মোস্তাফিজের বোলিংয়ের একাল সেকাল
২০১৫ থেকে ২০২২। মাত্র সাত বছরের ব্যবধান। তবে মোস্তাফিজুর রহমানের জন্য সময়টা বেশ দীর্ঘই বটে। অম্ল মধুর অভিজ্ঞতার সবটুকুই পেয়ে গেছেন এই ক'বছরে। শুরুর সাফল্যটাই কাল হয়েছে যেন। একটু অফ ফর্মে গেলেই মোস্তাফিজকে শুনতে হচ্ছে তার হারিয়ে যাওয়ার গান। এক অর্থে কথাটা সত্যিই। বোলিং অ্যাকশনের তুলনায় গেলে এখনকার মোস্তাফিজের সঙ্গে আগের মোস্তাফিজের বিস্তর ফারাক।
সাধারণ ধারণা বোলি অনুযায়ী বোলিং টেকনিককে ভাগ করা যায় চার ভাগে; সাইড-অন, চেস্ট-অন, মিড-ওয়ে ও মিক্সড। সেদিক থেকে মোস্তাফিজকে বলা যায় সেমি সাইড-অন বা মিড-ওয়ে বোলার। তবে ক্যারিয়ারের শুরুতে মোস্তাফিজ অনেকটাই মিশ্র অ্যাকশনের বোলার ছিলেন এ কারণে নিতম্ব ও বাহুর কৌণিক বিভাজনের মাত্রাটাও বেশি ছিল। ডেলিভারি স্ট্রাইডে পেছনের পা মাটি স্পর্শ করার সময় কাঁধ বন্ধ থাকলেও কোমরের নিচের অংশ উন্মুক্ত হয়ে যেত আগেই। কৌণিক বিভাজন কী? ব্যাক ফুট কন্টাক্টে কাঁধ ও কোমরের নিচের অংশের মধ্যবর্তী ব্যবধানকেই বলা হয় কৌণিক বিভাজন বা সেপারেশন অ্যাংগেল।
এর ফলে ল্যান্ডিংয়ের সময় ফ্রন্ট ফুট অর্থাৎ সামনের পা বেঁকে যেত ফাইন লেগের দিকে। শরীরও হেলে পড়ত ডানদিকে।মেরুদণ্ডের নিম্নাংশের অস্থি আর পেটের ডান পাশের পেশিগুলোতে প্রচণ্ড চাপ পড়ত। ২০১৬ সালের এশিয়া কাপে এই বোলিং অ্যাকশনের জন্যই সাইড স্ট্রেইন ইনজুরিতে পড়েছিলেন মোস্তাফিজ। সেবারের আসরে খেলতে পারেননি শেষ ২ ম্যাচ। অবশ্য মোস্তাফিজকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে তার কাঁধের চোট। কাঁধের ইনজুরিতে পড়ে সাসেক্সের হয়ে কাউন্টিতে দুই ম্যাচ খেলেই দেশে ফিরতে হয় তাকে। চিড় ধরা পড়ে সুপিরিয়র ল্যাব্রাম পেশিতে।
এর নেপথ্যে দায়ী হাইপারলর্ডোসিস। হাইপারলর্ডোসিস কী? মেরুদণ্ডের নিম্নাংশের হাড় অতিরিক্ত বেঁকে যাওয়াই হাইপারলর্ডোসিস। মোস্তাফিজও ভুগেছেন এই সমস্যায়। কারণ বল ডেলিভারির সময় মোস্তাফিজের বাঁ হাতটা চলে যেত উইকেটের সাথে খাড়া অবস্থানে থাকা রেখার ডানে। এর সাথে উল্টো দিকে বাঁকানো কাঁধ অর্থাৎ হাইপার এক্সটেন্ডেড আর্মের জোরে বেশি গতিতে বল করতে চাওয়া প্রবণতা। সব মিলিয়ে ইনজুরিতে পড়াটা মোস্তাফিজের অবশ্যম্ভাবীই ছিল।
