আবেগ বিহীন ফুটবলের যুগে এক আবেগী চরিত্র | পর্ব : ১
পোস্টটি ৭৪০ বার পঠিত হয়েছেপথটা শুরু থেকেই ছিলো কথা কণ্টকাকীর্ণ, সহজ বলে কিছু ছিলোনা। তারপরও সে এটাই বেছে নিয়েছিলো, কারণ সে জানতো সে পারবে। তার জন্মই হয়েছিলো অসাধ্য কে সাধন করার জন্য, সব বাধা ডিঙিয়ে নিজেকে বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করার জন্য। তাকে আটকাবে কার সাধ্য?
একদম শূন্য থেকে সূচনা, যেখান থেকে উত্তরণ ছিলো অসম্ভব, সেই অসম্ভব কে সম্ভব করে শূন্য থেকে শীর্ষে যাত্রা, হয়তো সম্ভব হয়েছিলো সেজন্যই। যখন চারিদিকে মানুষ হয়ে পড়ছে যন্ত্রের মতো, যখন লাক্সারি আর খ্যাতির উদ্দাম নেশায় ছুটে চলেছে সবাই, তখন সে এক পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বাঁচতে চেয়েছে। নিজের আবেগ ও ভালোবাসাকে লালন করেছে, নিজের মনের সাথে কখনো প্রতারণা করেনি, অর্থের ঝংকারে বিসর্জন দেয়নি নিজের মানবীয় সত্ত্বা গুলোকে। এত লাক্সারির ভীড়েও জিইয়ে রেখেছে নিজেকে, একজন প্রকৃত মানুষকে।
আফ্রিকার উত্তর-পূর্বে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন বিরাট এক দ্বীপ রাষ্ট্র মাদাগাস্কার। সেখান থেকে আরও বেশ খানিকটা ভারত মহাসাগরের বুকে মাত্র ৯৭০ বর্গমাইলের ছোট্ট এক দ্বীপ। রিউনিয়ন। স্বাধীন নয়। ফ্রান্সের একটা টেরিটোরি মাত্র। ১৯৮৭ সালে সেখানকারই এক ছোট্ট শহর সেইন্ট পিয়েরে তে জন্মগ্রহণ করেন দিমিত্রি পায়েত। ফুটবল নিয়ে প্যাশন ছিলো ছোটবেলা থেকেই, হাতে খড়ি হয় স্থানীয় এক ক্লাব সেইন্ট ফিলিপে। সেখানে শুরু থেকেই অন্যদের থেকে একটু আলাদা ছিলেন পায়েত, যেটা কোচদেরও নজর এড়ায়নি।
সেখানে তিন বছর কাটিয়ে যোগ দেন শহরের সবচেয়ে বড় ক্লাব সেইন্ট পিয়েরোয়াতে। তবে সেইন্ট পিয়েরোয়া তে তাঁর সময়টা ছিলো কম। ট্যালেন্টেড পায়েত অতি দ্রুতই নজর কাড়েন সবার। আর এতে তার জন্য এবার বেশ বড় একটা সুযোগ আসে। ফ্রান্সের বেশ প্রভাবশালী দল লে হাভরের সাথে পার্টনারশিপ ছিলো সেইন্ট পিয়েরোয়ার। তাই এবার তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেখানে। ছোট্ট শান্ত রিউনিয়ন ছেড়ে ৬০০০ মাইল দূরে লাক্সারিয়াস মেট্রোপলিটন ফ্রান্সে পা রাখেন দিমিত্রি পায়েত।
তবে কিশোর বয়সেই একদম নতুন এ পরিবেশে এসে একদমই খাপ খাওয়াতে পারেননি পায়েত। নতুন শহরের একদম ভিন্ন ধাঁচের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি তিনি গ্রহণ করতে পারেননি ঠিকমতো। কিশোর বয়সের প্রাণচাঞ্চল্য, অস্থির মনোভাব, উগ্রতা ও ক্ষিপ্রতা কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। একাডেমিতে তার বিরুদ্ধে আসে বেশ কিছু ছোটখাটো অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত লে হাভর বাধ্য হয়ে তাকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেয় রিউনিয়নে।
