হুয়ানিতোকে মনে পড়ে...
পোস্টটি ১৪০৮ বার পঠিত হয়েছে
ফুটবল সমর্থকদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ফুটবল মাঠে কোন পজিশনের খেলোয়াড়কে নেতা হিসেবে দেখাটা অন্যান্যদের থেকে স্বাভাবিক, তাহলে বেশ কিছু উত্তর পাওয়া যাবে; যেমন গোলকিপার, সেন্টার ব্যাক, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ইত্যাদি। খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যাদের উত্তর হবে উইঙ্গার। আসলে যুগে যুগে যত মালদিনি, বেকেনবাওয়ার, ক্যাসিয়াস, জাভিরা এসেছেন, তার তুলনায় খুব কমই এসেছেন কোপা, আমান্সিওরা। কিন্ত এই উইঙ্গারদের মধ্য থেকেই রিয়াল মাদ্রিদ ও ফুটবলবিশ্ব পেয়েছিল এমন এক নেতাকে, যার জাদুমন্ত্রে, যার হাল না ছাড়া মনোভাবের ফলে সত্তর ও আশির দশকে রিয়াল সেল্টিক, ইন্টার মিলান, আয়াক্সের মত কঠিন প্রতিপক্ষের সাথে পিছিয়ে পড়েও ছিনিয়ে আনতে পেরেছিল অপ্রত্যাশিত ও বিখ্যাত কিছু জয়। সাম্প্রতিক সময়ে রিয়ালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে রোনালদোর সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলী যেন আজকের গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হুয়ান গোমেজ গঞ্জালেস ওরফে হুয়ানিতোকেই মনে করিয়ে দেয়।
ফুটবলে যখন কোন দল পিছিয়ে পড়ে, যখন তারা তাদের সহজাত খেলাটা খেলতে ব্যর্থ হয় বা অনেক সুযোগ তৈরি করেও গোলের দেখা পায় না, তখন দলনেতার নেতৃত্ব ও খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করতে পারার ক্ষমতা অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। হুয়ানিতো ছিলেন এরকমই একজন। অত্যন্ত দৃঢ় মনোবলের অধিকারী হুয়ানিতোর ক্যারিয়ারটা অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে শুরু হলেও তিনি তার জাত চিনিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে। ’৭৭ থেকে ’৮৭-এই দশটি বছর রিয়াল মাদ্রিদের লড়াকু মনভাবের প্রতীক হয়ে ছিলেন তিনি। অসাধারণ ড্রিবলিং ক্ষমতা, বিদ্যুৎ গতির এই উইঙ্গার মাদ্রিদ অভিজাতদের হয়ে সাড়ে তিনশরও বেশী ম্যাচ খেলে গোল করেছিলেন ৯৯টি আর দশটি শিরোপাও জিতেছেন । কিন্তু এসব কেতাবী হিসাব নিকাশের চেয়ে রিয়াল সমর্থকেরা তাকে মনে রেখেছে তার কখনোই হার না মানা মনোবলের জন্য। পরিস্থিতি যতই বেগতিক হোক না কেন, তা আর যে কাউকে হোক, হুয়ানিতোকে পিছপা করতে পারতো না।
এই ভয়ডরহীন চরিত্রের জন্য অল্পদিনের মধ্যেই রিয়াল সমর্থকের চোখের মণি হয়ে ওঠেন তিনি। রিয়ালে এসেই তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলা আকাশ ছোঁয়ার মতই। রিয়াল সবসময়ই আমার প্রিয় ক্লাব আর মাদ্রিদ আমার প্রিয় শহর’। একজন উইঙ্গার ও একজন নেতার যেসব গুণাগুণ থাকার দরকার, তার প্রতিটাই ছিল তার। খেলার মাঠে গতি ও ড্রিবলিং দিয়ে যেমন সমর্থকদের চোখ ধাঁধিয়েছেন, তেমনি আক্রমণাত্মক ভাবমূর্তি দিয়েও নজর কেড়েছেন অনেকের। জয়ের জন্য যেকোন কিছু করতে সদা প্রস্তুত ছিলেন তিনি। এজন্য ক্যারিয়ারে অনেকবার তাকে সাসপেন্ডও করা হয়েছিল। একবার তো লথার ম্যাথাউসকে পায়ে আঘাতের জন্য পাঁচ বছরের জন্য বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। এতকিছুর পরেও কখনোই তার প্রতি তার সমর্থকদের ভালবাসা এতটুকুও কমেনি।
