এসি মিলানের ইতালি জয়ের ইতিকথা
পোস্টটি ১৩৬০ বার পঠিত হয়েছেশেষ আট বছর ধরে স্কুদেত্তো রয়ে গেছে অধরা।দুবার কাছাকাছি যেয়েও ছোয়া হয়নি শিরোপা।সুপারকোপা ইতালিয়ানাও সেই ২০১৬ এর কথা।আর কোপা ইতালিয়া?০২-০৩ এর পর থেকে তার কোনো হদিস নেই।ইতিমধ্যে ৭ বারের ইউরোপ-সেরারা ১৩-১৪ থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি।ডিসেম্বরে আটালান্টার কাছে ৫-০ গোলে হারার পর সমালোচকরা কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছেন।
হ্যাঁ,রোজানেরিদের প্রত্যাবর্তনের গল্পটা শুরু এখান থেকেই। সম্প্রতি ২১-২২ মৌসুমে সিরি-এ জয়ের পর এসি মিলানের বর্তমান কোচ স্টেফানো পায়োলি নিজেই একথা স্বীকার করেছেন।তিনি বলেন," ২০১৯ এর ডিসেম্বরে আটালান্টার সাথে ৫-০ গোলের 'ভয়াবহ' ও 'লজ্জাজনক' হার ছিল আমার কোচিং ক্যারিয়ারের সবচাইতে বাজে মুহূর্তগুলোর একটি।আমি তখনই উপলব্ধি করলাম,দলটাকে আবার গুছিয়ে নিতে হবে।"
২০১৮ সালে মালিকানা হস্তান্তর এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ট্রান্সফার মার্কেটে মিলানের কাজ আরো জটিল হয়ে যায়।তার উপর চ্যাম্পিয়নস লিগে অংশগ্রহণ করতে না পারায় কোনো ভালো খেলোয়াড় আসতে আগ্রহী হচ্ছিল না।ক্লাবের ডাকে সাড়া দিয়ে পাওলো মালদিনি ঐ বছরের আগস্টে স্পোর্টিং স্ট্রাটেজি এন্ড ডেভেলপমেন্টে যোগ দেয়ার মাধ্যমে মিলানে ফেরত আসেন এবং পরবর্তী বছরেই তাকে টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের পদে উন্নীত করা হয়।
মিলান মৌসুম শেষের আগেই রাল্ফ রাগনিকের সাথে ক্লাবের ব্যাপারে আলোচনা অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যায়।চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ইভান গাজিদিস রাগনিককে শুধু মূল দলের দায়িত্বই দিতে চাননি,ক্লাবের প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তার মতামতকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।দেয়ার স্বাভাবিক কারণও ছিল;লাইপজিগ এবং হফেইনহামের মতো ক্লাবকে তিনি শূন্য থেকে আজকের অবস্থানে তুলে এনেছেন।
রাগনিক প্রকল্প নিয়ে ইভান গাজিদিসের সাথে বোভানের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবং বেশ বিরক্তি নিয়েই বোভান ইস্তফা দেন।মালদিনির সাথেও গাজিদিসের মনোমালিন্যের সূচনা হতো।কিন্তু পায়োলির অধীনে মিলান খুব দ্রুত উন্নতি করতে শুরু করে।মালদিনির সাইন করা প্লেয়ারদের প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদের মেলে ধরতে শুরু করেছিলেন।গাজিদিস বুঝতে পেরেছিলেন,মালদিনি যেমন জিয়াম্পাওলোকে এনে ভুল করেছিলেন,পায়োলিকে ছাঁটাই করা হলে তিনিও সেই একই পথের পথিক হবেন।রাগনিক সব সমস্যার সমাধান করতে পারতেন কিনা তা হয়তোবা আমরা কখনোই জানতে পারবোনা,কিন্তু পায়োলিকে শেষমেষ রেখে দেয়ার ফলটা দিবালোকের মত পরিষ্কার।