স্বদেশে ফিরে কিছুদিন পর যোগ দেন এক্সেলসিওরে। রিউনিয়নের সবচেয়ে বড় ক্লাব ছিল এক্সেলসিওর। এখানে নিজেকে চেনাতে দেরী করেননি তিনি। প্রায় দেড় বছর এক্সেলসিওরে কাটানোর পর আবারও ডাক আসে ফ্রান্স থেকে। এবার তাঁর দিকে নজর দেয় পশ্চিম ফ্রান্সের অন্যতম শীর্ষ দল নঁতে। ফ্রান্সের বুকে নিজেকে প্রমাণ করার আবারও এক সুযোগ পান পায়েত।
শুরুতে নঁতের রিজার্ভ টিমের হয়ে খেলা শুরু করেন পায়েত। সেখানে ২০০৫-০৬ সিজনে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন। রিজার্ভ টিমের কোচ স্তেফান মরু তার ব্যাপারে বলেন, "দিমিত্রি বেশ উদাসীন প্রকৃতির হলেও তার মধ্যে অবিশ্বাস্য প্রতিভা ছিলো। সে তার সতীর্থদের মাঠে নিজেদের সেরা টা দেওয়ায় উদ্বুদ্ধ করতে পারতো এবং প্রতিপক্ষ কে বিধ্বস্ত করে ফেলতো।"
ধারাবাহিক পারফর্মেন্স এর পুরষ্কার পেতে দেরি হয়নি। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে ডাক পান নঁতে সিনিয়র টিমে। অতঃপর ১৯ ডিসেম্বর বোর্দোর বিপক্ষে লিগ ম্যাচে বদলি হিসেবে অভিষিক্ত হন দিমিত্রি পায়েত। উইন্টার ব্রেকের পর মেৎসের বিপক্ষে ম্যাচে বদলি হিসেবে নামার মাত্র দুই মিনিট পর প্রফেশনাল ক্যারিয়ারের গোলের খাতাও খুলে ফেলেন। তবে ফেব্রুয়ারিতে দলের মূল খেলোয়াড় সবাই ইঞ্জুরি থেকে ফিরলে আবারও রিজার্ভ টিমে ফিরে যান পায়েত।
২০০৬-০৭ সিজনের শুরুতে নঁতের সাথে নতুন করে তিন বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেন দিমিত্রি পায়েত। সেই সাথে সিজনের শুরুতেই অফিসিয়ালি মূল দলে প্রোমোশন পেয়ে যান। ২০০৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর লিলের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো প্রোফেশনাল ম্যাচে স্টার্টার হিসেবে অভিষিক্ত হন। সে ম্যাচে তাঁর সমতাসূচক গোলে ১-১ গোলে ড্র করে নঁতে। দুই সপ্তাহ পর মার্সেই এর বিপক্ষেও প্রথম গোল আসে তাঁর পা থেকে। ধারাবাহিক পারফর্মেন্স বজায় রেখে অল্প দিনেই দলের প্রথম একাদশে জায়গা পাকাপোক্ত করে নেন পায়েত।
পায়েত দারুণ সিজন কাটালেও নঁতে খুব বাজে সিজন কাটায়। ফলাফল, ১৯ তম হয়ে সিজন শেষে লিগ টু তে রেলিগেটেড হয়ে যায় তারা। তবে তরুণ প্রতিভাবান পায়েতের দিকে বেশ কয়েকটি দল নজর দিয়েছিলো। তাই রেলিগেশনের পর আর তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি নঁতে। দিমিত্রি পায়েত যোগ দেন ফ্রান্সের অন্যতম সফল ও ঐতিহাসিক দল সেইন্ট এতিয়েনে।
শুরুর দিকে সেইন্টদের মূল দলে জায়গা করে নিতে তাঁকে অবশ্য বেশ বেগ পেতে হয়। সিজনের দ্বিতীয়ার্ধে স্টার্টার হয়ে ওঠেন, তবে সেবারের সিজন তাঁর জন্য একদমই ভালো কাটেনি। সেবার পুরো সিজনে কোনো গোল এসিস্টের দেখা পাননি। তবে দলীয় পারফর্মেন্স ছিলো বেশ ভালো। লিগে পঞ্চম হয়ে ইউয়েফা কাপে কোয়ালিফাই করে সেইন্টরা।
