• ফুটবল

ওয়েস্ট হ্যাম স্টেডিয়ামে একদিন।

পোস্টটি ৫২২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

যদি বলি ফুটবল যতটা সুন্দর, ততোটা ভয়ংকরও বটে- ভুল বলা হবে কিছু? যুগের পর যুগ একশো বিশ গজে পায়ের জাদুতে ঘাস মাড়িয়ে সুবাসিত মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন কতশত তারকা! ৯০ মিনিটের একেক রক্তপাতহীন বিপ্লবে মানুষ খুশিতে উজাড় করে দিয়েছে তার সকল হাস্যোজ্বল মূহুর্ত। 

 

আবার কখনোবা হেরে যাওয়ার বিষাদ পাকা হাতে ছোড়া ধনুকের তীর বুক বিঁধে নিঃস্ব করে দেয় যেন সব। কেউ কেউ স্মিত হেসে বলে, ফুটবল তো কেবলই একটা খেলা। তারা যে কত ভুল; সে হিসেব চুকানোর খাতা খুলে বসবে কেউ কখনো? 

 

থাক সেসব কথা। সেদিন এক নিরব বিপ্লব নিজ চোখে দেখবো বলে হাজার ষাটেক মানুষের মিছিলে নিজেকে সামিল করলাম। যে বিপ্লব শত বছরের। যে বিদ্রোহীরা সময়ের সাথে সাথে নিজেদের নিয়ে গেছেন এক অন্য উচ্চতায়। ওয়েস্ট হ্যাম বনাম বিস্টল সিটি- হোয়ার দ্যা রিভল্যুশন স্টার্টস! 

 

ওয়েস্ট হ্যাম সমর্থকদের বলা হয়ে থাকে লন্ডনের সবচেয়ে ক্ষেপাটে, রেসিস্ট আর উগ্র সমর্থক। ১২৩ বছরের পুরনো ক্লাবটির ইতিহাস যতটা না সমৃদ্ধ, তারচেয়ে বেশি বোধহয় ক্লাবটি সমর্থকদের শর্তহীন ভালোবাসায় সিক্ত! 

 

ইষ্ট লন্ডনের এই ক্লাবটির সমর্থকদের আমি প্রায়ই দেখি। রাস্তায়, ট্রেনে, বাসে- ক্যাফে রেস্তোরায়, আড্ডায়, আলোচনা- তর্কে সরব ভূমিকায়। বয়সের ভারে ন্যুব্জ বুড়ো- বুড়ির দল, উদ্যম তরুণ-তরুণী; মাঝবয়েসী আঁধা পাকা জোয়ানের সারি- দুই হাতুড়ির লগো বুকে ধারণ করে বহমান নদীর মতো জীবন পার করে দিচ্ছেন আলবৎ! সমর্থক হিসেবে তারা যেমন ঝানু, তেমনি বেজায় কট্টরপন্থী। উনিশ থেকে বিশ- কিছু হলেই স্টেডিয়াম পাড়ায় দাঙ্গা বাজিয়ে প্রতিপক্ষকে নিরাশ করে লেগে পড়ে হাঙ্গামায়। 

 

ব্যাপারটা মাথায় রেখেই টিকেট কাটলাম। খেলা ব্রিস্টল সিটির সাথে, এরা আরোও বড় উগ্র! চামড়ার বৈষম্য চোখে পড়ার মতো। ইংল্যান্ডে এসে বহু স্টেডিয়াম ঘুরা হয়ে গেছে। ওয়েস্টহ্যামের এই স্টেডিয়ামে বেশ কয়েকবারই যাওয়া হয়েছে, তবে এবারের ব্যাপারটা ছিলো ভিন্ন। লাইভ ফুটবল ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতা আমার ওয়াইফের ছিলো না; বললাম,  এবার তাহলে একসাথে দেখা যায়। 

 

অনেক যল্পনা কল্পনা শেষে অবশেষে ম্যাচের দিন আসলো। আমরা বাসা থেকে রওয়ানা দিলাম। ওয়েস্ট হ্যাম স্টেডিয়ামে যাওয়ার জন্য যে স্টেশনে নামতে হয়, সেখানে ম্যাচের দিন মধ্যাহ্ন হতেই ভীড়ের দুন্দুমার। পুলিশ, অসংখ্য সিকিউরিটি আর সাধারণের ঠেলাঠেলি এড়াতে চাইলাম; তা আর কি পারা যায়। কবি হেলাল হাফিজের কবিতার দু'লাইন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো; 

 

ব্যর্থ হয়ে থাকে যদি প্রণয়ের এতো আয়োজন;

আগামী মিছিলে এসো- 

স্লোগানে স্লোগানে হবে কথোপকথন!  

