• ফুটবল

পর্তুগালের স্বপ্নযাত্রা

পোস্টটি ১০৩৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

গ্রুপ পর্বে তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে সহজ গ্রুপ পেল তারা। কিন্তু তাতে কি হবে? তিনটি ম্যাচের কোনোটিতেই পেলনা জয়ের দেখা। অবশেষে চার দলের গ্রুপে তৃতীয় হয়েও তারা ভাগ্যের জোরে কোনোরকমে দ্বিতীয় রাউন্ডে পা রাখলো। কিন্তু এরপর? এরপর কি হলো?

সবচেয়ে সহজ গ্রুপ পাওয়ার পরও জয়হীন থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গ্রুপ পর্ব পার করা সেই দলটি হলো কিনা টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন!!! এমন অদ্ভুত ঘটনা ফুটবল দুনিয়া আর কখনো দেখেছি কি? এমন অসাধারণ কামব্যাক, এমন অবিশ্বাস্য যাত্রা...আর সবশেষে নিজেদের ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র বড় কোনো অর্জন। এ যেন এক রূপকথার গল্প!

image_search_1656527124487
প্রায় সবসময়ই একটা বড় শক্তি হিসেবে ফুটবল বিশ্বে বিরাজ করেছে পর্তুগাল। বিশ্ব ফুটবল কে অসংখ্য তারকা ফুটবলাররাও উপহার দিয়েছে এ দেশটি। ইউসেবিও, লুইস ফিগো, পাউলেতা, রুই কস্তা, রিকার্দো কারভালহো, ডেকো, পাওলো ফুয়েত্রে থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, নানি, পেপে, রিকার্দো কোয়ারেজমা। সময়ের সাথে সাথে অসংখ্য মহাতারকা মাঠ মাতিয়েছেন পর্তুগিজ জার্সি গায়ে। ইউসেবিওর হাত ধরে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলেছে তারা। রুই কস্তা, লুইস ফিগো, পাউলেতারা বিশ্বকাপ সেমির পাশাপাশি ইউরো ফাইনালেও নিয়ে গেছেন পর্তুগালকে। কিন্তু শিরোপা তাদের অধরাই থেকে গেছে সবসময়।

২০১৪ বিশ্বকাপে বাজে পারফর্মেন্স ও গ্রুপ পর্বেই ছিটকে পড়ার পর ইউরো কোয়ালিফায়ার্সের প্রথম ম্যাচে আলবেনিয়ার কাছে হেরে যায় পর্তুগাল। ফলস্বরূপ ম্যানেজারের আসন থেকে ছিটকে যান পাওলো বেন্তো। তার জায়গায় পর্তুগালের নতুন ম্যানেজার হিসেবে অধিষ্ঠিত হন ফার্নান্দো সান্তোস।

কোচের দায়িত্ব নিয়েই চমক দেখান সান্তোস। তার অধীনে ইউরো কোয়ালিফিকেশন ক্যাম্পেইনে টানা সাত ম্যাচে জয় পায় পর্তুগিজরা। ফলাফল, গ্রুপের শীর্ষে থেকে ইউরো নিশ্চিত করে তারা।

অবশেষে ঘনিয়ে আসে ইউরো ২০১৬। পর্তুগালের দল টা সেবার খারাপ ছিলোনা। দলে ছিলেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। তার সাথে ছিলেন অভিজ্ঞ পেপে, নানি রা।

image_search_1656528725789
তারকা খুব কম না থাকলেও টুর্নামেন্ট জয়ের জন্য তারা একদমই ফেভারিট ছিলোনা। সবচেয়ে বড় কন্টেন্ডার হিসেবে ছিলো তারকায় ঠাসা স্বাগতিক ফ্রান্স। এছাড়া দুবছর আগে বিশ্বকাপ জেতা জার্মানি, আগের দুই ইউরো ও ২০১০ বিশ্বকাপ জেতা স্পেন এবং গোল্ডেন জেনারেশন পার কর‍তে থাকা বিশ্ব র‍্যাংকিং এর শীর্ষ দল বেলজিয়াম ছিলো শিরোপার বড় দাবিদার। সব মিলিয়ে আন্ডারডগ হিসেবেই টুর্নামেন্ট শুরু করে পর্তুগাল।

গ্রুপ পর্বে বেশ সহজ গ্রুপ পেয়েছিল পর্তুগিজরা। তাদের গ্রুপে বাকি তিনটি দল ছিলো নামে ভারে বেশ পিছিয়ে থাকা হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া ও আইসল্যান্ড। তাদের থেকে শক্তির বিচারে অনেক এগিয়ে ছিলো পর্তুগাল। তাই ধারণা করা হচ্ছিলো অনায়াসেই সব কটি ম্যাচ জিতে গ্রুপ পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের রাউন্ডে উৎরে যাবে তারা।

