• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    তুরিনের রাতটা অ্যালেগ্রিরও

    তুরিনের রাতটা অ্যালেগ্রিরও    

    সিরি আ শিরোপা মোটামুটি নিজেদের সম্পত্তিই বানিয়ে ফেলেছে জুভেন্টাস। টানা ৮ বারের মতো শিরোপার পথে হাঁটছে তারা। উন্নতির গ্রাফটা বুঝতে তাই চ্যাম্পিয়নস লিগ হয়ে গেছে জুভেন্টাসের মৌসুম বিচারের একমাত্র টুর্নামেন্ট।

    অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে প্রথম লেগে ২-০ গোলে হারের পর আরও একবার জুভের পুরনো স্বপ্নে নতুন করে লেগেছিল আঘাত। জুভেন্টাস ম্যানেজার মাসিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রিও পড়ে গিয়েছিলেন। ইতালিতে গুঞ্জন, মৌসুম শেষেই হয় চাকরি ছাড়বেন অ্যালেগ্রি, নয় হারাবেন। সম্ভাব্য নতুন ম্যানেজারের তালিকা নিয়েই তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল।

    শেষ ৪ বছরে দুইবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল থেকে খালি ফিরেছেন অ্যালেগ্রি। বাকিদের সঙ্গে ব্যবধান ঘোচাতে তাকে এনে দেওয়া হয়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকেও। এরপরও ব্যর্থ হলে, অ্যালেগ্রির জন্য রাস্তা একটাই খোলা ছিল। রোনালদোতে ভর করেই আরেকটি ধাপ পেরিয়ে গেছেন অ্যালেগ্রি। হুট করেই কঠিন হয়ে পড়া চাকরিটা তাই তাকে স্বস্তি যোগাবে আরও বেশকিছু দিন। শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস লিগ এবার অ্যালেগ্রির কপালে জুটুক আর নাই জুটুক, তুরিনে দ্বিতীয় লেগে নিজের মেধাটা দেখিয়েই দিলেন তিনি। রোনালদো যদি নায়ক হন, তো অ্যালেগ্রি সেই সিনেমার পরিচালক। তুরিনের অমন রাতে ভেলকি তো কম তিনিও দেখাননি!

    শুরুটা ম্যাচের আগে সংবাদসম্মেলনে। ইউরোপের সবচেয়ে গোছানো দলের বিপক্ষে তুরিনে অন্তত দুই গোল করতেই হবে, হজমও করা যাবে না। এমন সমীকরণ উপেক্ষা করে অ্যালেগ্রি বললেন, ম্যাচটা উপভোগ করতে হবে। ইউরোপিয়ান ফুটবলই নাকি উপভোগ করার আসল জায়গা! অ্যালেগ্রির অমন গা ছাড়া মন্তব্য পছন্দ হয়নি বিয়াঙ্কোনেরিদের। টুইটারে এখনও হ্যাশটেগসহ অ্যালেগ্রি আউটের ট্রেন্ডটা মিলিয়ে যায়নি- সেটাই তার প্রমাণ।


    অ্যালেগ্রি অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে মজাই করলেন। উপভোগ করলেন একদম শুরু থেকে! চমক দেখালেন একাদশে। সিরি আতে এই মৌসুমে মাত্র একবারই চার গোল করেছে জুভেন্টাস। সেটাও এই শনিবার, উদিনেসের বিপক্ষে। আক্রমণাত্মক দল হিসেবে খুব একটা খ্যাতি ছিল না জুভেন্টাস বা অ্যালেগ্রি- কারোই। অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে শুরু থেকেই যে আক্রমণামত্মক খেলতে হবে সে তো ফুটবলের ব-কলম না জানা লোকেও বুঝবে। সেই ম্যাচে আক্রমণের অন্যতম ভরসা পাউলো দিবালাকে বসিয়ে রাখলেন বেঞ্চে। তার জায়গায় নামালেন ফ্রেডেরিকো বের্নাদেস্কিকে।

    দিবালা প্রথম লেগে অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে সুবিধা করতে পারেননি মোটেই। আঁটো সাটো রক্ষণে সেদিন দিবালা অকার্যকর রেখেছিলেন অ্যাটলেটিকো ডিফেন্ডাররা। পরিবর্তনটা কখন আনতে হবে সেটা জানাই ছিল অ্যালেগ্রির। সময়মতো বিরাট সিদ্ধান্তটা নিতেও পিছপা হননি। দিবালা রাইট উইং দিয়ে কাটিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। পায়ে জাদু থাকলেও, বলের নিয়ন্ত্রণ হারানোর বদভ্যাস আছে তার। বের্নাদেস্কি মেধার হিসেবে দিবালার অনেকটাই পেছনে থাকবেন। কিন্তু তার হোল্ড আপ প্লে নিখুঁত। টোটকাটা শতভাগ কাজে দিয়েছে অ্যালেগ্রির। রাইটফুটেড লেফটব্যাক হুয়ানফ্রানকে জ্বালিয়ে মেরেছেন বের্নাদেস্কি। রোনালদোর প্রথম গোলটা তার ক্রস থেকেই। প্রথমার্ধে নিজেও দুর্দান্ত একটি ওভারহেড কিক করেছিলেন। বিরতির পর শুরুতেই একটা গোলের সুযোগ তৈরি করেছিলেন তিনি।