আগ্রাসী খেলোয়াড় হলেও এই আগ্রাসনেকই শক্তিতে পরিণত করে মাদ্রিদকে দিয়ে গেছেন একের পর এক অসাধারণ মুহূর্ত। এর অন্যতম উদাহরণ ছিল ’৭৯-’৮০ ইউরোপিয়ান কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে সেল্টিকের কাছে ২-০ তে পিছিয়ে পড়েও ৩-০ তে হোম লেগ জিতে সেমিতে যায় রিয়াল। ইন্টার মিলানের সাথেও এরকম এক অসাধারণ কামব্যাক করেছিল রিয়াল। দ্বিতীয় লেগ শেষ হওয়ার পর হুয়ানিতোর ইন্টারের খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্যে ‘বার্নাব্যুতে ৯০ মিনিট অনেক দীর্ঘ সময়’ করা উক্তিটি এখনো সমর্থকদের মুখে মুখে ফেরে। এরপর থেকে কোন ম্যাচে, বিশেষ করে দুই লেগের নকআউট পর্বে মাদ্রিদ পিছিয়ে পড়লে সমর্থকেরা হুয়ানিতোর স্মৃতিচারণ করে দলকে অনুপ্রারিত করেন।
হুয়ানিতোর চেতনা যেন সর্বদাই মাদ্রিদের দলের মধ্যে থাকে, সেজন্য সমর্থকেরা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যান। প্রতি ম্যাচের সপ্তম মিনিটে ‘আল্ট্রাস’দের ‘ইলা, ইলা, ইলা, হুয়ানিতো মারাভিয়া’ (হুয়ানিতো আমাদের বিস্ময়) চ্যান্ট করতে শোনা যায়। হুয়ানিতোই মূলত মাদ্রিদের ৭ নম্বর জার্সিটিকে বিখ্যাত করে তোলেন। নিজের প্রথম এল ক্লাসিকোতে ১ গোল ও ১ অ্যাসিস্ট করে দলকে জিতিয়ে ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে যখন তাকে উঠিয়ে নেওয়া হয়, তখন তার শিশুসুলভ উদযাপন আজো রিয়ালের সমর্থকদের শিহরিত করে। তাদের কাছে হুয়ানিতোই হয়ে উঠেছিলেন ক্লাবটির প্রতীক, ক্লাবটির ইতিকথার সারমর্ম।
রিয়ালে দশ দশটি সাফল্যমণ্ডিত বছর কাটানোর পর হুয়ানিতো মালাগায় চলে যান। বিদায়বেলায় নিজে যেমন কেঁদেছিলেন অঝোরে, অসংখ্য ভক্তকেও কাদিয়েছেন সেভাবেই। ভাবা যায়! নিজেদের শহরের প্রতিদ্বন্দীদের দলে ক্যারিয়ার শুরু করা একজনের জন্য এভাবে অশ্রু ফেলেছিল রিয়াল সমর্থকেরা। হ্যাঁ করা যায়, যখন খেলোয়াড়টি হুয়ানিতো...
ক্লাব ছাড়ার পরেও যে ক্লাবের প্রতি ভালবাসা এতটুকু কমেনি তার প্রমাণ মেলে রিয়ালের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে স্টেডিয়ামে হুয়ানিতোর সশরীর উপস্থিতি। ’৯২ এর একরাতে প্রিয় ক্লাব মাদ্রিদের খেলা দেখে বাড়ী ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান রিয়ালের এই কিংবদন্তী। স্থানীয় সময় রাত ২টায় ঘটনাটা ঘটলেও অচিরেই খবরটি স্পেনে ছড়িয়ে পড়ে। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেন হাজারো ভক্ত। স্পেনের প্লাজা লা সিবেলেস চত্বরে তার লাশ আনা হলে সমর্থকদের গগনবিদারী কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। প্রিয় তারকাকে শেষবারের মত দেখার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে লাখো ভক্ত। মৃত্যুর ২৪ বছর পরেও আজো সমর্থকদের মনে তিনি হয়ে আছেন সেই অকুতোভয়, সেই হার না মানা সেনানী হিসেবে। আজকের এল ক্লাসিকোতে বার্সা যেমন ইয়োহান ক্রুইফকে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে ম্যাচটি জিততে চাইবে, ঠিক তেমনি ২৪ বছর আগে আজকের এই দিনে হারানো হুয়ানিতোর জন্য ম্যাচটি জিততে চাইবে রিয়াল। রিয়াল কি পারবে তাদের এই অকুতোভয় বীরের জন্য ম্যাচটি জিততে? উত্তরটা জানা যাবে আজকের মধ্যরাতেই।
- 0 মন্তব্য