• দক্ষিণ আফ্রিকা-ইংল্যান্ড
  • " />

     

    ইংলিশ ক্রিকেটের অন্য দাড়িওয়ালা

    ইংলিশ ক্রিকেটের অন্য দাড়িওয়ালা    

    ওভালে প্রথম টেস্ট। ইংল্যান্ডে প্রথম টেস্ট। অভিষেক হলো ইংলিশ ক্রিকেটের এক বিখ্যাত দাড়িওয়ালার। ডব্লিউ জি গ্রেস, ইংলিশ সাম্রাজ্যের প্রতীক। অস্ট্রেলিয়ার দেয়া রানটা যখন টপকে যাচ্ছে ইংল্যান্ড, ক্রিজে তখন ডব্লিউজি। 

    ওভালে শততম টেস্ট, কতশত স্মৃতির ধারক তা। ঠাঁই দাঁড়িয়ে এখনও ওই গ্যাসোমিটার। কিন্তু সে মুহুর্তে, সবার দৃষ্টি ওভালের জায়ান্ট স্ক্রিনের দিকে। বোলারের, ব্যাটসম্যানের, ফিল্ডারদের, আম্পায়ারদের, দর্শকের। জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠছে বল ট্র্যাকিং, উইকেটে গিয়ে লাগতো বলটা। ইংল্যান্ড জিতে গেছে, ওভাল দেখেছে প্রথম হ্যাটট্রিক। জনি বেয়ারস্টো তুলে ধরেছেন সেই বোলারকে, উপরের দিকে। তাকে ঘিরে উদযাপনে মত্ত গোটা ইংলিশ দল। সেই বোলারের মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। সেই বোলারের মুখে দাড়ি, লম্বা দাড়ি। ডব্লিউ জি গ্রেসের মতোই কিছুটা। 

    কিন্তু এই দাড়িওয়ালা ভিন্ন। মইন আলি ইংলিশ সাম্রাজ্যের প্রতীক নন। তিনি বহুজাতিক, বহু-সাংস্কৃতিক এক ইংল্যান্ডের প্রতীক! 

    ****

    বার্মিংহামের জঙ্গলে তখনও বিষণ্ণতা। দশ মাইল হেঁটে হয়তো খাবারের জন্য যেতে হয় তাকে, কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায়। এ দেশেই জন্ম তার, তার মা ছিলেন এ শহরেরই। কিন্তু জন্মের পরই তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় বাবার কোনও এক আত্মীয়ের কাছে, আজাদ কাশ্মীরের দাদ্যালে। ১১ বছর বয়সে ফিরে এলেন, স্কুলে গিয়ে একটা ইংরেজি-শব্দ পর্যন্ত পারেন না! সংখ্যালঘু বলে রোষানলে পড়তে হয়, দুয়ো শুনতে হয়। ১৫ বছর বয়সে বিচ্ছেদ হয়ে গেল বাবা-মায়ের, তার ঠাঁই জুটলো এক চাচার কাছে। সেরকম এক সময়েই মুনির প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কোনোদিন যদি ছেলে-মেয়ে হয়, সব ভালবাসা, সব নিরাপত্তার আশ্বাস তিনি দেবেন তাদের। তারা যেন একা না হয়ে যায়, ভরা মজলিসে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে। 

    মইন আলিরা বিচ্ছিন্ন হননি। পরিবারের ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হননি। বরং মইন যে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন, মইন যে ক্রিকেটার, মইন যে ওভালে ইতিহাস গড়েন, তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ওই মুনিরের। মইনের বাবার। ছেলের কাছ থেকে গাড়ি উপহার পেয়ে হয়তো তার মনে পড়ে যায় সেই সেদিনের স্যান্ডউইচের কথা! 


    সমারসেটে একটা ট্রায়াল ম্যাচ আছে মইনের। পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে চষে ফেলেছেন মুনির। যাওয়া আসার পেট্রোল, মইনের দুপুরের লাঞ্চের টাকা জোগাড় করতে হবে। টেনেটুনে ব্যবস্থা হলো, মইনকে নিয়ে টন্টনে চললেন মুনির। লাঞ্চের সময় মইন নিজের স্যান্ডউইচটা আনলেন, বাবার সঙ্গে ভাগাভাগি করবেন বলে। ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর জন্য কী না করা মুনিরেরও তখন যেন মনে হয়, ক্রিকেটার না হোক, একজন অন্যরকমের ভাল ছেলে পেয়েছেন তিনি। 