পরের সিজনে আবার আস্তে আস্তে নিজেকে ফিরে পেতে শুরু করেন পায়েত। সেবার ৩০ ম্যাচে ৪ গোল ও ৬ এসিস্টের দেখা পান। সে সিজনে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান আসরে খেলার সুযোগ হয় তাঁর। সেখানে তার পারফর্মেন্স ছিলো চোখে লেগে থাকার মতো। দলের ক্রুসিয়াল সময় গুলোতে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকেন পায়েত। গোল এসিস্ট তো নিয়মিতই আসছিলো, পাশাপাশি গোল কন্ট্রিবিউশান ছাড়াও দলের খেলায় তার বিশেষ ভূমিকা ছিলো।
এর কিছুদিন পর এক ছোট ঘটনার জোর ধরে টিমমেট ব্লেজ মাতুয়াদির সাথে মাঠের মধ্যে ঝামেলায় জড়ান পায়েত। ফলাফল স্বরূপ দল থেকে সাময়িক ভাবে নিষিদ্ধ হন পায়েত। পরবর্তীতে পায়েত ও মাতুয়াদি দুজনই এ ঘটনার কারণ হিসেবে দুজনের ম্যাচিউরিটির অভাব কে দায়ী করেন। কাকতালীয় ভাবে এ ঘটনার কদিন পরেই পায়েত ও মাতুয়াদি দুজনই প্রথমবারের মতো ফ্রান্স জাতীয় দলে ডাক পান।
পরের সিজনটা দারুণ কাটান দিমিত্রি পায়েত। ২০১০ সালের আগস্টে ক্যারিয়ারে প্রথম হ্যাট্রিক করেন। পরের মাসে সেইন্ট এতিয়েনের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অলিম্পিক লিওঁর বিপক্ষে রোন আল্পস ডার্বি তে ফ্রি কিক থেকে চোখ ধাঁধানো এক গোল করেন। সেপ্টেম্বরে লিগের প্লেয়ার অব দ্য মান্থ নির্বাচিত হন পায়েত। সেবার ১৩ গোল করে সেইন্টদের টপ স্কোরার হিসেবে সিজন শেষ করেন পায়েত।
সামার উইন্ডোতে মোটামুটি বিগ ফিস হয়ে পড়েন পায়েত। তাঁকে পেতে আগ্রহী ছিলো অসংখ্য ক্লাব। তবে সবাইকে ফেলে ৯ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফি তে লিগ ওয়ানের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন লিলে যোগ দেন পায়েত।
বড় বড় সব জায়ান্ট দের রাডারে থাকা এডেন হ্যাজার্ডের ভালো একটা রিপ্লেসমেন্ট দরকার ছিলো লিলের, যার মধ্যে থাকবে বিশ্বমানের ক্রিয়েটিভিটি। আর এসময় পায়েতের মধ্যেই পার্ফেক্ট প্রোফাইল খুঁজে পান কোচ রুডি গার্সিয়া। তবে পায়েত কে তিনি গোল করার চেয়ে করানোর দিকে আরও মনোযোগী হতে বলেন। গুরুর কথা ভালোমতোই পালন করেন পায়েত। প্রথম সিজনেই ম্যাচপ্রতি হ্যাজার্ডের চেয়ে বেশি গোলের সুযোগ তৈরি হয় তাঁর পা থেকে।
পরের সিজনে হ্যাজার্ড লিল ছাড়লে দলের মেইনম্যান হয়ে পড়েন পায়েত। সেই সাথে প্রথমবারের মতো কোনো ক্লাবের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে তার ওপর আসে বাড়তি দায়িত্ব। তবে প্রস্তুত ছিলেন পায়েত। লিল কে বেশ ভালোভাবেই টানতে শুরু করেন। সে সিজনে যৌথভাবে লিগের সর্বোচ্চ এসিস্ট প্রোভাইডার হন পায়েত। ১২ গোল ও ১২ এসিস্টে ইউরোপের অন্যতম সেরা ইয়ংস্টার বনে যান পায়েত। থ্রো বলে ছিলেন অসাধারণ। তার প্রায় প্রতিটি পাস একটি করে গোলের সুযোগ তৈরি করে দিতো।