 

ফুটবল ভক্তদের কাছে এই দুই লাইন কতটা সত্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ম্যাচ হেরে গেলেও, হাজারো ব্যর্থতার পরও যে তাদের পক্ষে সরল স্বীকারোক্তি দেয়া যায় তা কেবল ফুটবল ভক্তরাই জানেন। আর তারা এটাও জানেন, ফুটবল শুধুই একটা খেলা নয়...

 

মিছিলে হাটছি, কিছুক্ষণ পরই দু'দিকে দুই সমর্থকদের পথ আলাদা। বুঝতে পারলাম হোম এবং এওয়ে ফ্যানদের জন্য এই ব্যবস্থা। আমরা ছিলাম এওয়ে ফ্যানের ক্যাটাগরিতে পাওয়া টিকেট হোল্ডার। তাই এওয়ে ফ্যানদের সাথে হাটতে হলো। 

 

পুরো এক পৃথিবী হাটা শেষে অবশেষে প্রধান নিরাপত্তা বেস্টনিতে পেরিয়ে মূল স্টেডিয়াম প্রাঙ্গনে প্রবেশ করলাম। যা দেখলাম, বুঝলাম; এটাই একটা স্টেডিয়ামের পরিবেশ হওয়া উচিৎ। হইহট্টগোল, ভীষণ টালমাটাল পরিস্থিতি, শব্দের চূড়ান্ত; পুলিশের সামনেই অপজিশন টিমের দর্শকদের দেখে নেয়ার হুমকি। বেশ মজা পেলাম। 

 

যা ভেবেছিলাম তারচেয়ে বেশি কিছুই পেলাম বোধহয়। অন্তত ষাট হাজার দর্শকের সাথে বসে লাইভ ম্যাচ দেখার যে উৎসব, তা দেখা যায় চোখ ভরে; বুক ভরে নিশ্বাস নেয়ার মতো। বর্ণনা বোধহয় করা যায় না ততোটা সহজে। মাঠের একদম মধ্যখানের ৩য় তলায় আমাদের বসার জায়গা। এতো দারুণ ভিউ আর সুক্ষ্মদর্শী প্রানবন্ত চমৎকার সবকিছু ঘটে চলেছে একটানা। 

 

যারা বলেন ফুটবলটা টিভির পর্দাতে সুন্দর; তারা এই ভুল ধারণা ভাঙ্গাতে জীবনে একবার হলেও স্টেডিয়ামে বসে লাইভ খেলা দেখতে বসার অনুরোধ। টিভির পর্দায় যা দেখায়, রিয়েল টাইমে এই জিনিসটা ঘটে আরোও অন্তত ২ সেকেন্ড আগে! অনেক দূর থেকেও খুব স্পষ্ট দেখা যায় খেলা; ফুটবলের গতিও লক্ষ্য করা যায় ভালো ভাবেই। 

 

আশা নিয়ে বসেছিলাম ওয়েস্ট হ্যাম অন্তত এক হালি গোল তো দিবেই, বিস্ট্রল যা পুচকে দল। সে আশায় গুড়ে বালি। ১-০ তে এগিয়ে থাকা হ্যামারদের বিপক্ষে যখন বিস্ট্রল দ্বিতীয়ার্ধে খেলতে নামলো, তখনি বুঝা গেলো কিছু একটা হবে। দারুণ ফুটবল উপহার দিলো তারা। এর ফলও পেয়ে গেলো গোল করে। আর তাতেই একটা বিশাল সাড়া পড়ে গেলো মাঠজুড়ে। 

 

ব্রিস্টল সিটি সমর্থকদের বসার জায়গা ছিলো দারুণ এঙ্গেলে; ঠিক গোলকিপারের পিছনে। গোল করার পর থেকে তাদের বাঁধভাঙা উল্লাস দেখার মতো ছিলো। 

 

শুরুতেই বলেছিলাম ওয়েস্টহ্যাম দর্শকেরা উগ্র। তার দেখা মিললো স্টেডিয়াম থেকে বেরুবার পথে। বিস্ট্রল সিটি এক সমর্থকের সাথে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়লো এক যুবক; কারণ ফেরার পথে একে অপরকে স্লেজিং করছিলো বলে। 

 

সবমিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা। বারবার স্টেডিয়ামে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ পাওয়ার মন্ত্রনা। ফুটবল দেখুন, ফুটবল ভালোবাসুন; আর হ্যাঁ ফুটবল শুধুই একটা খেলা নয়। তারচেয়ে বেশি কিছু।