প্রথম ম্যাচে তাদের মুখোমুখি হয় আইসল্যান্ড। ইউরো ইতিহাসে সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে টুর্নামেন্টে খেলতে এসেছিলো তারা। সেই সাথে এটি ছিলো তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বড় কোনো টুর্নামেন্টে।

আশা করা হচ্ছিলো বেশ ভালোভাবেই টুর্নামেন্ট শুরু করবে পর্তুগাল। খেলার শুরুতেও সেই আভাসই পাওয়া গেলো। নানির অসাধারণ এক গোলে ম্যাচের শুরুর দিকেই এগিয়ে যায় পর্তুগিজরা। ১-০ গোলে এগিয়ে থেকেই তারা প্রথমার্ধ শেষ করে। তবে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই বেশ চমকপ্রদভাবে ম্যাচে ফেরে আইসল্যান্ড। দারুণ এক গোল করে সমতা ফেরায় তারা। গোল হজম করার পর পুরো ম্যাচ জুড়ে ডমিনেট করে পর্তুগাল। গোলে তারা মোট ২৬ টি শট নেয়! কিন্তু আইসল্যান্ডের অসাধারণ ডিফেন্ডিং তাদের রুখে দেয় প্রত্যেকবার। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও নিজের জাত চেনাতে ব্যর্থ হন। ফলে ড্র নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় পর্তুগালকে।

অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচেও দেখা যায় একইরকম চিত্র। আবারও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ব্যর্থ হন তাঁর স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে। এমনকি এ ম্যাচে একটি পেনাল্টিও মিস করেন তিনি। তাঁর সাথে সাথে পর্তুগালেরও হয় একই অবস্থা। যদিও মাঠের খেলায় অস্ট্রিয়ার চেয়ে বেশ এগিয়ে ছিলো পর্তুগিজরা, কিন্তু অস্ট্রিয়ান ডিফেন্স ভেদ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় তারা। ফলাফল গোল শূন্য ড্র নিয়ে ড্রেসিং রুমে ফিরতে হয় তাদের। সেই সাথে ১৯৮২ সালের পর প্রথমবারের মতো মেজর কোনো টুর্নামেন্টে ক্লিনশিট পায় অস্ট্রিয়া।

image_search_1656527532687
এরপর পর্তুগাল নিয়ে বড় বড় মিডিয়ায় নানারকম সমালোচনা শুরু হয়। বড় বড় ফুটবল বিশেষজ্ঞরা তাদের ওয়ান ম্যান টিম হিসেবে মন্তব্য করেন। টানা বাজে খেলায় বড় ধরনের সমালোচনার প্রেসার আসে দলের প্রধান তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ওপর। মেজাজ হারিয়ে ফেলেন তিনিও। হাঙ্গেরির বিপক্ষে ম্যাচের আগে এক সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের হাত থেকে মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নিয়ে নদীতে নিক্ষেপ করেন তিনি।

গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে টেবিল টপার হাঙ্গেরির মুখোমুখি হয় পর্তুগাল। ম্যাচের শুরু থেকেই পুরোপুরি আক্রমণাত্মক খেলতে থাকে তারা। কিন্তু এবারও ভাগ্য তাদের ধোঁকা দিচ্ছিলো। খেলায় পর্তুগাল এগিয়ে থাকলে হঠাৎ অভিজ্ঞ হাঙ্গেরিয়ান মিডফিল্ডার জোলতান গেরা ভলি থেকে দারুণ এক গোল করে এগিয়ে দেন হাঙ্গেরিকে। এরপর কাউন্টার থেকে গোল করে সমতায় ফেরে পর্তুগাল। অসাধারণ থ্রিলিং এ ম্যাচে এরপর আরও দুইবার এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি এবং দুইবারই সমতায় ফেরে পর্তুগাল। অবশেষে ৩-৩ গোলে শেষ হয় ম্যাচ।

প্রথম দুই ম্যাচে বাজে পারফর্মেন্সের পর এ ম্যাচে ছন্দে ফেরেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। সব সমালোচনার জবাব দিয়ে প্রায় একা হাতে পুরো ম্যাচে পর্তুগাল কে টেনে নিয়ে যান তিনি। তিনি নিজে করেন জোড়া গোল, সেই সাথে দলের অন্য গোলটিতেও নানি কে এসিস্ট করেন।

image_search_1656527489741
গ্রুপে তৃতীয় হয়ে গ্রুপ পর্ব শেষ করে পর্তুগিজরা। গ্রুপ পর্বের কোনো ম্যাচে জয়ের দেখা না পেয়েও গোল ব্যবধানে সেরা চার থার্ড প্লেসড টিমের একটি হয়ে কোনোরকমে শেষ ষোল তে উঠে যায় তারা।

