তীরহারা বাংলাদেশ বাস্কেটবল ফেডারেশন
পোস্টটি ১৪৭৯ বার পঠিত হয়েছেতীরহারা বাংলাদেশ বাস্কেটবল ফেডারেশন
ডাঃ গোলাম শওকত হোসেন (চিকিৎসক, শিক্ষক, গবেষক ও লেখক)
১৮৯১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাসাচুয়েটসে ডঃ জেমস নাইস্মিথ নামক ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টরেরে ব্রেন চাইল্ড হচ্ছে বাস্কেটবল খেলা, তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শীতকালে কিশোর ও তরুণদের শরীরকে একটিভ রাখা। তার ২ বছর পর অর্থাৎ ১৮৯৩ সালে ক্যানাডিয়ান টি ডানকান পাটনের মাধ্যমে এই খেলার আগমন ঘটে ব্রিটিশ অধ্যুষিত এই উপমহাদেশে, আর ১৯২৩ সালে ফাদার হেন্সির হাত ধরে আমাদের এই বাংলায় এই খেলার পত্তন হয় সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলে। অর্থাৎ জন্মের মাত্র ৩২ বছর পর প্রায় ৮,০০০ মাইল দূর থেকে এসে। এ দেশের মাটিতে বাস্কেটবলের প্রচলনের বয়স ১০০ বছর বললে ভুল হবে না। ভারতে বাস্কেটবল ফেডারেশন গঠিত হয় ১৯৫০ সালে আর স্বাধীন বাংলাদেশে বাস্কেটবল ফেডারেশন গঠিত হয় ১৯৭২ সালে। কিন্তু ৫১ বছরেও বাংলাদেশ বাস্কেটবল ফেডারেশনের নিজস্ব কোন স্থায়ী কোন অবকাঠামো নেই। প্রথমে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে বড় এক রুমকে পার্টিশন দিয়ে ফেডারেশন আর পরবর্তীতে ঢাকা ওডারার্স ক্লাব ও তার বাস্কেটবল কোর্ট মিলিয়ে উডেন ফ্লোর বাস্কেটবল কোর্ট আশির দশকের প্রথমে। তার পর অনেকটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাহীনভাবে ধানমণ্ডিস্থ আবাহনী ক্লাবের মাঠের একপাশে সরু রাস্তার পাশে কোন প্রকার পার্কিং বা এনট্রেন্স পরচ বা এনট্রেন্স কানোপি ছাড়া এন এস সি তৈরি করে দিলো বাংলাদেশ বাস্কেটবল ফেডারেশন উডেন ফ্লোরসহ; আর ফেডারেশনের কর্মকর্তারা কোন সোয়াট এনালাইসিস ছাড়া ধানমণ্ডির মতো পোশ জায়গায় স্থাননান্তরিত হোল। আজকে যখন বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সের কাজ শুরু হওয়া মাত্র বাস্কেট ক্রীড়া কমপ্লেক্সকে ডিমলিশ করা হোল, কোন কনক্রিট অলটারনেটিভ ছাড়া।
মিশনারী স্কুল ও কলেজগুলোতে কোর্ট আছে (খেলা শেখার শুরুতে উডেন বা সিমেন্ট-কোন পার্থক্য যায় আশে না) এবং নিয়মিত বাস্কেটবল খেলার চর্চা হয়। কিন্তু ১৮ কোটি মানুষের দেশে এই বাস্কেটবলকে কজনা চিনে বা জানে- যেখানে বাস্কেটবল ফেডারেশনেরই কোন অস্থিত্ত নাই। মাত্র ২৬ বছরে মিরপুর মাওলানা ভাসানি স্টেডিয়ামকে ক্রিকেট জগতের সারা বিশ্ব চিনে-জানে। রোলার স্কেটিং-এর জন্ম কত দিন এ দেশে-তার অবকাঠামোকে একটু দয়া করে দেখুন। আমার বাক্তিগত ধারণা মিশনারি বিদ্যানিকেতনগুলোর যেখানে বাস্কেট বলের চর্চা হয় তাদের বাংলিশ মন-মানসিকতা সম্পন্ন মানসিকতা, এ দেশের মাটি ও মানুষের সাথে খাপখাইয়ে নিতে পারার