সাসেক্স থেকে ফিরে ছয় মাসের জন্য মাঠের বাইরে ছিলেন মোস্তাফিজ। প্রত্যাবর্তনের পর কাজ করেছেন বাহুর রোটেশন/ঘুর্ণন নিয়ে। বল রিলিজের সময় হাতটাকে উইকেটের সোজা বরাবর রেখার বাঁয়ে রাখাই যার মূল উদ্দেশ্য। সেই পরিকল্পনামাফিক নতুন বোলিং অ্যাকশন নিয়ে মাঠে ফিরেছেন মোস্তাফিজ। বোলিংয়ে নতুনত্ব যোগ করতে নতুন অ্যাকশনের ঢের সাহায্যও পেয়েছেন। পুরনো অ্যাকশনে আউটসুইং আদায় করা এক প্রকার অসম্ভবই ছিল। তবে বদলানো অ্যাকশনের কারণে নতুন বলে আউটসুইংও পাচ্ছেন অহরহ। ব্যাক অব দ্য হ্যান্ডে স্লোয়ারও করতে পারছেন স্বাচ্ছন্দ্যে।
অবশ্য কাঁধের চেয়ে পিঠের চোটই বেশি ভোগায় পেসারদের। তাই পিঠ বাঁচিয়ে খেলতে ল্যান্ডিং নিয়েও কাজ করেছেন মোস্তাফিজ। বদলানো ল্যান্ডিংয়ে ডেলিভারির সময় মোস্তাফিজের ফ্রন্টফুট অর্থাৎ ডান পা তাক করা থাকছে ব্যাটসম্যান বরবার।আগের অ্যাকশনে ফ্রন্ট ফুট থাকত ফাইন লেগ বরাবর। তাই ডানে হেলে পড়ার পরিবর্তে নিজেকে আরও সোজা রাখতে পারছেন তিনি। এতে করে পিঠ ও পেটের পেশিতে কম চাপ পড়ছে। ল্যান্ডিংয়ে সামনের পায়ের নিশানা ঠিক হয়েছে, মেরুদণ্ডটাও বাঁকছে না আগের মতো, ইনজুরির শঙ্কাও অনেকটাই কমে গেছে।
চাইলে অবশ্য খুঁত ধরা যাবে বর্তমান অ্যাকশনেও। যদিও নতুন অ্যাকশনেই এবার আইপিএলে মোস্তাফিজ গতি তুলেছেন বেশ। তবে রান-আপ থেকে তৈরি হওয়া ভরবেগটা এখনো। পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছেন না মোস্তাফিজ। ডেলিভারির সময় ব্যাক-ফুট কন্ট্যাক্টে কাটিয়ে ফেলছেন ভগ্নাংশ সময় বেশি। এই সময়টুকু কমিয়ে আনতে পারলে রান আপের রৈখিক গতিকে আরও দ্রুত কৌণিক গতিতে রুপান্তরিত করতে পারবেন তিনি। চাইলে আদর্শ হিসেবে নিতে পারেন শাহীন শাহ আফ্রিদি, জশ হ্যাজলউডদের। গতি বাড়ানোর টোটকা হিসেবে এই পেসাররা বেছে নিয়েছেন এই পদ্ধতি।
এর আগে অবশ্য মোস্তাফিজের ডানহাত নিয়ে কাজ করা জরুরি। বায়োমেকানিক্স বলছে বোলিংয়ের সময় নন-বোলিং আর্ম রাডারের মতো কাজ করে।বোলিংয়ের লাইন-লেংথ ঠিক করে দেয়ার নেপথ্যে অবদান আছে নন-বোলিং আর্মেরও। একারণেই নন বোলিং আর্মের ঘূর্ণন শরীরের ঠিক পাশে এসে শেষ হওয়া জরুরি।
মোস্তাফিজের ক্ষেত্রে সেটা পুরোপুরি হচ্ছে না। খেয়াল করলে দেখবেন, ডেলিভারির সময় তার ডান হাতটা শরীর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।ডান হাত শরীর থেকে দূরে সরে যাওয়ায় শরীরের সেপাশ থেকে বোলিংয়ে কোনো গতিও পাচ্ছেন না। ব্যাটারের দিকে যাওয়ার পরিবর্তে ডান পাশের ভরবেগ স্থানান্তরিত হয়ে যাচ্ছে পার্শ্বীয় দিকে।
যে কাটার দিয়ে মোস্তাফিজ বিখ্যাত হয়েছিলেন, সেই কাটার করাও দুরূহ এখনকার অ্যাকশনে। তবে তার কাটারের জাদু কমেনি এখনো। আমাদের আগের ভিডিওটা দেখে থাকলে এর নেপথ্যে মোস্তাফিজের ম্যাজিক ফর্মুলাটা জানেন আপনিও।