বিশ্বকাপ ক্রিকেট এবং শচীন টেন্ডুলকার
পোস্টটি ১৪৫১ বার পঠিত হয়েছেসর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান কিংবা ক্রিকেটার - যেকোনো বিষয় নিয়ে কথা উঠলে যে নামটা সবার আগে থাকবে সেটি হচ্ছে শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। ক্রিকেটের সাথে এই নামটা যেনো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আর বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে কথা বলা হলে তাঁর নাম থাকবেনা সেটা কেমন করে হয়! কিংবদন্তি এই ক্রিকেটারের নামের পাশে কত শত যে রেকর্ডের পসরা সাজানো আছে সেটা হয়তো বলে শেষ করা যাবেনা। যেহেতু এখন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় তাই বিশ্বকাপ ক্রিকেট এবং এই লিটল মাস্টারকে নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। কেমন ছিলো তার সেই জার্নি?
প্রথম বিশ্বকাপ - ১৯৯২
- শচীন টেন্ডুলকারের ওয়ানডে ডেব্যু হয়েছিল ১৯৮৯ সালে পাকিস্থানের বিরুদ্ধে। অভিষেক হবার তিনবছরের মাথায় ১৯৯২ সালে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে জায়গা করে নেন ১৯ বছর বয়সী টেন্ডুলকার।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে ওয়াকা গ্রাউন্ডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপে অভিষেক হয়েছিল এই লিটল মাস্টারের। সেই ম্যাচে করেছিলেন ৩৫ রান।
দ্বিতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ব্যাটিং করার সুযোগ হয়নি তার। তৃতীয় ম্যাচটি ছিলো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্থানের বিপক্ষে। মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে দলীয় সর্বোচ্চ ৫৪ রান করেছিলেন তিনি। ১০ ওভার বল ঘুরিয়ে ৩৭ রান খরচ করে পেয়েছিলেন আমির সোহেলের উইকেট। ভারত সেই ম্যাচে জয় লাভ করে এবং ম্যান অফ দ্যা ম্যাচের পুরষ্কার পান টেন্ডুলকার।
সেবার ৭ ম্যাচে ব্যাটিংয়ে নেমে ৪৭ গড়ে ২৮৩ রান করেছিলেন তিনি।
1996 World Cup - A tournament with full of dreams & expectations
- ১৯৯৬ সালে আবারো উপমহাদেশে বসে বিশ্বকাপের আসর। সেবার স্বাগতিক দেশ হিসেবে বাড়তি চাপ ছিলো ভারতের উপর। আজহারউদ্দিনের নেতৃত্বে স্পট লাইটে বরাবরের মতো ছিলো একজন - শচীন টেন্ডুলকার। এবার তিনি আগের তুলনায় আরো পরিণত। শচীনকে ঘিরেই বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন বুনেছিলো কোটি ভারতীয়রা।
গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামে ভারত। কেনিয়ার দেওয়া ১৯৯ রানের টার্গেট ৭ উইকেট হাতে রেখে জিতে নেয় স্বাগতিকরা। শচীন টেন্ডুলকার খেলেন ম্যাচ উইনিং ১২৭ রানের ইনিংস।
গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৭০ রানের ইনিংস খেলেন এই মাস্টার ব্লাস্টার। এবারও ম্যাচ জিতে নেয় ভারত। টানা দ্বিতীয় বারের মতো ম্যান অফ দ্যা ম্যাচের পুরস্কার জিতে নেন শচীন। তৃতীয় ম্যাচে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৬ রানে হারলেও থেমে ছিলো না টেন্ডুলকারের ব্যাটের রান। এই ম্যাচেও ৮৪ বলে ৯০ রান করে দলকে লড়াইতে রেখেছিলেন। চতুর্থ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৩৭ রানের একটি ক্ল্যাসিকাল ইনিংস খেলেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে শচীন করেছিলেন ৩১ রান। ওই ম্যাচ জয়ের মাধ্যমে সেমিতে আবারো দেখা হয় শ্রীলংকার সাথে।
