• ফুটবল

একজন ফন্তেন ও একটি অবিশ্বাস্য কীর্তি

পোস্টটি ৮৫৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ফুটবল মাঠে ৯০ মিনিটে ২২ জন ফুটবলার নানারকম স্কিল প্রদর্শন করার মাধ্যমে আকৃষ্ট করে দর্শকদের। দিন শেষে ১১ জনের একদল জয়ী হয়, অন্য দল হয় পরাজিত। মাঝে মাঝে আবার কোনো দলই জয়-পরাজয়ের দেখা পায়না, অমীমাংসিত ভাবেই শেষ হয় ম্যাচ। আর এ জয়, পরাজয় বা ড্র, সবকিছুই নির্ধারিত হয় একটি জিনিসের মাধ্যমে। গোল।

মাঠে প্রতিটি দলেরই লক্ষ্য থাকে এই গোল। মাঠে যে দল যেমনই খেলুক, দিনশেষে হিসাব হয় শুধু এই গোল, কারা বেশি গোলের দেখা পেয়েছে, আর কারা কম। প্রতিটি দলের উদ্দেশ্যই থাকে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়ানো আর প্রতিপক্ষের গোল প্রতিহত করে নিজেদের গোলপোস্ট সুরক্ষিত রাখা। আর প্রত্যেক দলে গোল করার প্রধান দায়িত্বে যিনি থাকেন, তিনি আর কেউ নন, দলের আক্রমণ ভাগের মধ্যমণি, একজন স্ট্রাইকার।

ফুটবলে স্ট্রাইকারের কাজ টা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বেশ সহজ। স্ট্রাইকার ডিবক্সের মধ্যে বা আশেপাশে থাকবে, অন্যান্য খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে তার কাছে বল পাঠাবে, আর সে এক শটে বল টা জালে পাঠিয়ে দিবে। তবে বিষয়টা বলা যতটা সহজ, সবকিছু ঠিকঠাকমতো করা ঠিক ততটাই কঠিন। স্ট্রাইকারদের জাফুটবল মাঠে ৯০ মিনিটে ২২ জন ফুটবলার নানারকম স্কিল প্রদর্শন করার মাধ্যমে আকৃষ্ট করে দর্শকদের। দিন শেষে ১১ জনের একদল জয়ী হয়, অন্য দল হয় পরাজিত। মাঝে মাঝে আবার কোনো দলই জয়-পরাজয়ের দেখা পায়না, অমীমাংসিত ভাবেই শেষ হয় ম্যাচ। আর এ জয়, পরাজয় বা ড্র, সবকিছুই নির্ধারিত হয় একটি জিনিসের মাধ্যমে। গোল।

মাঠে প্রতিটি দলেরই লক্ষ্য থাকে এই গোল। মাঠে যে দল যেমনই খেলুক, দিনশেষে হিসাব হয় শুধু এই গোল, কারা বেশি গোলের দেখা পেয়েছে, আর কারা কম। প্রতিটি দলের উদ্দেশ্যই থাকে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়ানো আর প্রতিপক্ষের গোল প্রতিহত করে নিজেদের গোলপোস্ট সুরক্ষিত রাখা। আর প্রত্যেক দলে গোল করার প্রধান দায়িত্বে যিনি থাকেন, তিনি আর কেউ নন, দলের আক্রমণ ভাগের মধ্যমণি, একজন স্ট্রাইকার।

ফুটবলে স্ট্রাইকারের কাজ টা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বেশ সহজ। স্ট্রাইকার ডিবক্সের মধ্যে বা আশেপাশে থাকবে, অন্যান্য খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে তার কাছে বল পাঠাবে, আর সে এক শটে বল টা জালে পাঠিয়ে দিবে। তবে বিষয়টা বলা যতটা সহজ, সবকিছু ঠিকঠাকমতো করা ঠিক ততটাই কঠিন। স্ট্রাইকারদের জানতে হয় কখন কোথায় থাকতে হবে, কি করতে হবে, কিভাবে প্রতিটি সুযোগ কে কাজে লাগিয়ে গোল আদায় করে নিতে হবে। সেরা স্ট্রাইকার হয়ে উঠতে পারেন তারাই, যারা সবকিছু নির্ভুল ভাবে সম্পন্ন করতে পারেন। বক্সের মধ্যে তারা দক্ষ শিকারীর মতো, প্রতিটি সুযোগের তারা সর্বোচ্চ ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী কখনো স্ট্রং ফুট ব্যবহার করেন, কখনো ব্যবহার করেন উইক ফুট, কখনো বা বাতাসে ভেসে বল জালে জড়ান। কখনো সামনের দুই-তিনটা ডিফেন্ডার কে বোকা বানিয়ে বাঁকানো শটে লক্ষ্য সিদ্ধ করেন।