অপ্রতুলতা এর জন্য কিছুটা হোলেও দায়ি। কারণ এ দেশে মিশনারি বিদ্যানিকেতনগুলো ছাড়াও বহু কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলগুলোতে স্বাধীনতার আগে ও পরে (সিমেন্ট) বাস্কেটবল কোর্ট স্থাপন করা হয়েছিলো যেগুলোর আয়তন গড়ে প্রায় ৫০০ স্কয়ার মিটারের কাছাকাছি। কিন্তু তার ৫০% ই আজ ব্যাবহারের অযোগ্য-বল, আগ্রহী খেলোয়াড়, পরিচর্যা বা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। আমাদের দেশে গড়ে একটি বাস্কেট বলের দাম ৭-১০ হাজার টাকা (যার পরিধি সাড়ে ২৫ থেকে সাড়ে ২৯ ইঞ্চি হয়), নেটসহ দুইটি রিং-এর দাম ৬-৮ হাজার টাকা আর দুইটি উইসেলের দাম হয়তো ১ হাজার টাকা, যা দিয়ে অনায়াসে দৈনিক অন্তত ২ ঘণ্টায় করে ২৪ জন কিশোর বা তরুণ তাদের শারীরিক কসরত, ব্যায়াম, দৌড়-ঝাপ তথা বাস্কেট খেলার মাধ্যমে ফিজিক্যাল ফিটনেস বজায় রেখে কোয়ালিটি টাইম কাটাতে পারবে; যা দেখে বোখে যাওয়া বা নেশাগ্রস্থ কিশোর বা তরুণরা আলোর দিশা খুঁজে পাবে। অথচ একটি ভালো ক্রিকেট ব্যাটের মূল্য প্রায় ৩০,০০০- ৫০,০০০ হাজার টাকা । মেডিক্যাল সায়েন্সের প্রেক্ষাপটে দৈনিক মাত্র আধঘণ্টা বাস্কেটবল খেললে প্রাথমিকভাবে কিশোর বা তরুণদের- ১) কার্ডডিও ভাস্কুলার শক্তি বৃদ্ধি পায়, ২) ক্যালরি বার্ন হয়, ৩) হাড়ের সামর্থ্য বাড়ে , ৪) মাংসপেশির শক্তি বাড়ে, ৫) রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ৬) বডি বালেঞ্ছ ও কোরডিনেসন বাড়ে, ৭) আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়, 8) নিয়মানুবর্তিতা শেখা যায়, ৯) মানসিক বিকাশে সাহায্য করে, ৯) স্বাস্থ্য সচেনতা বাড়ে, ১০) রাতে নিরবিচ্ছিন প্রশান্তির ঘুম হয়, ১১) স্ট্রেস / ডিপ্রেশন কমাতে সাহায্য করে, ১২) কমুইনিকেসন স্কিল বাড়ায়, ১৩) দলগতভাবে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করতে সাহায্য করে, ১৪) শরীরের এজিলিটি, ফ্লেক্সিবিলিটি ও মবিলিটি বাড়ে ইত্যাদি । সর্বোপরি সারাদেশে বাস্কেটবল ফেডারেশনের মাধ্যমে বাস্কেটবলকে পপুলার করা গেলে যথাসাধ্য স্বল্প খরচে আমাদের কিশোর বা তরুণর সমাজকে মোবাইল ফোন ও ড্রাগ এডিকসন থেকে বিরত রেখে সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কিছু অংশকে হোলেও আলোর পথে আনা যাবে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ বাস্কেটবল ফেডারেশন ও বাংলাদেশ স্পোর্টস মেডিসন এসোসিয়েশনের সভাপতির আসনে বেশিরভাগ সময় ছিলেন আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেও অসাধারণগুণী বাক্তি বাংলাদেশে নিউরোসার্জারি সায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা, ১৯৫৬ সালে ইষ্টপাকিস্থান টিমের বাস্কেটবল ক্যাপ্টেন ও ভালো টেনিস প্লেয়ার প্রফেসর ডাঃ রশিদ উদ্দিন স্যার। বস্তুত তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ও প্রফেসানালী অত্যন্ত ব্যাস্ত মানুষ। উনি আর যাই হোক এই দুটি সংগঠনের জন্য তিনি সময় দিতে পারেননি। ফলে এই দুটি সংগঠনের অগ্রগতি এ দেশে অত্যন্ত কচ্ছপ গতি তুল্য অন্যান্য স্পোর্টসের তুলনায়। আমি ১৯৯২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এ গুলোকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। কারণ আমি আমার পার্মানেন্ট ডাক্তারি পেশা ছাড়াও; পার্টটাইম ডাক্তার ছিলাম ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিল (এনসি) ও মোহাম্মাদপুর ফিজিক্যাল কলেজে (সংগে স্পোর্টস ফিজিওলজির এডজ্জাকট-ফ্যাকাল্টি, এক্সজামিনার এবং প্রশ্নপত্রের-মোডারেট-যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালইয়ের অন্তর্ভুক্ত), বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ও বাংলাদেশ ওলিম্পিক এসোসিয়েশনের অনারারী ডাক্তার, আর তা ছাড়াও ২০০০ সাল পর্যন্ত ২৭ টি ফেডারেশনে পদাধিকার বলে স্বাস্থ্য-উপদেষ্টা।
বাংলাদেশ বাস্কেটবল ফেডারেশন ও বাংলাদেশ স্পোর্টস মেডিসন এসোসিয়েশন- এই দুটি সংগঠনের বর্তমান অবস্থা বি-এস-যে-এ (বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নাললিস্ট এসোসিয়েশন) এবং বাংলাদেশ স্পোর্টস রাইটার্স এসোসিয়েশনসহ সকলেই তা জানে। অথচ এদেশেই একদিন ব্রাদার নিকোলাসের মতন নিবেদিত প্রাণের হাত দিয়ে তৈরি হয়েছিলো কাজী কামাল (মুক্তিযোদ্ধা) , ইউসুফ বাবু, সেংকা, ভায়া, আকা নেওয়াজ, বাবলা, তালিবুর, এমি ইত্যাদির মতন নামকরা বাস্কেটবল খেলোয়াড়। কিন্তু সেই অবসরপ্রাপ্ত খেলোয়াড়দের সাংগঠনিক দুর্বলা ও অদূরদর্শিতার অভাবে আজ বাংলাদেশ বাস্কেটবল ফেডারেশন অবকাঠামো বিহীন।
বর্তমান বিশ্বে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গত ৫১ বছরে স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট বা স্পোর্টস অর্গানাইজিং ক্যাপাবিলিটির উপর দৃষ্টি দেইনি আমরা কখনোই। স্বাধীনতা পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন জনাব জাকারিয়া পিনটুকে এ-এস-সির উচ্চপদে বসানো হয়েছিলো-কিন্তু তিনি সাফল্য দেখাতে পারেননি। বর্তমানে সেই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ভাইস-ক্যাপ্টেন জনাব সালাউদ্দিনের সাফল্য সমন্ধে আমরা অবগত।
তবে খেলোয়াড় ও অর্গানাইজার হিসাবে শুধু মাত্র ষাট ও সত্তর দশকের একমাত্র সফল ক্রিকেটার সৈয়দ আশরাফুল হক সাফল্য অর্জন করেছিলেন। অর্গানাইজার হিসাবে তাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের আই সি সি টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জনের রূপকারও বলা হয়। পরবর্তীতে তিনি এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সিইও হয়েছিলেন। আর অন্য জন ছিলেন হকি ফেডারেশনের জনাব বারী , যিনি উদয় প্রেক্ষাপটে অবদান রাখেন।