পায়োলি হয়তোবা মরিনহো,গার্দিওলার কিংবা মার্সেলো বিয়েলসার মতো দক্ষ ট্যাকটিশিয়ান নন,তবে এসি মিলানের দায়িত্ব হাতে পাওয়ার পর থেকে তার ম্যানেজমেন্ট,খেলার ধরন সবই বেশ গোছানো এবং মানসম্মত।গত এক দশকের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পয়েন্ট (৮৬) অর্জন করে শিরোপা পুনরূদ্ধার তারই ইঙ্গিত বহন করে।
কেবল পায়োলির ম্যান ম্যানেজমেন্ট কিংবা ট্যাকটিকাল ব্রিলিয়ান্সই রোজানেরিদের ভাগ্যের চাকা ফেরানোর একমাত্র কারিগর নয়,ট্রান্সফার মার্কেটে মালদিনির সাহসী এবং কৌশলী পদক্ষেপও তাদেরকে স্বল্প খরচে লড়াকু মনোভাবের কিছু তরুণ সৈন্যের পাশাপাশি অভিজ্ঞদের সংমিশ্রণে ভূমিকা রেখেছে।যদিও কিছু কিছু সাইনিং ব্যর্থ হয়েছে,সেগুলোকে একপাশে সরিয়ে রাখলে সাফল্যের পাল্লাটা নিঃসন্দেহে ভারীর দিকেই ঝুঁকে যাবে।
অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থাকায় স্বভাবতই মিলানের টার্গেট ছিল ফ্রি ট্রান্সফার,ধারে নিয়ে আসা অথবা অন্য ক্লাবের একাডেমিক ইয়ুথ ট্যালেন্টকে দলে ভেড়ানো।ডেনমার্কের অধিনায়ক সাইমন জার,শুরুর দিকে সেভিয়া থেকে ধারে এসেছিলেন, মিলানের ডিফেন্সকে পরবর্তী পর্যায়ে নিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।পরে অবশ্য মিলান তার সাথে স্থায়ী চুক্তি করে নেয় ৩.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে।জার ইনজুরিতে পড়লে এ বছরেরে শুরুর দিকে অলিম্পিক লিঁও থেকে ৪৮০,০০০ ইউরোর বিনিময়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে পিয়েরে কালুলুকে মালদিনি মিলানে নিয়ে আসেন।তাক লাগানো বলার কারণ হচ্ছে,সান সিরোতে আসার আগে কালুলু টপ লেভেলে প্রফেশনাল ফুটবলে একটি সিঙ্গেল মিনিটও খেলেননি!
চেলসির মালিকানা রদবদলজনিত সমস্যার কারণে আন্দ্রে ক্রিশ্চেনসেন,টনি রুডিগারদের ছেড়ে দিত বাধ্য হয়েছে দলটি।ট্রান্সফার মার্কেটে নিশ্চয়ই তারা ফিকায়ো তোমোরির মতো একজন সেন্টারব্যাককে অন্তত ২৮ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে দলে ভেড়াতে পারবেনা।মজার ব্যাপার হচ্ছে মিলান তোমোরিকে এই দামেই ব্লুজদের একাডেমি প্রোডাক্টকে কিনে নিয়েছিল।ট্রান্সফার মার্কেট ডটকম অনুযায়ী এই ইংলিশম্যানের মার্কেটভ্যালু ৫০ মিলিয়ন ইউরোতে গিয়ে ঠেকেছে।সামনে হয়তো আরো বাড়তে পারে।
গত মৌসুমে একেবারে বিনামূল্যে জিজি ডোনারুমাকে ছেড়ে দেয়াতে মিলানের ট্রান্সফার পলিসি নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেছিলেন।তবে সব সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন মাইক ম্যাইগনান তার পারফরম্যান্সের মাধ্যমে।এজেন্ট রাইওলার চাহিদার সাথে বনিবনা না হওয়ায় মালদিনি মাত্র ১৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ঐ একই মৌসুমে লীগ ওয়ানের গোল্ডেন গ্লাভস বিজয়ীকে দলে নিয়ে আসেন।ম্যাইগনান সিরি-এ তেও তার প্রথম মৌসুমেই সেরা গোলকিপার হওয়ার পাশাপাশি মিলানের তার উপর রাখা আস্থার প্রতিদান রেখেছেন।