    মুনিরদের পরিবারটাও ছিল অন্যরকম। বলা যায় যৌথ পরিবার। তার জমজ ভাই, ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেটার কবির আলির বাবা। দুজন বিয়ে করেছেন দুই বোনকে, থাকেন পাশাপাশি। অনেক কষ্টে ছেলেদের জন্য বাড়ির বাগানে নেটের ব্যবস্থা করেছিলেন। মইনের ভাই কাদির পড়াশুনায় ভাল ছিলেন। হয়তো তার জন্য বাড়তি কিছু টাকা লাগবে, ব্যবস্থা হয়ে গেল। হয়তো মইনের ক্রিকেট-কোচিংয়ের জন্য লাগবে কিছু। ব্যবস্থা হয়ে গেল সেটারও। খুব অল্প বয়সে স্ট্রোক করেছিলেন মুনির, অনেক কষ্টে পাওয়া সাইকিয়াট্রিক নার্সের চাকরিটাও খুইয়েছিলেন। সেই তিনি আর তার স্ত্রী মিলে এতোকিছু কিভাবে ব্যবস্থা করতেন, মইনের কাছে আজও সেটা বিস্ময়।  

    বাবার সঙ্গে মইন

    **** 

    স্পার্কহিল। বার্মিংহামের শহরটা কৃষিনির্ভরই ছিল উনবিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত। শিল্পায়নে যেন বিপ্লব ঘটে গেল এরপর। বসতি গড়ে উঠলো, মূলত কারখানার শ্রমিকদের জন্য। স্কুল, ফায়ার সার্ভিস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমা হামলার শিকার হলো সেটা, গড়ে উঠলো নতুন করে। আসতে শুরু করলো অভিবাসীরা। প্রথমে আইরিশ, তারপর ক্যারিবিয়ানরা। সবার শেষে দক্ষিণ এশিয়ানরা। বিচিত্র রঙের, ধর্মের, গোত্রের, ভাষার সব মানুষ। মইন তাদের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন। আর গড়ে উঠেছেন স্পার্কহিল পার্কে। যেখানে হতো তাদের অ্যাশেজ, যেখানে মইন আলি হয়ে উঠতেন একজন মার্কাস ট্রেসকোথিক বা সাইদ আনোয়ার। যেখানে জীবনকে খুঁজে পেতেন তিনি।

    স্কুলের আগে খেলতেন, স্কুলের সময় খেলতেন, স্কুলের পর খেলতেন। খেলতেন চারদিক আঁধার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। ক্রিকেট মইনের জীবনের অংশ ছিল না, মইনের জীবনটাই ছিল ক্রিকেট। ছিল আর সবকিছু থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার উপায়। বাবার জন্য যেমন ক্রিকেট ছিল জীবনটা একটু ভাল করার মাধ্যম। বাবার ক্রিকেটপ্রেম মইনের কাছে এসে পড়েছিল। তার কতো বন্ধু ঝড়ে পড়লো, ড্রাগে জড়িয়ে পড়লো, গ্যাংদের সঙ্গে মিশিয়ে ফেললো নিজেদের। মইন ক্রিকেটার না হলেও সেসব হতে চাইতেন না, কিন্তু জোর গলায় বলতে পারেন না, তেমন কিছু হতেন না! তবে জোর গলায় বলতে পারেন, ক্রিকেট তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, ক্রিকেট তাকে জীবন দেখিয়েছে। তার জীবনের যে পাথেয়, নিজ ধর্ম, মইন সেটাও খুঁজে পেয়েছেন ক্রিকেট দিয়েই! 

    ****

    জুন, ২০০১। ১৪তম জন্মদিনের চারদিন পর, মোশলি অ্যাশফিল্ড ক্রিকেট ক্লাব অনূর্ধ্ব-১৫ দলের এক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে করলো ২৩৬। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ১১, মইনের রান ১৯৫। আরেক ম্যাচে নেমেছিলেন ১১তম ওভারের পর, বাকি ৯ ওভারেই মইনের রান হয়ে গেল ১৩০। ওয়ারউইকশায়ারে ট্রায়ালের জন্য ডাক পেলেন, একজোড়া প্যাড ধার করতে হলো তাকে। যা নাকি উঠে আসতো কোমর পর্যন্ত। সেই অস্বাভাবিক প্যাডজোড়ার মাঝেও কাউন্টি কর্তৃপক্ষ ঠিকই খুঁজে পেলেন মইনের মেধাকে। 