পায়েত বুঝলেন এবার তার আরেকটু ওপরের দিকে যাওয়ার সময় এসেছে। তবে তিনি ফ্রান্স ছাড়তে চাননি। তিনি চাচ্ছিলেন একটি কোয়ালিটি সম্পন্ন গ্রুপ, পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগের বড় মঞ্চে খেলার সুযোগ। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় ফ্রান্সের সফলতম দল অলিম্পিক ডি মার্সেই তে যোগ দেন পায়েত।
মার্সেই তে সূচনা টা হয় দারুণভাবে। গেঁগার বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচেই করেন জোড়া গোল। ফ্রান্সের ফুটবলের শহরের জাদুকরী স্পর্শে ক্রমেই আরও ক্ষুরধার হয়ে ওঠেন পায়েত। লিওনেল মেসি ছাড়া তার চেয়ে বেশি সফল থ্রো পাস সেবার ইউরোপে কেউ দিতে পারেনি। ৩৬ ম্যাচে ১৭ টি এসিস্ট করেন পায়েত। এর পেছনে অন্যতম কৃতিত্ব অবশ্য ছিলো তৎকালীন মার্সেই কোচ মার্সেলো বিয়েলসার। তাঁর ব্যাপারে পায়েত বলেন, "তিনি আমায় আরও পরিপক্ব ও ধারাবাহিক করে তোলেন। তাঁর উপদেশ গুলো এখনো সবসময় আমার মাথায় থাকে।"
বিয়েলসার সহকারী কোচ ইয়ান ফন উইঙ্কেল বলেন, "মার্সেলো প্রথম বুঝতে পারেন পায়েত একজন প্লেমেকার, উইঙ্গার নয়। বল পায়ে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার পাশাপাশি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় সম্ভবত দিমিত্রি। টেকনিক্যালি সে অবিশ্বাস্য প্রতিভাধর এবং তার পা থেকে বল কেড়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।"
মার্সেই তে সবকিছুই বেশ ভালোই চলছিলো। নিজের সেরা ফেজের দিকে ক্রমেই অগ্রসর হচ্ছিলেন পায়েত। ঠিক এইসময় আসে বেশ বড় আঘাত। বিরাট এক অর্থনৈতিক ক্রাইসিসে পড়ে অলিম্পিক ডি মার্সেই। কিছুদিন আগে দলের প্রধান মালিকের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীর হাতে যায় ক্লাবের মালিকানা, যিনি ছিলেন ক্লাব ব্যাপারে নিরাসক্ত ও উদাসীন। এর মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয় মার্সেই। আর সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়।
বিরাট সে সঙ্কটে দলের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব খেলোয়াড় কে ছেড়ে দিতে হয়। টপ স্কোরার আন্দ্রে পিয়েরে জিনিয়াক পাড়ি দেন মেক্সিকোয়, যোগ দেন ইউএএনএল টাইগ্রিসে। পায়েতের জন্য বিরাট অফার নিয়ে হাজির হয় লন্ডনের ক্লাব ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড, যা সে অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া ছিলো অসম্ভব। অতঃপর ২০১৫ সালের জুনে অলিম্পিয়ান শিবির কে বিদায় বলে লন্ডনে পাড়ি জমান পায়েত।
