• বাংলাদেশের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর
  • " />

     

    সাকিব যেভাবে সাকিব হলেন...

    সাকিব যেভাবে সাকিব হলেন...    

    মাশরুর রেজার মেজাজ একটু খারাপ আজ। অফিস থেকে ফিরে এসে শুনলেন, ছেলে বাসায় নেই। কোথায় যেন ক্রিকেট খেলতে গেছে, ফেরেনি এখনো। গজগজ করতে করতে স্ত্রী শিরিন আখতারকে বললেন, ‘এই খেলা খেলা করেই কিন্তু তোমার ছেলে গোল্লায় যাবে।’

    শিরিন আখতার একটু পর দেখলেন, পা টিপে টিপে ছেলে একটু পর ঢুকছে ঘরে। দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ‘তাড়াতাড়ি হাত পা ধুয়ে নিজের ঘরে পড়তে বসো। বাবা কিন্তু অনেক রেগে আছে।’ ফয়সালও ব্যাটটা এক পাশে লুকিয়ে সন্তর্পণে ঢুকছিলেন ঘরে। কিন্তু পড়বি তো পড় একেবারে মালির ঘাড়ে।

    -       কোথায় গিয়েছিলে

    -       এই তো বাবা একটু বাইরে।

    -       হাতে কী ওটা, দেখি?

    কী আর করা, ক্রিকেট ব্যাটটা এগিয়ে দিলেন ফয়সাল। মাশরুর রেজা বললেন, ‘এটা এখন আমার কাছে থাকবে, তুমি যাও।’

    সেবার ব্যাট আস্ত থাকলেও একবার এমনই রাগ হয়েছিল মাশরুর রেজার, ঠিকই ব্যাট কেটে ফেলেছিলেন। নিজে যে খেলাটেলা ভালোবাসতেন না, এমন নয়। ফুটবলটা ভালোই খেলতেন, ছেলেকেও মাঝেমধ্যেই নিয়ে যেতেন ফুটবল মাঠে। ফয়সাল মন্দ খেলত না, কিন্তু একটু বুদ্ধিসুদ্ধি হওয়ার পর থেকে ক্রিকেট বেশি খেলা শুরু করল। মাশরুর রেজা তাতে একটু নাখোশ হয়েছিলেন। খেলা তো ফুটবল, ক্রিকেট আবার কোনো খেলা নাকি? কিন্তু নিয়তি লেখা থাকে যার কপালে, তাঁকে খন্ডানোর সাধ্য কার?

     

    ফয়সাল বা আপনারা যাকে সাকিব আল হাসান নামে চেনেন, সেই ছেলেটা যে ক্রিকেটটা ভালো খেলে, সেটা মাগুরা শহরের ছোট্ট গন্ডির অনেকেই জেনে গেছে তখন। টেপ টেনিস দিয়েই খেলা হতো বেশি, সাকিবকে মাঝেমধ্যে হায়ারে খেলতেও নিয়ে যাওয়া হতো। এর মধ্যেই স্থানীয় কোচ আর আম্পায়ার সাদ্দাম হোসেন গোর্কি একদিন রাস্তা দিয়ে যেতে দেখলেন, বাঁহাতে ব্যাট করে একটা ছেলে একের পর এক চার-ছয় মারছে। ভাবলেন, এই ছেলেটাকে আরেকটু বাজিয়ে দেখা যাক। মাগুরা জেলা ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে অনুশীলনের সুযোগ করে দিলেন ফয়সালকে। শুরুতে ফয়সাল পেসই করত , কিন্তু একদিন হঠাৎ বাঁ হাতে স্পিন করা শুরু করল। দেখা গেল, পেসের চেয়েও সেটা ভালো হচ্ছে। পেসে আর ফিরে যেতে হয়নি তাকে।

    এর মধ্যে একদিন সাদ্দাম ঠিক করলেন, ইসলামপুর স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ফয়সালকে একদিন সুযোগ দেবেন। ইসলামপুর তখন মাগুরা জেলা লিগে অনূর্ধ্ব ১৫ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছিল। ফয়সাল প্রথম ক্রিকেট বল হাতে নিলেন, এবং প্রথম বলেই উইকেট। নিজের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট ম্যাচের শুরুটাই হলো ফয়সালের উইকেট দিয়ে।

     

