লতার স্বপ্নপূরণের গল্প
পুরুষদের টুর্নামেন্টে খেলে মাত করে দেয়া একাধিক নারী ক্রিকেটারের নামই হয়তো ইতোমধ্যে শুনে গিয়ে থাকবেন। কেট ক্রস, সারাহ টেলরদের উদাহরণ উপমহাদেশীয় ক্রিকেটে তৈরি হওয়ার বোধকরি এখনও ঢের দেরী। তবে বঙ্গ মুলুকের অলি-গলি, পাড়া-মহল্লায় ছেলেদের দলে দুয়েকজন মেয়ে খেলোয়াড় খুব বিরল নয়। অবশ্য সমাজ-সংস্কারের বেড়াজালে এদের কারও পেশাদার পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানোর চিন্তাটা এখনও দুঃসাহসিক বৈকি। লতা মন্ডল তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক ব্যতিক্রমের নামই। মহল্লার ছেলেদের সাথেই খেলে ব্যাটে-বলে হাত পাকানো মোহাম্মদপুরের মেয়ে এখন বাংলাদেশ প্রমীলা ক্রিকেট দলের নিয়মিত ডানহাতি ব্যাটসম্যান, বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশী আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা তিন নারী ক্রিকেটারের একজনও তিনি।
ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহের শুরুটা শৈশবেই। বাড়ির পাশের মাঠে ছেলেদের খেলা দেখে লতারও ইচ্ছে হতো ব্যাট হাতে চার-ছয় হাঁকাতে। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে ইচ্ছেটা পূরণ করা হয়ে উঠছিল না। তবে জাতীয় দলের জার্সি উঠবে যার গায়ে তিনি আর লোকের ভয়ে লুকিয়ে থাকবেন কেন? একদিন সাহস করে নেমেই গেলেন মাঠে। আর ‘অভিষেক’-এই জানান দিলেন, ছেলেদের চেয়ে খুব একটা কম যান না তিনি।
সেই থেকে শুরু। একটু-আধটু করে নাম কুড়নোর সাথে সাথে বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক আসতে থাকে ‘খ্যাপ’ খেলার জন্যও। পরিবারের অনুমতি ছিল না বলে খেলাটা চালাতে হতো লুকিয়েই। একবার কেরানীগঞ্জের এক টুর্নামেন্ট থেকে ম্যাচসেরার পুরষ্কারও নিয়ে এসেছিলেন।
এলাকার এক বড় ভাইয়ের মাধ্যে পরিচয় হয় ইকবাল রোডের ক্রিকেট কোচ আলী হোসেন বাবুর সাথে। তাঁর দলে প্রথম মেয়ে প্রশিক্ষণার্থী হিসেবেই যোগ দেন। স্কুল টিফিনের টাকা জমিয়ে, হাত খরচ বাঁচিয়ে কিনে ফেলেন ক্রিকেট খেলার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু সরঞ্জামও।
সেখানে মাস দেড়েক কোচিংয়ের পর বাবু স্যারের হাত ধরেই পা রাখেন আবাহনী মাঠে। সেখান থেকে একটি-দুটি করে টুর্নামেন্ট খেলে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পান ২০০৮ সালে। লাল-সবুজ জার্সি গায়ে প্রথম মাঠে নামার সুযোগ পান ২০১১ সালে, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। পরের বছর মিরপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ে ম্যাচসেরা হন লতা। ওই ম্যাচে ৩১ রানের পর দ্বিতীয় ম্যাচেই তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতক।
এ পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ১৮টি একদিনের আন্তর্জাতিক ও ২৯টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি। প্রমীলা ক্রিক্কেটে বাংলাদেশের হয়ে দুটোই সর্বোচ্চসংখ্যক। দুই সংস্করণে তাঁর এই রেকর্ডের ভাগীদার কেবল দু’জন, সালমা খাতুন আর রুমানা আহমেদ।
পরিবারের অমতেই হাতে তুলে নিয়েছিলেন ব্যাট-বল। বলাই বাহুল্য, মতটা ইতিবাচকভাবেই বদলে দিয়েছেন লতা। বাবা-মা এখন গর্ব করেই বলে বেড়ান, তাঁদের মেয়ে জাতীয় দলের ক্রিকেটার। প্রিয় মানুষ দুটোর এই গর্বেই লতার তৃপ্তি, এটুকু প্রেরণা জ্ঞান করেই যেতে চান আরও বহুদূর।