    ১৫ বছর বয়সেই পূর্ণমেয়াদের চুক্তিও করে ফেললেন। স্কুল তখন জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। ১৮ বছর বয়সে অভিষেক হয়ে গেল প্রথম শ্রেণিতে। কিন্তু ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে সম্পর্কটা টিকলো না। প্রথম ম্যাচে ফিফটি করলেও বাদ পড়লেন পরের ম্যাচে। তিনি নাকি আলগা শট বেশি খেলেন। চ্যাম্পিয়নশিপ অভিষেকেও দলকে উদ্ধার করলেন ৬৮ রানের ক্ল্যাসিক ইনিংস খেলে, বাদ পড়লেন আবার। তখনকার কোচ বলেছিলেন, ‘পাঁচ বছর’ সময়ের মাঝেই মইন দলে নিয়মিত হয়ে যাবেন। পাঁচ বছর মইনের জন্য লম্বা সময়, এজবাস্টনে ততোদিন অপেক্ষা করলেন না তাই। অবশ্য আলি পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটাও যেন ঠিক ব্যাটে বলে হচ্ছিল না ওয়ারউইকশায়ারের। কবির আলি যুব দলে খেলেছিলেন, ৫০০ পাউন্ডের একটা বরাদ্দ চেয়েও পাননি তিনি। মইনের বাবা মুনির সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য নেটের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেখানে অল্প খরচে ক্রিকেট শেখাতেন। ক্লাব তুলে নিল সেটাও। মইন খুঁজতে শুরু করলেন নতুন ঠিকানা। 

    ওয়ারউইকশায়ারের সেই অবস্থা অবশ্য বদলে গেছে এখন। এজবাস্টনের প্রধান চত্বরেই এখন পার্ক লিগের ফাইনাল হয়। যে লিগে খেলা ক্রিকেটারদের বেশিরভাগই এশিয়ান। কবির থাকেন কোচ। মইন খেলা দেখতে যান নিয়মিতই। জনপ্রিয়, দর্শকপ্রিয় অতিথি হয়ে।  


    **** 

    নিউ রোড। উরসস্টারশায়ারের ঘরের মাঠ। মইন আলির নতুন ঘর। ওয়ারউইকশায়ার ছেড়ে এলেন মানে প্রথম বিভাগের দল ছাড়লেন। তবে মইনের দরকার ছিল নতুন একটা শুরুর। খুঁজে পাওয়া ইসলামকে আরও বেশী আঁকড়ে ধরার একটা সুযোগ করে নেয়া। উরসরা মইনকে সে ব্যবস্থা করে দিল। 

    তখন তাদের স্পন্সর একটা মদের কোম্পানি। মইনের জন্য বানানো হলো আলাদা শার্ট। যেখানে সে কোম্পানির লোগো নেই। একটা ছোট ছেলে এসে বেশি বেতন পাচ্ছে, আলাদা কিট বানানো হচ্ছে তার জন্য, সিনিয়রদের ভ্রু যে কোঁচকাতো না, সেটা নয়। তবে তারা মেনে নিয়েছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন, মইন এসবের যোগ্য। ওয়ারউইকশায়ারে ইয়ান বেলকে ফেলে এসেছিলেন মইন, যাকে সম্মান করেন অনেক, নিজের খেলার ওপর তার প্রভাবকেও দেখেন, যার ব্যাটিং দিনভর দেখতে রাজি তিনি। এখানে এসে পেলেন গ্রায়েম হিককে। ড্রেসিংরুমে নামাজের জায়গা খুঁজছিলেন একদিন, হিক নিজের কিটব্যাগ সরিয়ে তা করে দিলেন। 

    'জ্বলে ওঠার সুযোগ'! 

     

    মইন হয়ে উঠলেন উরসাস্টারশায়ারের ঘরের ছেলে, ধীরে ধীরে। ওয়ানডেতে ওপেনিং, চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচে তিন নম্বর। সঙ্গে টুকটাক বোলিং। ইংল্যান্ড লায়ন্সে ডাক পেয়ে গেলেন। নির্বাচকরা আলাদা করে বলতেন, বোলিংয়ের দিকে নজর দিতে। আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় অবশ্য একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিলেন না মইন, ২০০৪ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেছিলেন অ্যালেস্টার কুক, রবি বোপারা, স্টিভ ডেভিসদের সঙ্গে, ১৭ বছর বয়সে। মইন লায়ন্সদের হয়ে খেলছেন, সেই তিনজনেরই ততোদিনে অভিষেক হয়ে গেছে ইংল্যান্ডের হয়ে। মইনের মনে হতো, ‘হয়তো কী অসাধারণ অনুভূতিই হয়েছে তাদের!’ 