    **

    বিকেএসপিতে আসার ঘটনাও একটু অন্যরকম। বাংলাদেশের এই বিশেষায়িত ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের ভর্তি করা হয় মূলত ক্লাস সেভেন থেকে। ফয়সাল একটা প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিতে বিকেএসপিতে গেলেন। সেখানকার কোচদের তাকে পছন্দ হলো, কিন্তু বছরের মাঝখানে সরাসরি ভর্তি করানোর তো উপায় নেই। ফয়সাল  ছয় মাসের জন্য ঢাকায় একটা প্রশিক্ষণে গেলেন। এর মধ্যে নতুন বছর চলে এলো, ফয়সালের ক্লাস এইট থেকে ভর্তি করানোর একটা সুযোগ এলো। বাবা তখনো স্বপ্ন দেখেন, ছেলে বড় হলে ডাক্তার-ইনিঞ্জিয়ার হবে। বিকেএসপিতে চলে গেলে তো খেলোয়াড় হওয়ারই সম্ভাবনা দেখে। আর মা ভাবছেন, ছেলে এই বয়সেই দূরে চলে যাবে। এইটুকুন ছেলে একা একা কীভাবে থাকবে? কিন্তু এলাকার কোচরা বোঝালেন, ছেলেটার মধ্যে কিছু একটা আছে। বিকেএসপির কোচ আশরাফুল ইসলাম বাপ্পি বললেন, ‘আংকেল ওকে আমাদের কাছে ছেড়ে দিন। ওর ক্রিকেটে ভবিষ্যত আছে।’ মাশরুর রেজা দেখলেন, ছেলেও যেতে চাইছে। সবকিছু চিন্তা করে রাজি হলেন। ফয়সাল থেকে সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠার হলো শুরু।

     

    **

    ছাত্র হিসেবে সাকিব কিন্তু মোটেই খারাপ ছিলেন না। মাগুরার স্কুলে বেশ ভালো করতেন। বিকেএসপিতে এসে ক্রিকেটেই সঁপে দিলেন মনপ্রাণ। কিন্তু পরীক্ষার আগে কয়েক ঘন্টা পড়েই বেশ ভালো করতেন। সাকিবের ভাষায়, তাঁর একটা ‘জাদুকরী’ ক্ষমতা ছিল। অল্প পড়েই কীভাবে যেন বুঝে ফেলতেন, পরীক্ষায় কোন প্রশ্নটা আসবে। বহু বছর পর মিরপুরে নিজের কনভেনশন সেন্টারে আড্ডা দেওয়ার সময় বিকেএসপির সেই দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিলেন সাকিব, ‘আমি কিন্তু খুব বেশি পড়াশোনা করতাম না। ইন্টারমিডিয়েটের মাত্র মাসখানেক আগে বই কিনেছিলাম। আমার রুমমেট ছিল রুহুল আমিন নামের একজন, ও আবার বেশ পড়ুয়া ছিল। সারা বছরেই বইয়ের ভেতর মুখ গুঁজে রাখত। শেষ পর্যন্ত যখন রেজাল্ট দিল্‌ তখন দেখা গেল মানবিকে আমি পেয়েছি ৩.৯। ও –ও পেয়েছে ৩.৯। আমাকে অবাক হয়ে বলল, ‘দোস্ত, দুই সারা বছর খেলাধূলা করলি, মজা করলি, দুষ্টুমি করলি, আবার ৩.৯ও পেয়ে গেলি। আর আমি পড়াশোনা করেও এটাই পেলাম। আমি তাহলে কী করলাম?’’

     বলতে বলতেই সাকিবের মুখে একগাল হাসি। মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, জিপিএ ফাইভের শুরুর দিকের ওই যুগে এই ফল মোটেই ফেলনা নয়। অথচ পরীক্ষার মাত্র ২৭ দিন আগে যখন বই কিমতে গিয়েছিলেন, দোকানদার বলেছিলেন এই বছরের বই কিনে আর কী করবেন? সাকিব বললেন, আমার পরীক্ষা এই বছরেই। অবাক দোকানদার পরামর্শ দিলেন গাইড বই কেনার। সাকিব মূল বই কিনেই এসেছিলেন। সেখানে থেকে দাগিয়ে যা পড়েছিলেন, পাশ তো বটেই, ভালো করার জন্যও তা যথেষ্ট ছিল। সাকিবের মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘আমার একটা ব্যাপার ছিল সাজেশন থেকে খুব ভালো কমন পড়ত। দেখা যেত আটটা পড়েছি, ছয়টাই সেখান থেকে এসেছে। এমনও হয়েছে, ছয়টা প্রশ্ন পড়েছি ছয়টাই এসেছে। আমি আগে যা করতাম আগের চার পাঁচ বছরের প্রশ্ন নিয়ে সেটা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতাম। তার পর নিজের মতো করে একটা সাজেশন বানাতাম। দেখা যেত ওখান থেকেই কমন পড়ে গেছে।’

    এই সাজেশন নিয়েই আরেকটা মজার গল্প শোনালেন, ‘একবার একটা পরীক্ষার খাতা পেয়েই আমি আরেকটা পরীক্ষার উত্তর লিখতে শুরু করে দিলাম। পাশেই এক ম্যাডাম দাঁড়ানো ছিলেন, তিনি বললেন, ‘তুমি এখনই এটা লিখছ কেন?’ আমি বললাম, ‘কালকের পরীক্ষায় এই প্রশ্ন আসবেই, সেটা তাই লিখে একটু হাতের লেখা প্র্যাকটিস করে নিচ্ছি।’ উনি বললেন, ‘তুমি এতো নিশ্চিত হলে কীভাবে?’ আমি বললাম, ‘ম্যাডাম, আমি জানি এই প্রশ্ন আসবেই।’