এসব কিছুতে যারা দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন, তারাই হতে পারেন বিশ্বমানের স্ট্রাইকার। গোল করাটাকে তারা বানিয়ে ফেলেন দুধভাত। প্রতিটি সুযোগ কে তারা রুপান্তরিত করেন গোলে। গড়েন একের পর এক রেকর্ড। নিজেকে নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়। এর মাঝে কিছু ক্ষণজন্মা স্ট্রাইকার এমন কিছু রেকর্ড গড়েন, যা শুধু অসাধারণই নয়, রীতিমতো অবিশ্বাস্য। রেকর্ড গড়া হয় ভাঙার জন্যই। তবে এসব রেকর্ড ভাঙার কল্পনা করাটাও নিছক দিবাস্বপ্ন বলে বোধ হয়। পরবর্তী প্রজন্মের ফুটবলার ও ফুটবল প্রেমী কোটি কোটি লোক বলতে বাধ্য হয়, এও কি সম্ভব!

image_search_1671823146782
আজ থেকে ৬৪ বছরের আগে এমনই অবিশ্বাস্য এক রেকর্ড গড়েন জাস্ত ফন্তেন, যা এখনো সবার ধরা ছোয়ার বাইরে, যে রেকর্ড ছোঁয়ার দ্বারপ্রান্তেও কেউ কখনো যেতে পারেননি। সেবারের বিশ্বকাপের এক আসরে এ ফ্রেঞ্চ স্ট্রাইকার গুনে গুনে ১৩ খানা গোল করেন! তার এ রেকর্ড ভাঙা তো দূরের কথা, সর্বশেষ ১২ টি বিশ্বকাপ আসরের মধ্যে ১০ টি তেই তার অর্ধেক গোলও কেউ করতে পারেনি।

ফন্তেন ছিলেন একজন জাত ফিনিশার। গোলপোস্টের সামনে তিনি ছিলেন সুপার স্মুথ। দু পায়েই ছিলেন সমান দক্ষ। তাঁর সাথে জার্মান কিংবদন্তি স্ট্রাইকার জার্ড মুলারের বেশ কিছু মিল লক্ষ্যণীয়। উচ্চতায় দুজনেই ছিলেন তুলনামূলক ভাবে বেঁটে, সেই সাথে বেশ শক্তসমর্থ। আর বক্সের মধ্যে পজিশনিং ও অফেন্সিভ অ্যাওয়ারনেসে দুজনই ছিলেন অতুলনীয়।

ফন্তেনের জন্ম ফ্রান্সের মাটিতে হয়নি। সেসময় আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ ছিলো ফ্রান্সের উপনিবেশ। তাদের মধ্যে একটি ছিলো মরোক্কো। সেই ফ্রান্স অধীনস্থ মরোক্কোতেই জন্মগ্রহণ করেন জাস্ত ফন্তেন। ফুটবলে আগ্রহ ছিলো ছোটবেলা থেকেই। সে আগ্রহ থেকেই জয়েন করেন স্থানীয় ফুটবল ক্লাব ইউএসএম কাসাব্লাঙ্কায়। পরবর্তীতে সেখান থেকে ফ্রেঞ্চ ক্লাব নিসে, ও নিস থেকে কিংবদন্তী রেমো কোপার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে ১৯৫৬ সালে যোগ দেন রেইসে। রেইসে যোগ দিয়ে নিজেকে নতুন করে চেনাতে শুরু করেন ফন্তেন। প্রথম সিজনেই বাজিমাত! লিগে ৩১ ম্যাচে গোল করেন ৩০ টি। পরের সিজনে আরও দুর্দান্ত। ২৬ ম্যাচ খেলে সেবার ৩৪ গোল করেন জাস্ত ফন্তেন। তার এ অবিশ্বাস্য পারফর্মেন্সে ভর করে সেবার লিগ শিরোপা জয় করে রেইস।