যদিও প্রিমিয়ার লিগের অন্যান্য বড় বড় দল রেখে হ্যামার্স শিবিরে যাওয়াটা বেশ অদ্ভুত দেখাচ্ছিলো শুরুতে, তবে ওয়েস্ট হ্যামে পায়েতের স্পেল টা ছিলো অল্প কথায় অতিমানবীয়। ওয়েস্ট হ্যাম দল টি তখন প্রিমিয়ার লিগে মিড টেবিলে লড়াই করছিলো। তবে পায়েতের যা দরকার ছিলো তা তিনি সেখানে পেয়েছিলেন, একটি উচ্চাশী স্পোর্টিং প্রোজেক্ট ও একজন ম্যানেজার, যিনি তাঁর ভেতর থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারবেন।
ওয়েস্ট হ্যামে পায়েত হয়ে ওঠেন একদম অপ্রতিরোধ্য। স্পেল টা খুব লম্বা ছিলোনা, ১৮ মাস লন্ডন কাটান দিমিত্রি পায়েত। তবে এর মধ্যেই কেড়ে নেন প্রিমিয়ার লিগের সবকটি স্পটলাইট। অচেনা পায়েত ওয়েস্ট হ্যামের ক্ল্যারেট অ্যান্ড ব্লু তে পরিচিত হয়ে ওঠেন বিশ্বব্যাপী। অবিশ্বাস্য সব ফ্রি কিক, দুর্দান্ত সব কি পাস, নিরবিচ্ছিন্ন প্লেমেকিং... সব মিলিয়ে প্রায় একা হাতে ওয়েস্ট হ্যামের নিশান উড়িয়ে যাচ্ছিলেন প্রিমিয়ার লিগের মহামঞ্চে।
উড়তে থাকা পায়েতের ফ্রান্স জাতীয় দলে আবার ডাক আসে অবধারিতভাবেই। নিজেদের মাটিতে ইউরো ২০১৬ আসরে দেশমের দলে জায়গা পেয়ে যান পায়েত। আর সেবারের আসরে নিজের সবচেয়ে সেরা ফর্ম টা প্রদর্শন করেন পায়েত। টুর্নামেন্টের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করে গেছেন।
উদ্বোধনী ম্যাচে রোমানিয়ার বিপক্ষে একটি গোল ও একটি এসিস্ট আসে তাঁর পা থেকে। পাশাপাশি আটটি গোলের সুযোগ তৈরি করেন। নির্বাচিত হন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। দ্বিতীয় ম্যাচে আলবেনিয়ার বিপক্ষে ছয়টি গোলের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি ৯৬ মিনিটের মাথায় গোল করে দলকে জয় এনে দেন, এবং আবারও নির্বাচিত হন ম্যান অব দ্য ম্যাচ।
কোয়ার্টার ফাইনালে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচেও গোল ও এসিস্ট আসে তাঁর পা থেকে। ফাইনালে পর্তুগালের বিরুদ্ধে ম্যাচে তাঁর সাথে সংঘর্ষের পর মাঠ ছাড়েন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ফ্রান্স শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত সময়ে এডারের গোলে পরাজিত হলেও তর্কসাপেক্ষে সেবারের টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন দিমিত্রি পায়েত।
ইউরো শেষে আবারও রিয়াল মাদ্রিদ সহ ইউরোপের সব জায়ান্ট রা পায়েত কে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তবে ওয়েস্ট হ্যাম জানতো পায়েতই তাদের রক্ষাকর্তা। তাই কোনোভাবেই তাঁকে হারাতে চায়নি তারা। তাই সব অফার রিজেক্ট করে ওয়েস্ট হ্যামেই রেখে দেয় তাঁকে।
