• ক্রিকেট

বিদায় অলরাউন্ডার !!

পোস্টটি ২২০৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

চট করে যদি টেস্ট ক্রিকেটের দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরির (বলের হিসাবে) মালিকের নাম জানতে চাওয়া হয়, রিচার্ডস, ইয়ান বোথা্‌ কপিল দেব, এন্ড্রু ফ্লিন্টফ, এডাম গিলক্রিস্ট, শহীদ আফ্রিদী কিংবা হাল আমলের ক্রিস গেইল, ওয়াটসন, ধোনিদের চেহারা ভাসবে। কিন্তু বিস্ময়কর ভাবে এরা কেউই এই রেকর্ডের মালিক নন। এই রেকর্ডের মালিকের নাম জ্যাকস ক্যালিস। যারা খেলাটা দেখেন নি কিংবা জানেন না তারা ভ্রু কুঁচকে তাকাবেন নিশ্চিতভাবেই। হ্যাঁ, ক্যালিস! ব্যাটিংয়ে যিনি স্থিতধী ব্যাটিংয়ের ভিন্ন নাম, নিন্দুকের কাছে যিনি মনোটোনাস, সেই ক্যালিসই কিনা দ্রুততম সেঞ্চুরির মালিক। এই ব্যাপারটা আসলে অন্য একটা কথা বলে দেয়। সেটা হলো জ্যাকস চাইলে দর্শকের জন্য বিনোদনদায়ী বাহারী মারের পসরা সাজিয়ে খেলতে জানেন। কিন্তু দর্শক মনোরঞ্জনের চাইতে তিনি সবার আগে প্রফেশনাল আর তিনি নিজের উইকেটের উপর বড় রকমের ভ্যালু সেট করতে জানেন আর অতি অবশ্যই খেলাটাকে দারুণ ভাবে পড়ে ফেলতে পারেন। তার ব্যাটিং হয়তো প্রতাপের ভারে দোর্দণ্ড রাজসিক না তবে তিনি হলেন ক্রিকেট স্কুলের সবচেয়ে মনোযোগী ছাত্র। 

শুধু ব্যাটিং নিয়ে কথা বললে তার বোলিংকে আড়াল করে ফেলা হয়। অথচ কিনা উইকেটের সংখ্যা তিনি এমন উচ্চতায় এমনকি ব্যাটিং করতে না জানলেও দলে টিকে যেতেন বহুদিন। এবং শুধু বোলার হিসাবে ও তার নাম স্মরণ হতে পারত ক্রিকেট রোমান্টিকদের কাছে। নরশার্দুল তার বোলিংয়ে ব্যবহার করতেন একই সাথে তার ক্ষুরধার ক্রিকেটীয় মগজ এবং  চওড়া কাঁধের পূর্ণ সুবিধাকে। 'করতেন' বলা এই জন্য যে, টেস্ট ক্রিকেটের প্রজন্মের সেরা অলরাউন্ডার মাত্রই দাঁড়িয়েছেন সাবেকদের পাশে তার ব্যাট প্যাড তুলে রেখে। পরিসংখ্যানের আলোয় ক্যালিসকে দেখার চাইতে বরং ক্যালিসকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করা যাক।

ক্যালিসের খেলা প্রথম দেখি ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে। হাডসন, কারসটেন, কালিনান, ক্রনিয়ে, রোডস, ডোনাল্ড, ম্যাকমিলান এমনকি ইয়ং স্টার পোলকের তুলনায়ও একেবারেই অচেনা নাম। 

কারসটেনের ১৮৮ এর ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পায়নি। আর ভঙ্গুর আরব আমিরাতের ব্যাংটিয়ের ত্রাহি দশার মাঝেও বল করে বেশ কিছু রান খরচ করেছিল। তারপরেও ভালো লেগেছিলো তার বোলিংয়ের ধরণ। সেইসময় ক্রিস কেয়ার্নসকে সবচেয়ে কম্প্লিট অলরাউন্ডার ভাবা হত। ক্যালিস ছিলো একজন ব্যাটসম্যান যে পাঁচ ওভার বল করে।

ধীরে ধীরে বদলে যায় দৃশ্যপট। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় শ্রীলংকাকে তুলাধুনো করে যে ইনিংস খেললেন বৃষ্টিভেজা মাঠে সেটা তো রীতিমত বিস্ময়কর। তবে সেই ইনিংসে ক্যালিস তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শ্রীলংকান বোলারদের নিয়ে ছেলে খেলা করে তাদেরকে রীতিমতো পাড়ার বোলারের কাতারে নামিয়ে আনেন। অবিশ্বাস্য সব শট খেলেছেন তিনি সেদিন ফর্মের তুঙ্গে থাকা মুরালিধরন থেকে শুরু করে সিমিং কন্ডিশনে দুর্বোধ্য শ্রীলংকান সিমারদেরও। ক্যালিসের সেই ইনিংসের মর্ম আরও ভালো মত বুঝা যায় শ্রীলংকা ব্যাটিংয়ে নামার পরেই। উইকেট যে স্ট্রোক খেলার জন্য খুব সহজ ছিলো না সেটা পরিষ্কার হয়ে যায় ভালো মতই। সেই ম্যাচ খেলে দলকে তুলে নিলেন ফাইনালে।