ফ্রান্সের হয়ে জাস্ত ফন্তেনের ডেব্যু হয় ১৯৫৩ সালে। ডেব্যু ম্যাচেই লুক্সেমবার্গের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ্র হ্যাট্রিক করেন ফন্তেন। তবে পরের তিন বছরে তিনি আর ফ্রান্স দলে ডাক পাননি। অবশ্য লুক্সেমবার্গের সাথে সে ম্যাচে প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্স মূল দল খেলেনি। অতি দূর্বল প্রতিপক্ষ লুক্সেমবার্গের বিপক্ষে ফ্রান্সের সে দলটি ছিলো রিজার্ভ দল, আর সে দলের সবারই সেটি ছিলো অভিষেক ম্যাচ। ফ্রান্স সে ম্যাচ জয়লাভ করে ৮-০ গোলে। ফলে সে ম্যাচের কারও পারফর্মেন্সই আমলে নেওয়ার মতো বিশেষ কিছু ছিলোনা।

তারপর দীর্ঘদিন আর ফ্রান্স স্কোয়াডে জায়গা মেলেনি তাঁর। অতঃপর ১৯৫৮ সালে রেইস কে প্রায় একা হাতে লিগ শিরোপা জেতানোর পর অবশ্যম্ভাবী ভাবেই আবারও ফ্রান্স দলে ফেরেন ফন্তেন। আর এবার কোনো বাছাইপর্ব নয়, সরাসরি বিশ্বকাপ। সুইডেনে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপ ১৯৫৮।

image_search_1671823166849
ফ্রান্স স্কোয়াডে তাকে মূলত ডাকা হয় রেনে ব্লিয়ার্দের ব্যাকআপ হিসেবে। দলের তৎকালীন দুই বিশ্বসেরা নাম্বার টেন রেমো কোপা ও রজার পিয়ান্তোনির সামনে নাম্বার নাইন হিসেবে খেলার কথা ছিলো ব্লিয়ার্দের। তবে বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগ-মুহুর্তে ওয়ার্মআপ ম্যাচে ইঞ্জুর্ড হয়ে পড়েন ব্লিয়ার্দ। বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে পড়েন তিনি৷ ফলাফল, স্টার্টিং লাইনআপে জায়গা পাকা হয়ে যায় ফন্তেনের।

অসাধারণভাবে বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয় ফন্তেনের। যে কোপার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে রেইসে যোগ দিয়েছিলেন, সে কোপার সাথে সেবারের বিশ্বকাপে তিনি গড়ে তোলেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা পার্টনারশিপ। জাতীয় দলে তাদের এ পার্টনারশিপ স্বল্পদৈর্ঘ্যের হলেও চিরকাল কিংবদন্তি হয়ে থাকবে।

সেবারের বিশ্বকাপে ছয় ম্যাচ খেলে সবকটিতে গোল করেন ফন্তেন। শুরুটা হয় প্যারাগুয়ের মাধ্যমে। তখনকার প্যারাগুয়ে দল ছিলো তুলনামূলকভাবে বেশ শক্তিশালী। তাদের বিপক্ষে ম্যাচটি সহজ ছিলোনা। মাঠেও সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় ভালোমতোই। ২০ মিনিটের মাথায় এগিয়ে যায় প্যারাগুয়ে। অতঃপর কোপার অসাধারণ পাস থেকে ২৪ ও ৩০ মিনিটে পরপর দুটি গোল করে ফ্রান্স কে এগিয়ে দেন ফন্তেন। তবে দমে যায়নি প্যারাগুয়ে। হাফ টাইমের ঠিক আগে ও পরে দুটি গোল করে আবারও লিড নেয় তারা। এর পরপরই পিয়ান্তোনির গোলে সমতায় ফেরে ফ্রান্স। তারপর উইস্নিয়েস্কির গোলে আবার লিড নেয় ফ্রান্স। অতঃপর ৬৭ মিনিটে বিশ্বকাপের নিজের অভিষেক ম্যাচেই হ্যাট্রিক পূর্ণ করেন জাস্ত ফন্তেন। পরবর্তীতে কোপা আর ভিন্সেন্তের গোলে ৭-৩ গোলের বিরাট জয় পায় ফ্রান্স।