ফ্র্যাংক কেসসিকে নিয়ে আলাদাভাবে বলার কিছু নেই।২০১৭ তে আটালান্টা ছেড়ে আসা কেসসি কম কথা বলেন,কিন্ত নেতৃত্বের গুণাবলির সাথে মিলানের প্রতি তার ভালোবাসা এবং মাঠের খেলায় তার বহিঃপ্রকাশ দলকে সবসময় বাড়তি সুবিধা দিয়েছে।কোনো কোনো মিলান ভক্ত মজা করে তাকে মিলানের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডেকে থাকেন।তারই সতীর্থ সান্দ্রো তোনালি হয়তো ম্যাইগনানের মতো শুরুতেই সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি,তবে সময় যত গড়িয়েছে,খোলস ছেড়ে সাবেক ব্রেসিয়া মিডফিল্ডার নিজের জাত চিনিয়েছেন,হয়ে গেছেন কেসসির পাশাপাশি মিলান মাঝমাঠের আরেক স্তম্ভ। ২২ বছর বয়সী এই খেলেয়াড়কে পায়োলি নিজে ড্যানিয়েল ডি রসির সাথে তুলনা করেছেন।কোচের প্রশংসাবাক্যকে তোনালি কতদূর নিয়ে যেতে পারেন,সেটাই এখন দেখার বিষয়।
তবে মালদিনি জহুরী হিসেবে যে খাঁটি রত্নকে চিনতে ভুল করেননি,তার প্রমাণ মেলে রাফায়েল লিঁও এবং থিও হার্নান্দেজকে সাইন করানোর মাধ্যমে।রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তি জিদান কেনো যে কেবল ২০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে থিওকে যেতে দিলেন,তা আজও রহস্যের বিষয়।লিঁওকে তো ইতিমধ্যে ভক্তরা থিয়েরি অঁরির সাথে তুলনা শুরু করে দিয়েছে।অবশ্যই দুর্দান্ত গতি এবং নিখুঁত ফিনিশিংয়ে অঁরির সাথে লিঁওর যথেষ্ট মিল রয়েছে,কিন্তু আর্সেনালের অঁরিকে ছোয়ার জন্য লিঁওকে আরো অনেকখানি পথ পাড়ি দিতে হবে।তবে সিরি-এ এর মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তার মধ্যে যে সে সম্ভাবনা রয়েছে,তা তিনি ভালোভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন।হার্নান্দেজ এবং রাফায়েলের একটি জায়গায় মিল আছে,সেটা হচ্ছে দুজনকেই মালদিনি নিজে ফোন করে তাদেরকে সান সিরোতে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং তারাও অন্যান্য অভিজাত ক্লাবগুলোর ডাককে উপেক্ষা করে এসি মিলানে যোগ দিয়েছেন।
মালদিনি ও মিলানের ব্যাপারে সবাই মোটামুটি একমত যে খেলোয়াড় কেনাবেচায় এবং দরদামে তাদের দূরদর্শিতা এককথায় অসাধারণ, বিশেষ করে ক্লাবের বর্তমান অবস্থায় তরুণ খেলোয়াড়দেরকে রাজি করিয়ে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে মালদিনি নিজের ব্যাক্ত্বিত্বের প্রভাব এবং রোজানেরিদের পুরোনো ঐতিহ্যেকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন,তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