    দিবালা নামার পর বের্নাদেস্কি সরে যান লেফট উইং এ। সেখানেও সফল তিনি, পেনাল্টিটাও আদায় করে নিয়েছেন তিনিই।

    রোনালদোর জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুতের কৌশলটা আরও ভালোভাবে সাজিয়ে রেখেছিলেন ঝানু অ্যালেগ্রি। দুই প্রান্ত দিয়ে অবিরাম ডিবক্সের ভেতর ক্রস করাটাও ছিল সেটারই অংশ। গতবার সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগেও প্রায় একই কৌশল অনুসরণ করেছিলেন অ্যালেগ্রি। প্রথম লেগে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে ৩-০ গোলে হারের পরও, বার্নাব্যুতে জিনেদিন জিদানের দলের টুটি চেপে ধরেছিল জুভেন্টাস। তিন গোল শোধও দিয়েছিল তুরিনের বুড়িরা, কিন্তু শেষে গিয়ে রোনালদোর পেনাল্টিতে করা গোলে হেরে বসে জুভেন্টাস। এবার যখন ব্রক্ষাস্ত্রটা হাতেই ছিল, তখন আর অ্যালেগ্রিকে কে ঠেকায়!

    মারিও মাঞ্জুকিচ এবার সেই ম্যাচের মতো অতোগুলো সুযোগ পাননি। পেয়েছেন রোনালদো। এর মধ্যে দুইবার গোল করেছেন, আরও দুইবার গোল পেতেও পারতেন।

    দুই গোল শোধ করার পরও অ্যালেগ্রি নিজের চিরাচরিত রক্ষণাত্মক কৌশলে ফিরে যাননি। আগেরবারের শিক্ষাটাই হয়ত নিয়েছেন। শিকার না করতে পারলে, পরে শিকারে পরিণত হতে হয়নি তাই তাকে এবার। দিবালা, মাঞ্জুকিচ, রোনালদো, বের্নাদেস্কিদের একসঙ্গে খেলালেন প্রায় মিনিট দশেক। তাতে অ্যাটলেটিকোর যখন ম্যাচে ফেরার লড়াই করার কথা, তখন তারা রক্ষণেই ঠেকে থাকল।

    ১৯ বছর বয়সী স্ট্রাইকার মুসা কিনকে এই মৌসুমে খুব বেশি সুযোগ দেননি অ্যালেগ্রি। শেষ ম্যাচে উদিনেসের বিপক্ষে বাজিয়ে দেখেছিলেন তাকে। কিন করেছেন জোড়া গোল। দলে আরও তারকা থাকতে অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে তাকেও কাজে লাগালেন। মাঠে নেমেই কিন আরেকটু হলে গোলটা পেয়ে যেতেন প্রথম শটেই। অ্যাটলেটিকোর কাছে হারের পর থেকেই প্রতিটি ম্যাচে একটু একটু করে দল গুছিয়ে, সঠিক কৌশল বাছাই করার কাজটা করে রেখেছিলেন অ্যালেগ্রি।

    অ্যালেগ্রি চমক দেখিয়েছিলেন দিবালার বদলির সময়ও। লেফটব্যাক স্পিনাজোলাকে বসিয়ে নামিয়েছিলেন দিবালাকে। ৪-৩-৩ এ  শুরু করা জুভেন্টাস ৬৭ মিনিটে তখন ফর্মেশনে বদলে খেলা শুরু করে ৩-৪-৩। শেষ কবে অ্যালেগ্রি এতোটা আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলেছেন, সেটা বোধ হয় তিনি নিজেও মনে করতে পারবেন না।

    ডিয়েগো সিমিওনে আর অ্যালেগ্রির দলকে ইউরোপের সেরা রক্ষণাত্মক দল যায় অনায়াসেই। নির্ভুল রক্ষণ এই দুইদলের অলঙ্কার। সেই ম্যাচে সিমিওনেকে পদে পদে চমকে দিয়ে গেছেন অ্যালেগ্রি। করেছেন পুরো উল্টো কাজ। বেরিয়েছেন নিজের খোলস থেকে। আক্রমণ দিয়েই কোনঠাসা করেছেন সিমিওনেকে।

    তাই রোনালদো যতোই আলো কাড়ুন, সবকিছুই আসলে অ্যালেগ্রিরই মাস্টাপ্ল্যানের অংশ। যিনি আসলে আরেকবার প্রমাণ করলেন, সময়ের প্রয়োজনে যে কোনো দলকেই অচেনা কৌশলে খেলিয়েও ফলটা বের করে আনা যায়।

     

     

    মৌসুমের শুরুতে রোনালদোকে অ্যালেগ্রির হাতে তুলে তার কাছে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা চেয়েছিলেন জুভেন্টাসের হর্তা-কর্তারা। চাকরি নিয়ে যখন টানাটানি, তখন অ্যালেগ্রি একটা বার্তাও হয়ত দিয়ে রাখলেন তাদের, রোনালদোর সেরাটা বের করে আনতে জানেন তিনিও।