পরের ম্যাচটি ছিলো পরাক্রমশালী যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে। ফ্রান্স সে ম্যাচে ৩-২ গোলে পরাজিত হয় ঠিকই, কিন্তু নিজের ফর্ম অব্যাহত রাখেন ফন্তেন। একদম শুরুতেই তাঁর গোলে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। তবে লিড ধরে রাখতে পারেনি। ২-১ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর ম্যাচে নিজের দ্বিতীয় গোল করে ফ্রান্সকে সমতায় ফেরান ফন্তেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৮৮ মিনিটে গোল হজম করে পরাজিত হয় ফ্রান্স। তবে ইতোমধ্যেই মাত্র দুই ম্যাচে ৫ গোল করে ফেলেছেন জাস্ত ফন্তেন। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে নিজে এক গোল করার পাশাপাশি কোপা কে দিয়ে করান আরও এক গোল।

কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ ছিলো নর্দান আয়ারল্যান্ড। সে ম্যাচে ফ্রান্স পুরো দলটির পারফর্মেন্সই ছিলো একদম নিখুঁত ও এলিট। নর্দান আয়ারল্যান্ডকে ৪-০ গোলে উড়িয়ে দেয় ফ্রান্স। জোড়া গোল করেন ফন্তেন। সে ম্যাচে ফ্রান্সের পারফর্মেন্স নিয়ে সুইডেনের এক জনপ্রিয় পত্রিকা তাদের কলামে লেখে, "সুইডেনের মাটিতে ফরাসিদের মতো এমন নয়নাভিরাম খেলার আরেকটি উদাহরণ খুঁজতে গেলে আপনাকে ইতিহাসে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।"

image_search_1671823140997
সেমি ফাইনালে সেবারের আসরের সবচেয়ে শক্তিশালী দল ও বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় কন্টেন্ডার ব্রাজিলের মুখোমুখি হয় ফ্রান্স। ব্রাজিলের সে দল ছিলো পেলে, গারিঞ্চা, নিলটন সান্তোস, দিদি, ভাভা, মারিও জাগালোর মতো অসংখ্য তারকা-মহাতারকায় পরিপূর্ণ। ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটেই ভাভার গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। তার সাত মিনিট পর অসাধারণ বিল্ড আপ থেকে দারুণ এক গোল করে ফ্রান্স কে সমতায় ফেরান ফন্তেন। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ফন্তেনের এ গোল সম্পর্কে বলা হয়, "এর চেয়ে সুন্দর গোল কেউ কখনো দেখেনি।"

৩৬ মিনিটের মাথায় ফ্রান্সের ওপর আসে সবচেয়ে বড় আঘাত। মারাত্মক এক ফাউল করে ফ্রান্স অধিনায়ক রবার জনকুয়ের পা ভেঙে দেন ভাভা। বদলি খেলোয়াড় নামার প্রথা সেসময় ছিলোনা। ফলে মাঠের এক পাশে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ম্যাচের বাকি সময় পার করেন জনকুয়ে। আর তাঁকে ছাড়া দশ জনের ফ্রান্স দল নিয়ে বাকি সময়টায় ছেলেখেলা করে ব্রাজিল। প্রথমার্ধে দিদি লিড এনে দেওয়ার পর দ্বিতীয়ার্ধে হ্যাট্রিক করেন পেলে। শেষদিকে পিয়ান্তোনির এক গোল শুধু একটু ব্যবধানই কমিয়েছে।

বিশ্বকাপ যাত্রা সেখানে শেষ হয়ে গেলেও আর একটা ম্যাচ তখনো বাকি। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ ছিলো অপর সেমি ফাইনালে স্বাগতিক সুইডেনের বিপক্ষে পরাজিত পশ্চিম জার্মানি। ফন্তেনের ঝুলিতে তখন জমা হয়েছে নয়টি গোল। বিশ্বকাপের এক আসরে তখন সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ছিলো ১১ টি, যেটি চার বছর আগেই গড়েছিলেন "দ্য ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্স" হাঙ্গেরি দলের অন্যতম প্রাণভোমরা সান্দোর ককসিস। ককসিচের রেকর্ড ভাঙার জন্য পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে তিনটি গোল প্রয়োজন ছিলো ফন্তেনের।