তবে সময় যত যেতে থাকলো, আস্তে আস্তে গৃহকাতর হয়ে উঠতে থাকেন দিমিত্রি পায়েত। লাক্সারিয়াস মেগা সিটি লন্ডনের জীবনে ক্রমেই বিরক্ত হয়ে ওঠেন। মার্সেই এর সহজ সরল সাদামাটা জীবন কে মিস করতে শুরু করেন প্রতিনিয়ত। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে আবারও মার্সেই ফেরার তীব্র বাসনা মনে জাগতে শুরু করে।
খেলার মধ্যেও এটির ইফেক্ট পড়ছিলো। পারফর্ম ঠিকমতো করলেও দিন দিন কেমন জানি নিরস নিস্প্রভ হয়ে উঠছিলেন পায়েত। ক্লাবের সাথে সম্পর্কটাও আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে আসছিলো। অতঃপর ২০১৭ সালের উইন্টারে কোচ স্লাভেন বিলিচ কে জানিয়ে দেন যে অতিসত্বর তিনি ক্লাব ছাড়তে চান। পাশাপাশি হ্যামার্সদের সাথে ট্রেইনিং এও অস্বীকৃতি জানান।
শুরুর দিকে পায়েত কে ছাড়ার কোনোরকম ইচ্ছাই ছিলোনা ওয়েস্ট হ্যামের। মার্সেই এর পরপর দুটি অফার রিজেক্ট করে দেয় তারা। বরং তারা পায়েত কে বলে তার আচরণের জন্য ফ্যানদের কাছে ক্ষমা চেয়ে পুনরায় পূর্ণ মনোযোগে খেলা শুরু করতে। কিন্তু পায়েত তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অনড়। অবশেষে ধারাবাহিক ভাবে এভাবে চাপ দেওয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত হ্যামার্স রা নেগোসিয়েশনে যেতে বাধ্য হয়।
অতঃপর ২০১৭ সালের জানুয়ারি তে মার্সেই এর নতুন আমেরিকান মালিক ফ্রাঙ্ক ম্যাককোর্ট এর "চ্যাম্পিয়নস ওএম" প্রজেক্ট এর অংশ হিসেবে প্যাট্রিস এভ্রা ও মরগান সাঁসোদের সাথে ফ্রেঞ্চ ক্লাব টির ইতিহাসের রেকর্ড ট্রান্সফার ফি তে আবারও মার্সেই ফিরে আসেন পায়েত। ওয়েস্ট হ্যামের ইতিহাসেও তৎকালীন রেকর্ড সেল ছিলো এটি।
পরবর্তীতে পায়েত বলেন, "আমি ফিরে আসতে চাচ্ছিলাম। আমি নতুন প্রজেক্টের অংশ হতে চাচ্ছিলাম। আমি ক্লাবের নতুন ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলেছিলাম এবং তারা আমায় আশ্বস্ত করেছিলো যে তারা এ ব্যাপারে সিরিয়াস। এবং সেইসময় টায় আমি লিগ ওয়ান ও ফ্রান্স কেও প্রচন্ড মিস করছিলাম।"
তবে পায়েতের জোরপূর্বক এ দলবদল একদমই ভালোভাবে নেয়নি ওয়েস্ট হ্যাম ফ্যান ও ক্লাব কর্তৃপক্ষ। হ্যামার্স ফ্যানরা যারা তাঁর জন্য দুদিন আগেও গলা ফাটিয়েছিলো, পায়েত ছিলো যাদের নয়নের মণি, তারা সবাই তাঁকে কে "সাপ" আখ্যা দেয়। ওদিকে ওয়েস্ট হ্যাম ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে লন্ডন স্টেডিয়ামে তাঁর একটি ম্যুরাল স্থাপন করেছিলো। তার মার্সেই ট্রান্সফার কমপ্লিট হওয়ার সাথে সাথেই সে ম্যুরাল সরিয়ে ফেলা হয় ও তার জায়গায় স্থাপন করা হয় ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে অ্যান্ডি ক্যারলের বাইসাইকেল কিকের ম্যুরাল।
তবে এভাবে এক প্রকার জোর করেই মার্সেই ফেরাটা কি তাঁর ক্যারিয়ারে আদৌ কোনো সুফল বয়ে এনেছিলো? ঘরে ফেরার গল্পটাই বা কেমন ছিলো?
আসছে পরের পর্বে…
- 0 মন্তব্য