রাউন্ড অব সিক্সটিনে তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় মদ্রিচ-রাকিটিচদের ক্রোয়েশিয়া কে। গ্রুপ পর্বে দারুণ পারফর্মেন্স দেখিয়ে শেষ ষোলোয় এসেছিলো ক্রোয়েশিয়া। গ্রুপ ডি তে ডিফেন্ডিং ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে ২-১ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো তারা। সে ম্যাচের পর অনেক ফুটবল বিশ্লেষক সেবারের ইউরোর ডার্ক হর্স হিসেবে অভিহিত করেছিল তাদের।

পর্তুগাল বনাম ক্রোয়েশিয়া ম্যাচটা ছিলো দারুণ জমজমাট। দুই দলই লড়াই করছিলো সমানে সমানে। গ্রুপ পর্বের ভুল থেকে শিক্ষা পেয়ে ডিফেন্স বেশ পোক্ত করে ফেলেছিলো পর্তুগাল। লুকা মদ্রিচ, ইভান রাকিতিচ, ইভান পেরিসিচদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বারাবার রুখে দিচ্ছিলো তারা। অন্যদিকে ক্রোয়েশিয়াও কম যায়না। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কে পুরো ম্যাচে আটকে রাখে তারা। ইউরোতে সেদিনই প্রথমবারের মতো পুরো নব্বই মিনিটে গোলে কোনো শটই নিতে পারেননি সিআর সেভেন।

গোলশূন্য সমতায় নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানেও একইরকম চিত্র। দুই দলই দেখায় ডিফেন্সিভ মাস্টারক্লাস। পুরো ম্যাচে টার্গেটে একটাও শট নিতে পারেনি ক্রোয়াটরা। অতিরিক্ত সময়ও প্রায় শেষ হয়েই যাচ্ছিলো। যখন সবাই ধরেই নিয়েছে পেনাল্টি শুট আউট অবশ্যম্ভাবী, ঠিক তখনই ১১৭ মিনিটের মাথায় দারুণ এক হেডার থেকে গোল করেন বদলি হিসেবে নামা রিকার্দো কোয়ারেজমা। সেই সাথে ১-০ গোলের কষ্টার্জিত জয় নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে যায় পর্তুগাল।

image_search_1656527456733
কোয়ার্টার ফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় লেভানডভস্কির পোল্যান্ডের। পোল্যান্ড ছিলো ইউরোর আরেকটি চমক। গ্রুপ পর্বে তারা নর্দান আয়ারল্যান্ড ও ইউক্রেন কে ১-০ গোলে হারানোর পর জার্মানিকেও রুখে দেয়, গোলশূন্য ড্র করে তাদের সাথে। এরপর শেষ ষোলোয় সুইজারল্যান্ড কে হারায় পেনাল্টি শুট আউটে।

সময়ের অন্যতম সেরা দুই তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও রবার্ট লেভানডভস্কির লড়াই ছিলো বেশ উপভোগ্য। ম্যাচের শুরুতেই দুই মিনিটের মাথায় গোল করে পোল্যান্ড কে এগিয়ে দেন লেভানডভস্কি। তবে ম্যাচে ফিরতে দেরি হয়নি পর্তুগালের। পেনাল্টি এরিয়া থেকে তরুণ রেনাতো সানচেসের গোলে সমতায় ফেরে তারা। সেই সাথে ইউরো ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী গোলদাতা হিসেবে রেকর্ড গড়েন সানচেস। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১৮ বছর ৩১৬ দিন।

এরপর অসংখ্য আক্রমণ করেও বাকি সময়ে আর গোলের দেখা পায়নি কোনো দলই। অবশেষে ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টি শুট আউটে। সেখানে ৫-৩ গোলে জয়লাভ করে পর্তুগাল। সেই সাথে ইউরো ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে নির্ধারিত সময়ে কোনো ম্যাচ না জিতে শেষ চারে যাওয়ার কীর্তি গড়ে পর্তুগিজরা। উল্লেখ্য যে, তখন অবধি পুরো টুর্নামেন্টেই পর্তুগাল লিড পেয়েছিলো মাত্র ২২ মিনিটের জন্য!