ফাইনালে সেই টুর্নামেন্টের বিস্ময় ফিলো ওয়ালেসের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। প্রথমে ধরে শুরু করে সময়মতো হাত খুলেছিলেন ফিলো। এমনকি লারার দ্রুত ফিরে যাওয়াও প্রভাব ফেলতে পারেনি ইনিংসে। অথচ প্রভাব ফেললেন ক্যালিস। এইবার বল হাতে এমন সুনিয়ন্ত্রিত বোলিং করলেন এবং সময়োপযোগী উইকেট তুলে নিলেন যে উইন্ডিজ তাদের নির্ধারিত ওভারও শেষ করতে পারলো না। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার জেতা একমাত্র বৈশ্বিক শিরোপা দিয়ে তার রাজত্বের আগমনী বার্তা দিয়েছিলেন।    

পরের বছর ১৯৯৯ সালে ক্যালিস-ক্লুসনার ব্যাটিং কম্বো তো দক্ষিণ আফ্রিকার সঞ্চালনীই ছিলো। ক্যালিস ধরে খেলে অবস্থান তৈরি করতো আর ক্লুজনার শেষ করত। ডোলান্ড পোলকদের সাপোর্টিভ হিসাবে বোলিংয়েও কম যাননি। ইতিহাস পরিসংখ্যান ক্যালিসের খেলা ম্যাচ দিয়ে তাকে বিবেচনা করে অথচ তার না খেলা ম্যাচ তার  গ্রেটনেস ফুটিয়ে তুলে আরো তীব্রভাবে।

হ্যাঁ, আমি ১৯৯৯ সালের সুপার সিক্সের দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের কথা বলছি। সেই ম্যাচ স্মরণীয় হয়ে আছে গিবসের ক্যাচ ছাড়া আর স্টিভ ওয়াহর অবিস্মরণীয় ইনিংসের জন্য। সেই ম্যাচটি আসলে পেটের পেশীর ইনজুরিতে না খেলা ক্যালিসের অভাব পুরোপুরি অনুভব করেছে তার দল। কারণ ক্যালিস তো আসলে একই সাথে দুইজন খেলোয়াড়। গিবসের সেঞ্চুরিতে হয়তো তার ব্যাটিয়ের অভাব পোষানো গেছে কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে তৈরি হওয়া পঞ্চম বোলার শূন্যতা দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভুগিয়েছে শেষ পর্যন্ত। ক্রনিয়ে এবং বোয়ে মিলে ৭৯ রান দিয়েছিলেন দশ ওভারে। পরের ম্যাচে দশ ওভারে মাত্র ২৭ রান দিয়ে ক্যালিস নিশ্চয় আগের ম্যাচের আক্ষেপকেই মনে করিয়ে দিয়েছেন নতুন ভাবে। 

দশ ওভারে ২৭ আর দুরন্ত ফিফটিতে সেমির অন্যতম সেরা পারফরমার ক্যালিস, ওয়ার্ন, পোলক, ক্লুজনারের ছায়ায় আড়াল হয়ে যান এই আড়াল হয়ে যাওয়াটাই তার ক্যারিয়ারের বরাবরের ঘটনা। তাই তো একেবারে যেন সকলের অগোচরেই করে ফেলেছেন ৪৫ টি সেঞ্চুরি! আর সেই সাথে ২৯২ টেস্ট উইকেট! 

তার টেস্টের টেমপারমেন্ট পরীক্ষিত। খেলার টেকনিক নিয়েও বলার কিছু নেই। বরং আমার দেখা দুটি স্মরণীয় ডাকের কথা বলি। প্রথমটি আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে ঘটলেও চোখের সামেন দেখতে পারি। সেই ঘটনা ছিলো বিরল ঘটনা। সেটা ছিলো আসলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ফলোঅনে পড়তে দেখা। সেই ম্যাচে অ্যান্ডি ক্যাডিকের একটি অসাধারণ বলে আউট হয়ে যান ক্যালিস। তবে সেই বিরলের পরেও আরো বিরল ঘটনা দেখা বাকি ছিলো। দ্বিতীয় ইনিংসে প্রোটিয়াদের ঘুরে দাড়ানো ছিলো তাদের স্পিরিটের পরিচয়। কদাকার ব্যাটিংয়ের জন্য দুর্নাম কামানা কার্স্টেন অতি মানবিক ইনিংস (২৭৫) খেলে সেই ম্যাচ বাঁচানোতে নেতৃত্ব দিলেও দুই শতাধিক বল খেলে করা অর্ধ শতকে ক্যালিসও যে তাদের পায়ের নিচে মাটি আনতে সাহায্য করেছিলেন একথা নিশ্চয় করে বলা যায়। আমার যেটা ভালো লেগেছিলো আগের ইনিংসে ডাকের কারণে ক্যালিসের একাগ্রতা আর উইকেটে লম্বা সময় কাটানোর ইচ্ছা। এই জিনিসটাই ক্যালিসকে করেছে অন্যদের চেয়ে মহান।

হ্যা বলছিলাম দুটো ডাকের কথা। দ্বিতীয় ডাকের স্মৃতি এখনো তরতাজা।ভারতের আফ্রিকা সফরের প্রথম টেস্টে গোল্ডেন ডাক উপহার পান ক্যালিস। আর ক্যালিস ফুরিয়ে গেছেন এমন রবের মাঝে অবসরের ঘোষণা দিয়ে প্রবল চাপে আরও একবার নিজেকে প্রমাণ করলেন রাজসিক বিদায়ী শতক দিয়ে। অথচ তার নিজেকে প্রমাণ করবার কিছু ছিলো না।

বিদায় ক্যালিস। যতদিন টেস্ট ক্রিকেট থাকবে তোমার নাম উচ্চারিত হবে সেরাদের সেরার একদম প্রথম তালিকায়।   

(লেখাটি পূর্বে অন্যত্র প্রকাশিত