ইতোমধ্যে তিন গোল করে ফেলেছেন, এমন দিনে কি দিয়াবাতে ভুল করতে পারেন? পারেন না। সোহেলকে ভুল দিকে ছিটকে ফেলে পূর্ণ করলেন নিজের ‘পোকার’, মোহামেডানকে এগিয়ে দিলেন প্রথমবারের মতো।

ফাইনাল দেখতে ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে প্রচুর দর্শকের সমাগম হয়েছিল

(ছবি: প্রথম আলো)

দিয়াবাতের চার গোল, দুই গোলে পিছিয়ে পড়া মোহামেডানের অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন, ম্যাচটা এখানে সমাপ্ত হলেও খুব বেশি অসন্তুষ্টির জায়গা ছিল না। কিন্তু নাটক যে তখনও বাকি। পুরো ম্যাচে চমৎকার কিপিং করা মোহামেডানের গোলরক্ষক সুজনকে মাঠ ছাড়তে হলো চোট নিয়ে। সদ্য মাঠে নামা বিপু হয়তো তখনও আলো হাওয়ার সাথে নিজেকে ধাতস্থ করে উঠতে পারেননি, এর মধ্যেই বক্সের বাইরে থেকে রহমত মিয়ার শট। দূরপাল্লার বিশ্বমানের শটে কেবল হাতই ছোঁয়াতে পারলেন, খেলায় চলে এলো ৪-৪ এ সমতা। থামা ঘড়ির কাঁটায় তখন ১১৮ মিনিট।

তবে বাকি সময়ে কোন দলই জালের দেখা না পাওয়ায় ম্যাচ গড়ালো টাইব্রেকারে, হয়তো ভাগ্যবিধাতাই এই রোমাঞ্চকর ম্যাচের শেষটা টানতে চেয়েছিলেন রোমাঞ্চের চূড়ায় নিয়েই। তাই বলে যেন ভাববেন না, যে ম্যাচের বাকি পাঁচ-ছয় মিনিটে কোন আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ হয়নি!

টাইব্রেকারের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। আবাহনীর গোলরক্ষক শহীদুল আলম সোহেলের এক শট ঠেকানোর বিপরীতে মোহামেডানের শেষপ্রহরী আহসান হাবিব বিপু ঠেকালেন দুই শট। আর তাতেই নিশ্চিত হয়ে গেল, চৌদ্দ বছর পরে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে ওঠা মোহামেডানের ঘরেই যাচ্ছে শিরোপা। একই সাথে সাদা-কালোদের নয় বছরের শিরোপা খরাও কেটে গেল, উল্টো দিকে শিরোপাশূন্য মৌসুম শেষ করলো আকাশি-হলুদের আবাহনী।

টাইব্রেকারে জয়ের পর মোহামেডানের খেলোয়াড়দের উদ্‌যাপন

(ছবি: প্রথম আলো)

তবে এমন দিনে, শুধু শিরোপাটাই মোহামেডানের অর্জন নয়। আশি-নব্বইয়ের দশকের রমরমা দেশীয় ফুটবলের দিনগুলোকে আরেকবার ফিরিয়ে আনা, তুমুল উত্তেজনা আর মন মাতানো ম্যাচ উপহার দিয়ে দর্শকের হৃদয়ে জিতে নেওয়া, স্মৃতিকাতরতা আর সন্তুষ্টির অসাধারণ মিশেল উপহার দেওয়া, মোহামেডানের অলিখিত অর্জনের তালিকাটা একেবারে ছোট নয়।

যে অর্জনের সমান অংশীদার মাঠের পরাজিত আবাহনীও!