সুতরাং এখন সময় এসেছে বর্তমান আধুনিক উন্নত বিশ্বের স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টের কারিকুলাম অনুযায়ী খেলাধুলা ও পড়াশুনায় ভালো এমন যুবক / যুবতীদের অন্তত ব্যাচেলর ডিগ্রি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় করিয়ে নিয়ে আসা, শুধু দানের স্কলারশিপের উপর নির্ভর না করা। আর সেই কারিকুলামের প্রধান বিষয়বস্তুগুলো হচ্ছে- ফাইন্নাস, কমুইনিকেসন, স্পোর্টস ল, স্পোর্টস হিসট্রি, স্পোর্টস মার্কেটিং, স্পোর্টস ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, স্পোর্টস ফাসিলিটি ম্যানেজমেন্ট, স্পোর্টস ইথিকাল ইসুজ, স্পোর্টস লিগ্যাল ইসুজ ইত্যাদি। কিন্তু আমরা ফেডারেশন বানানোর সময় বেশি খুঁজি এক্স প্রেয়ার, বড় আমলা, বড় বিজনেস ম্যান, রাজনৈতিক বাক্তি, ক্ষমতাধর বাক্তি ইত্যাদিদেরকে যারা অত্যন্ত বাস্ত। সরকার পালটালে তারাও পালটান-সেটা যেন রাজনীতির আর এক পিঠ। আজ যার ফলশ্রুতিতে ফুটবল মাঠে হাহাকার, ক্রিকেটে পাইপ লাইনে প্লেয়ারের অভাব, নদীমাতৃক দেশে সাতারু নাই, বাস্কেট ফেডারেশনের অবকাঠামো নাই, স্পোর্টস মেডিসিন এ্যাসোসিয়েশন কাগজে কলমে আর স্পোর্টস-রিসার্চের কোন গন্ধ নেই। বাস্কেট বল ও ক্রিকেটে বহু ব্রিলিয়ানট ছেলে ছিল-কিন্তু আমাদের ক্রীড়াগনের পরিবেশের কারণে খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করার পর এই অঙ্গনে আর ফিরে আসতে চায় না তারা। তবে স্পোর্টসকে কেন্দ্র করে বিদেশ ট্যুরের অভাব নেই।
বাংলাদেশ বাস্কেট ফেডারেশনের স্থায়ী অবকাঠামো একান্ত দরকার, তার জন্য ইনিশিয়াল কোস্ট ও কষ্ট হবে। কিন্তু প্রফেশনাল, বাস্কেটবল সম্পর্কে হাতে কলমে জানে ও স্পোর্টস-ম্যানেজমেন্টে শিক্ষিত নিবেদিত প্রাণ সম্পন্ন অর্গানাইজারদের হাতে পড়লে এ দেশের কিশোর / কিশোরী ও যুবক /যুবতীরা মানসিক, শারীরিক, চারিত্রিক বা সামাজিকভাবে উপকৃত হবে কারণ এর রেগুলার ওভার কোস্ট অনেক স্পোর্টসের তুলনায় কম। অনেকে হয়তোবা এনবিএ-এর সাথে আমাদের তুলনা করতে চাইবে, কিন্তু সেটা হবে বোকার পুকুরে সাঁতার কাটার মতো। আগে দরকার এই খেলাকে ছড়িয়ে দেওয়া (ডিসেমিনেসন), প্রচুর পার্টিসিপেসন, নিয়মিত অনুশীলন, প্রতিযোগিতার আয়োজন, কোয়ালিটি হান্টিং, বড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন এবং সাফল্য অর্জন; তবে এসবই মডার্ন স্পোর্টস সায়েন্সের দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে এগুতে হবে। আবারও আমাদের আর একজন ডাক্তার বড় ভাই, যিনি একজন বাস্ত রাজনীতিবিদও বটে, তাকে বাংলাদেশ বাস্কেট ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে- সৃষ্টিকর্তার কাছে তার জন্য দোয়া ও শুভকামনা রইল।
- 0 মন্তব্য