৩৮ বছর বয়সী ইব্রাহিমোভিচের মিলানে ফেরত আসা নিয়ে যে যত কথাই বলুক না কেন,দলে তার অন্তর্ভুক্তি খেলোয়াড়দের জেতার মানসিকতাকে একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে,তা মাঠের খেলা দেখলে খুব সহজেই যে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন।সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এত এত তরুণের ভিড়ে তাদেরকে কঠিন সময়ে উজ্জীবিত করে তুলতে ইব্রা একজন নেতার মতো কাজ করেছেন-এমনকি ইনজুরির সময়ে ড্রেসিংরুমে থেকে হলেও।
লীগের শেষদিকে যখন মিলানের হাতে ভেরোনা,আটালান্টা এবং সাসুৌলো-তিনটি ম্যাচ বাকি,ভেরোনার সাথে ম্যাচ শুরু হওয়ার পূর্বে ইব্রা তার সতীর্থদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন-"মিলানের যেসব খেলোয়াড়েরা স্কুদেত্তো বা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে,সবাই শুধু তাদেরই মনে রেখেছে।যদি আমরাও তাদের মতো হতে চাই,তাহলে যেকোনো মূল্যে আমাদেরকে সামনের তিনটি ম্যাচ জিততে হবে।"
তারপরের ইতিহাস তো সবারই জানা।পিছিয়ে পড়েও ভেরোনাকে তাদের ঘরের মাঠে ৩-১ হারানো,সান সিরোতে আটালান্টার বিপক্ষে ২-০ এর সহজ জয়,সবশেষে সাসুৌলোকে ৩-০ তে হারিয়ে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্টার মিলানের কাছ থেকে ২ পয়েন্টের ব্যবধানে শিরোপার লড়াইয়ে বাজিমাত।ইব্রা ঠিকই ছিলেন;পৃথিবীর সব মানুষ না হোক,মিলান সমর্থকরা অন্তত পায়োলির খেলোয়াড়দের ভুলবে না।
ফুটবলবোদ্ধারা অনেকেই মনে করেন,বলোগনার কাছে ইন্টার মিলানের অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের কারণেই মিলানের স্কুদেত্তো জয়ের রাস্তাটা সহজ হয়ে গিয়েছিল।সে যুক্তি অবশ্য ধোপে টেকে না,তার কারণ হচ্ছে নেরাজ্জুরিদেরকে তার আগেই মিলান ডার্বিতে রোজানেরিরা ২-১ গোলের পরাজয়ের স্বাদ উপহার দেয়।সেই ম্যাচে ইন্টার প্রথমে ১-০ তে এগিয়ে ছিল,এমনকি প্রথমার্ধে বল পায়ে ইন্টারের ডমিনেন্স ছিল চোখে পড়ার মত।কিন্তু পাশার দান উল্টে যায় অলিভিয়ের জিরুদের ম্যাজিকে।মাত্র তিন মিনিটের ব্যবধানে দুটি গোল করে ডার্বির সাথে সাথে পুরো মৌসুমে সামনে আগানোর রসদটাও জুগিয়ে দেন তিনি।ম্যাচের ফলাফল ইন্টারের আত্মবিশ্বাসেও চিড় ধরিয়ে দিয়েছিল। ইন্টার মিলান কিংবদন্তি মার্কো মাতেরাজ্জিও ওই মুহূর্তের হারটাকেই সামনে তাদের পিছিয়ে পড়ার জন্য দায়ী করেছেন।
এসি মিলানের এই জয়যাত্রায় জিরুদকে মনে না করা তাই বড় রকমের অপরাধ হিসেবেই পরিগণিত হবে।
দীর্ঘ এগারো বছরের শিরোপা-খরা দূর হলেও তাদের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ।ক্লাবের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো সম্মানজনক আসরেও নিয়মিত হয়ে ওঠা-সবদিকেই তাদের ফিরে আসার বার্তাটা পৌছে দেয়ার প্রয়োজন।তবে মিলানের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে সিরি-এ এর সেরা খেলোয়াড় তাদের না থাকলেও,দল হিসেবে তারাই শ্রেষ্ঠ,কোচকেও হয়তো সিরি-এ সেরা বললে খুব একটা ভুল বলা হবেনা।
আপাতত,ইতালি-সেরার মুকুট যে তাদেরই কাছে!
- 0 মন্তব্য