    সে অনুভূতি কড়া নাড়লো মইনের দরজাতেও। গ্রায়েম সোয়ানের জায়গাটা পূরণ করার চাপ আগে থেকেই। ওয়ানডে অভিষেকে ওপেনিংয়ে নামলেন, স্পিনার হিসেবে ছিলেন জেমস ট্রেডওয়েল। বোলিং ওপেনিং করেছিলেন আবার জো রুট! টেস্টে মইন খেললেন প্রধান স্পিনার হিসেবেই। ইংল্যান্ড দলে এক অদ্ভূত চক্র শুরু হয়ে গেল যেন। মইনের ‘রোল’ নিয়ে। তিনি আদতে অলরাউন্ডার, নাকি ব্যাটসম্যান-পার্ট টাইম স্পিনার, নাকি প্রধান স্পিনার! অথবা দ্বিতীয় স্পিনার। 

    ****

    এক থেকে নয়, নয়টি পজিশনেই ব্যাট করেছেন মইন। এক থেকে নয়। সবচেয়ে বেশী আটে, ২১ বার। গড় ২৬, ক্যারিয়ার গড় ৩৪। সাতের পারফরম্যান্স সবচেয়ে ভাল, ১৪ ইনিংসে গড় ৬৮.৫৬, ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ইনিংসও সে পজিশনেই। চার নম্বরে নেমেছেন ৫ বার, গড় ৫১। তবে নিজের প্রিয় পজিশন পাঁচ, সাতবার ব্যাট করে সেখানে গড় অবশ্য ত্রিশের ওপরে। বাংলাদেশের সঙ্গে চট্টগ্রাম টেস্টে ম্যাচ বাঁচানো ইনিংসটা খেলেছিলেন এ পজিশনেই। এরপর ভারতে গিয়েও সেখানেই খেলার কথা ছিল, তবে খেলেছেন তিন ইনিংস। একটা সেঞ্চুরিও করেছেন। এরপর চারে উঠেছেন, খেলেছেন তিনেও। তারও আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অ্যালেস্টার কুকের ওপেনিং সঙ্গীও ছিলেন। 

    মধ্যমণি মইন

     

    দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে চলতি সিরিজে নেমে গেছেন আটে। এরকম পজিশনে খেলার দুই দিকটাই দেখেন তিনি। ইচ্ছামতো খেলতে পারেন, আবার একটু বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে খেলতে হয় বলে নড়বড়েও হয়ে যান। 

    নড়বড়ে তার বোলিং রোলটাও। লর্ডস টেস্টে তার অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের পরও বলা হয়েছিল, তিনি ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় স্পিনারই। ওভালেও তিনি খেললেন যেন দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবেই। কিন্তু ছিল না কোনও প্রথম স্পিনার! দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সিরিজে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৮টি উইকেট তার। ওভাল টেস্টেও বল করতে এসেছেন সবার শেষেই। তার মতে, খুব একটা ভাল বোলিং করেননি সেখানে, হ্যাটট্রিকের তিনটি বল ছাড়া। তার সবসময়ই মনে হয়, উইকেট নেয়ার মতো বোলিং তিনি করতে পারেন, কিন্তু নিজেকে প্রধান স্পিনার হিসেবে দেখার কোনও ইচ্ছাই তার নেই। 
     

    এ সিরিজের পর তার সে ইচ্ছাটা কি বদলাবে? নিশ্চিত হবে কি তার ‘রোল’টা? 


    **** 

    দলে ‘রোল’টা বদলায় তার। কিন্তু মইন আলি সবসময় হতে চান একজন ‘রোল-মডেল’। বার্মিংহামের সেই ছোট্ট শহরে, অথবা ইংল্যান্ডের যে কোনও জায়গার, যে কোনও ক্ষুদ্র গোষ্ঠি বা ধর্মাবলম্বী বা বর্ণের কোনো শিশুর কাছে তিনি বার্তাটা পৌঁছে দিতে চান, ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা সম্ভব। তার কাছে এটা দায়িত্ব মনে হয়। অনেকেই নাকি এসে তাকে প্রশ্ন করেন, এমন জায়গায় খেললে নিজের প্রার্থনাটা ঠিকঠাক করা কতোটা কঠিন! মইন তাদেরকে বলে দেন, কঠিন তো নয়ই, বরং অনেক সহজ। যখন প্রার্থনার সময়, তখন তিনি তা ঠিক করে নেন।

    নিজের দাড়িটাকে একটা ‘লেবেল’ হিসেবে তুলে ধরতে চান মইন। বৃটিশ-মুসলিম পরিচয়টা মেলে ধরতে চান। অভিষেক টেস্টের আগেও বলেছিলেন, একটা বিশেষ গোষ্ঠির প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। সমালোচনার রবও উঠে গেল। টেলিগ্রাফে মাইক হ্যান্ডারসন কলাম লিখলেন, ‘তুমি ইংল্যান্ডের জন্য খেলছো মইন, ধর্মের জন্য নয়!’ 