    ‘পরের দিন সেই পরীক্ষার সময় খাতা পেয়েই আমি আগের উত্তরটা লিখতে শুরু করে দিলাম। ওই ম্যাডাম ওই দিন ছিলেন অন্য রুমের গার্ডে, কিন্তু প্রশ্ন দেওয়ার পর আমার রুমে চলে এলেন। প্রশ্নটা খুলে দেখি, আমি যে উত্তরটা লেখা শুরু করেছিলাম, এক নম্বরেই আছে ওই প্রশ্ন।’ সাকিবের কথায় বোঝা গেল, ক্রিকেটার হিসেবে যেমন, ছাত্র হিসেবেও ছিলেন ততটা কার্যকর। নিজের সামর্থ্যের চেয়ে ফলে তাই থাকত একটু বেশিই প্রতিফলন। তার চেয়েও বড় ব্যাপার সম্ভবত নিজের ওপর অটুট আত্মবিশ্বাস। খাতা পাওয়ার আগেই যেমন প্রশ্ন লিখতে পারতেন, মাঠে নামার সময়েই তাই জানেন দিনটা তাঁর হবে। সামর্থ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহারের এই গুণটা তাঁর আসলেই জন্মগত।

     

    কিন্তু বিকেএসপিতে মাঠের শুরুর সময়টা খুব যে ভালো কাটছিল, তা নয়। বিকেএসপিতে একটা টুর্নামেন্টের জন্য চারটি দল করা হলো, কিন্তু সেখানে সুযোগ পেলেন না সাকিব। পরবর্তীতে সাকিবের গুরু হিসেবে পরিচিত কোচ সালাহউদ্দিন তখন কাজ করছেন বিকেএসপিতে। মজার ব্যাপার, সাকিবকে বিকেএসপি আসার আগেই মাগুরায় এক টুর্নামেন্টে গিয়ে দেখেছিলেন। তো সেই দলে সাকিবের নাম না দেখে তিনি বেশ বিস্মিত। একটা দলে কোচ ছিলেন সালাহউদ্দিনের বন্ধু, হাফিজুর রহমান লিটু। সালাহউদ্দিন তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, ‘এই ছেলেটা ভালো করবে। ওকে একটা দলে নিয়ে নাও’। সাকিব সুযোগ পেলেন, ফিফটি করে কোচের মান রাখলেন।

    সাকিব প্রথম বড় সুযোগ পেলেন অনূর্ধ্ব ১৫ ক্রিকেটে। আগে দিতে হলো বাছাইপর্বের পরীক্ষা। সেই দলেও তার নাম ছিল না শুরুতে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একজন ক্রিকেটার ছিটকে পড়ল, সাকিব সুযোগ পেয়ে গেলেন। ১৫ বলে করলেন সেঞ্চুরি, সুযোগ হয়ে গেল বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৫ দলে।বয়সভিত্তিক এই দলে সাকিবদের কোচ ছিলেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। ভারতে একবার একটা টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিলেন সাকিবরা। সেই স্মৃতি ভোলেননি এই কোচ, ‘’সেবার পশ্চিম বাংলার অনূর্ধ্ব ১৫ দলের সঙ্গে একটা ম্যাচ ছিল কল্যাণীর মাঠে। সেই পিচ ছিল একদম নতুন। আমাদের ব্যাটসম্যানরা নেমেই দ্রুত আউট হয়ে যাচ্ছি। সাকিব এসে ৬৯ রান করে দলকে জেতাল। ওই সফরে ঘটনাটা নিয়মিত হয়ে গিয়েছিল। দল বিপদে পড়বে, আর সাকিব এসে মান বাঁচাবে.। সে সময় নাজমুল আবেদীনের কাছে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল আপনার দলের সেরা ব্যাটসম্যান কে? উত্তর দিলেন, সাকিব? বোলার? সাকিব। ফিল্ডার? এবারও নাজমুল আবেদীনের উত্তর একই। বলেছিলেন, ‘হতে পারে সাকিব আমার ছাত্রদের মধ্যে টেকনিক্যালি সবচেয়ে নিখুঁতদের একজন নয়। তবে প্যাকেজ হিসেব করলে সে অবশ্যই সবার ওপরে।’

     

    (লেখাটি প্যাভিলিয়ন সম্পাদক অম্লান মোসতাকিম হোসেনের বই 'নায়কদের নেপথ্যের' অংশবিশেষ। অনলাইনে অর্ডার দেওয়া যাবে এখানে  বা এখানে)