ইডেন গার্ডেনে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচে এক টেন্ডুলকার ছাড়া কোনো ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যান লংকানদের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। লঙ্কানদের দেওয়া ২৫১ রানের বিপরীতে ভারতীয়রা ১২০ রান করতে সক্ষম হয়। শচীন করেন দলীয় সর্বোচ্চ ৬৫ রান। দর্শকদের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দরুণ ম্যাচে শ্রীলংকাকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। অবশেষে সেমি ফাইনালে এসে বিশ্বকাপ যাত্রা থেমে যায় ভারতের। সর্বোচ্চ ৫২৩ রান করে সেবার টুর্নামেন্ট শেষ করেন শচীন।
1999 World Cup - Not up to the mark & a NIGHTMARE
ধারাবাহিকতা এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী ১৯৯৯ বিশ্বকাপ খুব একটা ভালো যায়নি টেন্ডুলকার এবং ইন্ডিয়ার। ওই আসরে ৭ ম্যাচে প্রায় ৪২ গড়ে ২৫৩ রান করেছিলেন তিনি। সেবার কেবল মাত্র ১ টি সেঞ্চুরি করেছিলেন টেন্ডুলকার। এই সেঞ্চুরির পেছনে শচীনের জীবনে এক কালো অধ্যায় জড়িত ছিলো বলা যায়।
বিশ্বকাপ চলাকালীন সময় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচের পর ১৯ মে রাতে শচীন খবর পান তার বাবা আর এই দুনিয়াতে নেই। খবর শোনা মাত্র আকাশ ভেঙে পড়ে তার মাথার উপর, সব কিছু যেনো স্বপ্নের মতো লাগছে তার কাছে। নিজের পিতাকে খুব ভালোবাসতেন টেন্ডুলকার। বিশ্বকাপের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ার আগে ঐটাই যে শেষ দেখা হবে সেটা হয়তো কোনদিন ভাবতে পারেননি তিনি নিজেও।
দ্রুত দেশে ফিরে আসেন পিতাকে শেষ বিদায় জানাতে। এই সময় সবাই ভেবেছিলো বিশ্বকাপের ওই আসর শচীন আর খেলতে পারবেন না। এতো বড় ধাক্কা কিভাবে সামলাবেন তিনি? পরবর্তীতে পিতার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে তিনি চারদিনের মাথায় ইংল্যান্ডে ফিরেন। সবার অনুরোধে আবারো খেলতে নামেন এবং তিনি এটাও বলেছিলেন তার পিতা বেঁচে থাকলে এটাই চাইতেন যেন তার ছেলে বিশ্বকাপে খেলেন এবং দেশে জন্যে ভালো কিছু নিয়ে আসুক।
২৩ মে কেনিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ ছিলো ভারতের। সেই ম্যাচে তিনি মাঠে নামেন এবং সেই ম্যাচে ১০১ বলে ১৪০ রানের ইনিংস খেলেন। ৮৪ বলে সম্পন্ন করেন সেঞ্চুরি। সেটি ছিল ওই বিশ্বকাপ আসরের প্রথম সেঞ্চুরি। নিজের সেঞ্চুরি পূরণ করার পর শুধুমাত্র ব্যাট তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের পিতার কথা স্মরণ করেন তিনি। তখন ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠে ভেসে উঠে এই শব্দগুলি - "Surely dedicated this century to his late father.... Remarkable concentration!"
2003 World Cup - An unbeatable MILESTONE by the Master Blaster!
- টেন্ডুলকার এবং ভারতের জন্যে মুদ্রার ঠিক উল্টো পিঠ ছিলো বিশ্বকাপের পরের আসরটি। সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে সেবারের দলটি বেশ ভালো কিছু করার সম্ভবনা নিয়ে সাউথ আফ্রিকা গিয়েছিলো।
২০০৩ বিশ্বকাপটি ছিল সম্পূর্ণ শচীনময়। গড়েছেন এক অদম্য রেকর্ড। ১ সেঞ্চুরি এবং ৬টি হাফ সেঞ্চুরির সাহায্যে ১১ ম্যাচে ৬১.১৮ গড়ে মোট ৬৭৩ রান করেছিলেন লিটল মাস্টার। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের এক আসরে সবচেয়ে বেশি রান করার রেকর্ডটি করে নেন নিজের নামে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে সেবার বিশ্বকাপ চলাকালীন নেটে একদিনও প্র্যাকটিস করেননি টেন্ডুলকার। একটা সিঙ্গেল বলও খেলেননি প্র্যাকটিস সেশনে। ২৪ ঘণ্টা যার ধ্যান জ্ঞানে ক্রিকেট থাকে, সময় পেলেই যিনি ব্যাটিং করতে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন সেই ভদ্রলোক কিনা প্রায় এক মাস নেটে প্র্যাকটিস না করে গড়েছেন এক অনন্য রেকর্ড যেটি অক্ষুণ্ন রয়েছে এখন পর্যন্ত!