সেমিফাইনালে পর্তুগালের মুখোমুখি হয় পুরো টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ প্যাকেজ গ্যারেথ বেলের ওয়েলস। ১৯৫৮ সালের পর সেবার প্রথম কোনো মেজর টুর্নামেন্ট খেলতে এসেছিলো ওয়েলস, আর এসেই সবাইকে চমকে দিয়ে গ্যারেথ বেলের অবিশ্বাস্য পারফর্মেন্সে ভর করে পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে। কোয়ার্টার ফাইনালে তারা হারিয়েছিলো তারকাসমৃদ্ধ বিশ্ব র‍্যাংকিং এর শীর্ষ দল বেলজিয়ামকে।

এবার পুরো টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো নির্ধারিত নব্বই মিনিটেই জয়ের দেখা পায় পর্তুগাল। এ ম্যাচে তাদের খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। বেশ সহজেই ওয়েলসের বিপক্ষে ২-০ গোলে জয় তুলে নেয় তারা। গোল দুটি আসে সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সতীর্থ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও নানির পা থেকে।

image_search_1656527197890
অবশেষে আসে ফাইনাল। ২০০৪ সালের পর আবার ইউরো ফাইনালে পা রাখে পর্তুগাল। সেবার গ্রীসের বিপক্ষে পরাজিত হয়ে তরুণ রোনালদোর চোখের জলে পর্দা নেমেছিলো ইউরোর৷ দীর্ঘ ১২ বছর পর আবারও ফাইনালে পর্তুগাল। তবে এবার আর তরুণ রোনালদো নয়, এ বিশ্ব জয় করা অভিজ্ঞ ও পরিণত
রোনালদো।

প্রতিপক্ষ ছিলো শুরু থেকে শিরোপার সবচেয়ে বড় দাবিদার ফ্রান্স। এর আগে নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ, ইউরো ও কনফেডারেশন কাপ জেতা ফ্রান্স আবারও নিজেদের মাঠে খেলতে যাচ্ছে ইউরো ফাইনাল। সেই সাথে দলের দুর্দান্ত ফর্ম। গ্রিজমান পায়েতে ভর করে শুরু থেকেই ফ্রান্স যেন উড়ছিলো। তাই ফাইনালেও আন্ডারডগ হিসেবেই খেলতে নামে পর্তুগাল।

স্তাদে ডি ফ্রান্সে প্রায় ছিয়াত্তর হাজার লোকের মহাসমারোহে লড়াই টা জমেছিলো বেশ। তবে পর্তুগালের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ম্যাচের শুরুতেই। সাত মিনিটের মাথায় ফ্রেঞ্চ মিডফিল্ডার দিমিত্রি পায়েতের সাথে সংঘর্ষে জড়ান পর্তুগিজ সুপারস্টার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। এতে হাঁটুতে মারাত্মক আঘাত পান সিআর সেভেন। এরপরও বেশ কিছুক্ষণ খেলা চালিয়ে যান। কিন্তু বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারেননি সে যন্ত্রণা। পঁচিশ মিনিটের মাথায় অশ্রুভেজা চোখে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন।

পর্তুগালকে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে প্রায় একা হাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন রোনালদো। তাঁর অনুপস্থিতি পুরো টিমের মনোবলকেই দূর্বল করে দেয়। কিন্তু এরপরও ভেঙে পড়েনি পর্তুগাল। রোনালদোর অনুপস্থিতির সুযোগ নিতে ব্যর্থ হয় স্বাগতিকরা। সেই সাথে অতীমানবীয় পারফর্ম করছিলেন গোলকিপার রুই প্যাট্রিসিও এবং দুই সেন্টার-ব্যাক পেপে ও হোসে ফন্তে। এই ত্রয়ী নির্মাণ করেছিলো এক দুর্ভেদ্য দেয়াল, যা বারবার প্রতিহত করে দিচ্ছিলো ফ্রান্সের মুহুর্মুহু আক্রমণ।

image_search_1656527229505
নির্ধারিত সময়ে গোল করতে ব্যর্থ হয় দু দলই। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ে পর্তুগালের খেলায় হঠাৎ যেন প্রাণ ফিরে আসে। নির্ধারিত সময় প্রায় পুরোটা জুড়ে ফ্রান্সের আক্রমণ ঠেকিয়েই যাচ্ছিলো তারা। কিন্তু এবার তারাও আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করে। ১০৮ মিনিটে রাফায়েল গেরেরোর ফ্রি কিক রুখে দেয় বারপোস্ট।