    মইনের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। তার পরিবারও নাকি এ নিয়ে বিরক্ত নয় মোটেও। তার কথা তিনি বলেছেন, মইনের কথা মইন। 'সিংহের কি আর ভেড়ার কথা শুনে মত বদলানোর দরকার আছে!' 

    রোল-মডেল! 

    শুধু সে কলাম নয়, মইন দুয়োও শুনেছেন মাঠে, এজবাস্টনে কিছু ভারতীয় ব্রিটিশের কাছে। অথচ মইন সেখানকার ঘরের ছেলে, খেলছেন নিজ দেশের হয়ে। তবুও দুয়ো কেন, সেটা অবশ্য তার বোধগম্য নয়। যেমন বোধগম্য নয়, ছোটবেলায় সেই লোকটা গাড়ি নিয়ে কেন ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন তাকে! রাস্তার একপাশে পড়ে আছে গাড়িটা, একপাশে পড়ে থাকা মইন কাতরাচ্ছেন। রক্ত ঝরছে পা থেকে। বাবা মুনির খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন, ঘটনা বুঝতে পেরে মারতে শুরু করেছিলেন সেই গাড়িচালককে। লোকজন এসে আটকিয়েছিল তাকে, পরে পুলিশ এসে অভিযোগ নিয়ে গিয়েছিল। বাবাকে কোনোদিন এতো রাগ করতে দেখেননি মইন। মইনকে সে লোক বোধহয় ভেবেছিলেন ‘সাদা-গোত্রীয়’ কেউ, ফর্সা চেহারা দেখে! হয়তো কোনও রাগ ছিল তাদের ওপর! বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন মইন, যেভাবেই হোক! 

    মইন আলোচনা তুলেছিলেন এক টেস্টে ‘সেভ গাজা, সেভ প্যালেস্টাইন’ লেখা রিস্টব্যান্ড পরেও। পরেছিলেন নেহায়েতই মানবতার খাতিরে। আইসিসি যখন সেটা নিষিদ্ধ করলো, খুলেও রেখেছিলেন। তার মনে হয়েছিল, মানবতাবিরোধী যেসব কাজ গাজা বা ফিলিস্তিনে হচ্ছে, সেজন্য কিছু একটা করা দরকার। তবে সেটা এতো আলোচনা ফেলে দেবে, সেটা ভাবেননি। মইনের ‘ক্ষুদ্র’ সামর্থ্য অবশ্য কাজে দিয়েছিল একটু হলেও। ইংল্যান্ড ড্রেসিংরুমে এক সতীর্থ এতো আলোচনা শুনে মইনকে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এই গাজা লোকটা কে, বলো তো!’ 

    **** 

    শুনে মনে হতে পারে, মইন বোধহয় একটা ‘ধার্মিক’ পরিবারেই বেড়ে উঠেছেন, ছোট থেকে চর্চা করে এসেছেন। আদতে তা নয়। কিভাবে নামাজ পড়তে হয় বা অজু করতে হয়, তিনি জানতেনই না সেসব! হয়তো কোনো সফরে, বাসের জানালা দিয়ে উঁকি দেয়া আকাশটা দেখে কেমন বিমগ্ন হয়ে যেতেন। প্রশ্ন উঠতো, এই যে এতো কিছু, নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে, একটা উদ্দেশ্য আছে। ইসলামকে মইন এভাবেই খুঁজে পেয়েছিলেন। ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলার সময় দর্শকসারিতে খুঁজে পেয়েছিলেন সদ্য মুসলিম হওয়া এক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানকে, যিনি জবাব দিয়েছিলেন অনেক প্রশ্নের। 

    ক্রিকেট মইনকে বেঁচে থাকার উপায়টা দেখিয়েছিল। ইসলাম মইনকে বেঁচে থাকার উদ্দ্যেশ্যটা যেন দেখিয়ে দিল। এখন তার কাছে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাই সব। যদি ইংল্যান্ডের হয়ে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার এখনই থমকে যায়, তাতে তার কিছু যায় আসে না। একটা ম্যাচ খেলতে পারলেও নাকি তিনি সন্তুষ্টই থাকতেন! ক্রিকেটে এখন প্রতিদিনই তার কাছে স্রেফ ‘বোনাস’! 