2007 World Cup - A dark Chapter of Tendulker's career
-২০০৭ বিশ্বকাপের কথা হয়তো স্বপ্নতেও মনে করতে চাইবেন না শচীন। নিজের বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারের সর্বনিম্ন ৬৮ রান করেছিলেন সেবার।ভালো দল নিয়ে গেলেও ভারত গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয়।
মাঠ এবং মাঠের বাহিরের অনেক ঘটনা প্রভাবিত করেছিল সেবার। এর মধ্যে অন্যতম কারণ ছিলো তৎকালীন কোচ গ্রেগ চ্যাপেল। চ্যাপেলের সাথে দলের অনেক প্লেয়ারের ভালো সম্পর্ক ছিলো না। এমনকি বিশ্বকাপ শুরু হবার অল্প কিছু সময় আগে সে দলের পুরো ব্যাটিং অর্ডার চেঞ্জ করে ফেলে। এছাড়া প্লেয়ার ফ্রেন্ডলি ছিলেন না তিনি। এসব যাবতীয় বিষয় নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে বিসিসিআই এর এক কর্মকর্তাকে সতর্ক করেছিলেন শচীন। পরবর্তীতে হয়েছিলও তাই।
2011 World Cup - Finally fulfilled the DREAM!
- ২০০৭ বিশ্বকাপের পর শচীন ভেবেছিলেন এবার তার অবসর নেওয়া উচিত। কিন্তু একটা সময় তার আইডল ভিভ রিচার্ডসের বিশেষ অনুরোধে এবং সবার কথা ভেবে তিনি খেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আসন্ন ২০১১ বিশ্বকাপকে ঘিরে নিজের অধরা স্বপ্ন পূরণের জন্যে এগোতে থাকেন তিনি।
সেবার ৩৮ বছর বয়সী টেন্ডুলকার তার খেলায় বয়সের কোনো ছাপই পড়তে দেননি। ৯ ম্যাচে প্রায় ৫৪ গড়ে টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৮২ রান করেছিলেন তিনি। যার মধ্যে ছিলো ২টি সেঞ্চুরি এবং ২ টি হাফ সেঞ্চুরি। ভারত ২৮ বছর পর জিতেছিল বিশ্বকাপ। ক্যারিয়ারের শায়ান্নে এসে পূরণ হয় শচীনের অধরা স্বপ্ন। দলের এই জয়ের পেছনে গুরুত্বপূর্ন অবদান ছিল তার।
Overall Stats & conclusion:
সর্বমোট ৬টি বিশ্বকাপে মোট ৪৫টি ম্যাচ খেলেন টেন্ডুলকার। যেখানে ৪৪ ইনিংসে ৫৭ গড়ে করেছেন ২২৭৮ রান। সেঞ্চুরি করেছেন ৬টি এবং হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে ১৫টি। ওভারঅল স্ট্রাইক রেটও ছিলো যথেষ্ট ভালো (৮৮.৮৯)। ২০০৭ সালের বিপর্যয় না হলে এই রানের পরিমাণ আরো বেশি হতে পারতো। বাট স্টিল এই রেকর্ড অদূর ভবিষ্যতে কেউ ভাঙতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে টেন্ডুলকারের এই স্ট্যাট তার দুই যুগের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের একটি অংশমাত্র। যেখানে তিনি তার শ্রেষ্ঠত্বের জানান ভালোভাবেই দিয়েছেন।
ক্রিকেট জগতে টেন্ডুলকাররা বারবার আসবেন না। শচীন রমেশ টেন্ডুলকার একজনই - এক অদম্য, অতুলনীয়, অসাধারণ কিংবদন্তি ক্রিকেটার!
Sachin Ramesh Tendulker - The Ultimate GOD of Cricket!
- 0 মন্তব্য