এরপরই আসে সেই স্মরণীয় মুহূর্ত। ১০৯ মিনিটের মাথায় ফ্রান্সের গোলপোস্টের পঁচিশ গজ দূর থেকে অসাধারণ এক লো ড্রাইভ শট নেন বদলি হিসেবে নামার এডার। ফ্রেঞ্চ প্রতিরক্ষা ভেদ করে বল জড়িয়ে যায় জালে। স্তাদে ডি ফ্রান্সের হাজার হাজার স্বাগতিক দর্শক মুহূর্তেই হয়ে পড়ে বাকরুদ্ধ। সেই সাথে রচিত হয় রূপকথা।

চ্যাম্পিয়ন হয় পর্তুগাল! ইউরো চ্যাম্পিয়ন! ইউরোপসেরার মুকুট মাথায় পড়ে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের দেশ। অবসান ঘটে শত অপেক্ষার। নাহ, এবার আর পরাজয়ের গ্লানিতে চোখের জল ফেলতে হয়নি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে। এবারও তার চোখ থেকে ঝরেছে অশ্রুবিন্দু, তবে সেটা দুঃখের নয়, পরম আনন্দের।

পর্তুগালের এ জয় ছিলো তাদের সমৃদ্ধ ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র বড় অর্জন। পর্তুগিজ ফুটবল বিশ্ব ফুটবলে মুগ্ধতা ছড়িয়ে আসছিলো প্রায় শত বর্ষ জুড়ে৷ কিন্তু অর্জনের খাতা টা ফাঁকাই পড়ে ছিলো। অবশেষে সেখানে যুক্ত হলো বিরাট এক অর্জন। পর্তুগালের সর্বকালের সেরা ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর হাত ধরে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের নাম উজ্জ্বল অক্ষুণ্ণ করে ফেললো তারা।

image_search_1656527054706
পর্তুগাল অবশ্য তাদের খেলার জন্য সমালোচিতও হয়েছিলো বেশ। সেটার কারণও ছিলো বৈকি। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে মাত্র একটি ম্যাচ তারা নির্ধারিত সময়ে জিতেছিল। অনেকেই মন্তব্য করেছিলো  পর্তুগাল এ শিরোপা জয়ের যোগ্য দাবিদার ছিলোনা।

কিন্তু সমালোচনা যতই হোক, ফার্নান্দো সান্তোসের দল দেখিয়েছিলো টিম স্পিরিট, দেখিয়েছিলো কিভাবে বারবার পিছিয়ে পড়েও ঘুরে দাঁড়াতে হয়। হাঙ্গেরির বিপক্ষে ডু অর ডাই ম্যাচে তিনবার পিছিয়ে পড়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। পোল্যান্ডের বিপক্ষে শুরুতেই বিরাট ধাক্কা খেয়েও কামব্যাক করেছিলো। আর ফাইনালে দলের সেরা তারকাকে হারিয়েও মনোবল অটুট রেখে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে জয়ী হয়েছিলো।

সেই সাথে শুরুতে অসংখ্য ভুল করেও আস্তে আস্তে সেগুলো শুধরে নিয়ে নিজেদের সুগঠিত করেছিলো তারা। শুরুর দিকে তাদের ডিফেন্সের অবস্থা ছিলো যাচ্ছেতাই। গ্রুপ পর্বে সেটার জন্য স্ট্রাগল করার পর আস্তে আস্তে তারা নির্মাণ করে ইস্পাত কঠিন ডিফেন্স। হাঙ্গেরির বিপক্ষে এক ম্যাচে তিন গোল হজম করার পর তারা ডিফেন্স কে এতটা পাকাপোক্ত করে ফেলে যে নকআউট স্টেজের চারটি ম্যাচ মিলিয়ে তারা হজম করে মাত্র এক গোল।

তাই পর্তুগালের এ অর্জন শুধু বিশ্ব ফুটবলের এক অবিস্মরণীয় ঘটনাই নয়, তাদের এ অর্জনে ছিলো মানবজাতির জন্য বিরাট শিক্ষা। ইউরো জয়ের এ স্বপ্নযাত্রায় তারা শিখিয়েছে কিভাবে বারবার খারাপ পরিস্থিতিতেও মাথা ঠান্ডা রেখে কামব্যাক করতে হয়, তারা শিখিয়েছে কিভাবে নিজেদের সমস্যা চিহ্নিত করে সেসব সমাধান করে নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হয়, তারা শিখিয়েছে কিভাবে বিরাট বড় আঘাত এলেও মনোবল অটুট রেখে শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে হয়।

এ সব কিছুর জন্যই পর্তুগালের স্বপ্নজয়ের এ যাত্রা বিশ্ব ফুটবলে চিরকাল অম্লান থাকবে।