    'দ্য বিয়ারড দ্যাটস ফিয়ারড'!

     

    নিজের ধর্ম-পরিচয় নিয়ে দুয়ো শুনুন, তাতে কিছু যায় আসে না তার। নিজের পরিচয় নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন না, বরং এসব তাকে সাহায্য করে, ‘এটা বোঝা নয়। যেটাই হোক, এটা আমাকে সাহায্য করে। ক্রিকেটকে একদিকে সরিয়ে রাখতে পারি তখন। আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আসলে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি দল থেকে বাদ পড়া বা ক্রিকেটের পরের জীবন নিয়ে শঙ্কিত নই মোটেও। আমি শুধু নিজের কাছে সেরা ব্যক্তিটা হতে চাই। আমি ক্রিকেটকে ভালবাসি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার আসলে আমার সেঞ্চুরিসংখ্যাতে কিছু যায় আসে না, উইকেট নেয়া বা নেয়াতে যায় আসে না। ক্রিকেটের চেয়ে আরও অনেক কিছু জীবনে আছে। আর এটা জানার কারণে মনে হয় আমি খেলার চাপটা নিতে পারি।’

    ‘মুসলিম বা অমুসলিম, যে দেশেই হোক, মানুষ তো ভুগছে। আমরা মহাশূন্যে যেতে কোটি কোটি টাকা খরচ করি, অথচ মানুষের দিকে তাকাই না! এটা মানা আমার পক্ষে খুব কঠিন। আমাদের তো বর্ণ বা গোত্র বা বিশ্বাসের কারণে একে অপরের ক্ষতি করি। বরং উপকার করা উচিত, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়াই। আমাদের মাঝে সহানুভূতি কমে গেছে। এটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার।’  


    ‘ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ করে আমার এলাকার মসজিদে আজান দিতে চাই। অথবা পরিষ্কার করতে চাই টয়লেট। আমি সৌভাগ্যবান। লোকদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। কিছুটা ফিরিয়ে দিতে চাই তাদের।’ 

    **** 


    ‘অ, অ, আলি, আলি, মইন আলি! অঅঅ, হোয়াট্টা ক্যাচ টু ফিনিশ দ্য ম্যাচ!’ 

    লর্ডসে ট্রেন্ট বোল্টের ক্যাচটা নিয়ে যেন উড়ছেন মইন আলি। ঈগলের মতো। কোনো প্রাণী হতে চাইলে মইন সিংহ হতে চাইতেন, আবার চাইতেন ঈগলের মতো উড়তেও। তবে সেই উড়ালটাও হয়তো হতো ধাপে ধাপে। একটা নির্দিষ্ট মুহুর্ত ধরে। যেভাবে ব্যাটিং করেন। বল ধরে ধরে। পরের বলে কী হবে, বা পরের ওভারে কী অপেক্ষা করছে, ভাবতে চান না সেটা। জীবনকেও দেখেন সেভাবেই। এখন যা হচ্ছে, তাই তো সব। এই দর্শনটাই হয়তো তার চাপটা কমিয়ে দেয়, খেলার সময়। 

    যতো জীবনদর্শনই আনুন না কেন, আসলে ক্রিকেটের বাইরে মইন যেতে পারেন না। যদি প্রতিদিন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে পারতেন, সবচেয়ে ভাল হতো নাকি সেটাই! 

    এই ক্রিকেটটাই তো মইনকে এখানে এনেছে। দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিয়েছে। খুঁজে দিয়েছে ইসলামকেও। 

    মইন মুনির আলি নামের ইংলিশ মুসলিম ক্রিকেটারের কাছে তো এসবই সব! 

     

     

    প্রচ্ছদ ও ভেতরের পোর্ট্রেটঃ গ্যারেথ কোপলি

    তথ্যসূত্রঃ 

    ১। ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ক্রিকেট

    ২। অল আউট ক্রিকেট 

    ৩। দ্য গার্ডিয়ান 

    ৪। দ্য ক্রিকেট মানথলি 

    ৫। চান্স টু শাইন 

    ৬। ইএসপিএন ক্রিকইনফো