ফ্রান্স সেদিন ৬-৩ গোলে হারায় পশ্চিম জার্মানিকে। গুনে গুনে চারখানা গোল করেন জাস্ত ফন্তেন। ককসিচের ১১ গোলের রেকর্ড ভেঙে গড়েন এক বিশ্বকাপ আসরে ১৩ গোলের এক অবিশ্বাস্য রেকর্ড। তৃতীয় স্থান নির্ধারণীর সে অগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো শুধুমাত্র ফন্তেনের জন্য। ফন্তেন সেদিন নিজেকে নিয়ে যান অন্য এক উচ্চতায়, সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

তবে ফন্তেনের নামের পাশে ১৩ টি নয়, যুক্ত হতে পারতো আরও কিছু গোল। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে তার দুটি শট বারে লেগে ফিরে আসে। তাছাড়া পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে শেষ ম্যাচটিতে ফ্রান্স পেনাল্টি পেলে ফন্তেন তা মারেননি, মারতে দেন টিমমেট রেমন কোপা কে। এমনকি ফন্তেন যে বুট পড়ে সেবার খেলেছিলেন, সেগুলোও তাঁর নিজের ছিলোনা। তার এক সতীর্থের থেকে সেগুলো ধার নিয়েছিলেন ফন্তেন।

তখনও গোল্ডেন বুটের প্রচলন ফুটবলে হয়নি। এর ৪০ বছর পর এক টিভি প্রোগ্রামে গ্যারি লিনেকার ফন্তেনকে তাঁর কীর্তির স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে গোল্ডেন বুট প্রদান করে সম্মানিত করেন।

image_search_1671823287697
তবে ফন্তেনের ক্যারিয়ারের বাকি অংশটুকু গৌরবোজ্জ্বল ছিলোনা। সেবারের বিশ্বকাপের দু'বছর পর ১৯৬০ সালে দু'বার পা ভাঙে তাঁর। ফলস্বরূপ মাত্র ২৭ বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক ফুটবল কে বিদায় বলে দিতে বাধ্য হন। বিদায় বলার আগে ফ্রান্স দলের হয়ে মোটে মাত্র ২১ ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়েছিলো, তাতেই গোল করেন ৩০ টি। এর মধ্যে মাত্র ১০ টি কম্পিটিটিভ ম্যাচেই তাঁর গোল ২১ টি! তার আন্তর্জাতিক ম্যাচপ্রতি গোলের অনুপাত ১.৪৩, যা কমপক্ষে ৩০ গোল করা খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ। ক্লাব ক্যারিয়ারও আর আগায়নি। মাত্র ২৯ বছর বয়সে সব ধরণের ফুটবলকেই বিদায় জানিয়ে দেন। এরপর ফুটবলে ফিরে আসেন ম্যানেজার হিসেবে। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ফ্রান্স, মরোক্কো, পিএসজিসহ বেশ কিছু দলে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। অবশেষে ১৯৮১ সালে সে ক্যারিয়ারও ক্ষান্ত দেন।

বিরাট সমৃদ্ধ কোনো ক্যারিয়ার জাস্ত ফন্তেন পাননি। নিজেকে নিয়ে যেতে পারেননি সর্বকালের সেরাদের কাতারে। যদি ইঞ্জুরি আঘাত না হানতো, হয়তো নিজেকে নিয়ে যেতে পারতেন সে পর্যায়ে, হয়তো তিনি পরিগনিত হতেন সর্বকালের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে। তা হয়নি। ছেড়ে যেতে হয়েছে না চাইতেই। তবে এই ছোট্ট ক্যারিয়ারেই এমন এক কীর্তি তিনি গড়ে গেছেন, যা এখনো অবিশ্বাস্য, অস্পৃশ্য, অভেদ্য। তাই তাঁর ক্যারিয়ার টা কে ভুলে গেলেও তাঁর এ কীর্তির জন্য ফুটবল বিশ্ব তাঁকে চিরকাল মনে রাখবে, মনে রাখতে বাধ্য।