"মোর দ্যান আ ক্রিকেটার"
ভদ্রলোকের বিনয় বলতে পারেন। রিচি বেনো একটা গল্প বলতে খুব ভালোবাসতেন, তাঁকে করা একটা প্রশ্নের গল্প। এতো বড় মাপের ভাষ্যকার...আসলেই কি তিনি প্রথম জীবনে ক্রিকেটার ছিলেন? তাঁর প্রাণবন্ত ধারাবিবরণীর মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা, অসাধারণ লেখনীর মায়াজালে আচ্ছন্ন পাঠকের কাছে প্রশ্নটা খুব অস্বাভাবিক ঠেকার কথা নয়। তারকাখ্যাতি সম্বল করে তিনি কমেন্ট্রি বক্সে উড়ে এসে জুড়ে বসেন নি, গণমাধ্যমে পা রেখেছিলেন পুরোদস্তুর সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ নিয়েই। এক জীবন ক্রিকেট খেলে এসবও সম্ভব? মিডিয়া জগতের সফল ক্যারিয়ার তাঁকে দু’হাত ভরেই দিয়েছে। মাঝে মাঝে তিনি নিজেও ভেবে অবাক হতেন যে সময় কিভাবে তাঁর জীবনের প্রথম অধ্যায়টুকু বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে দিচ্ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই শুরু হওয়া ক্রিকেটার জীবনে হয়ে উঠেছিলেন যুদ্ধোত্তর স্বাধীনতার প্রতীক। ক্রিকেট মাঠে বুকখোলা শার্টে আবেগী উদযাপন...পেগি লী, বিটলসের জমানায় তিনিও ছিলেন হালের সেনসেশন। ১৯৪৮ থেকে ‘৬৪, ষোল বছরে ক্যারিয়ার নিয়ে রিচি বেনো ঢুকে গেছেন অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের তালিকায়ও।
তরুণ এই প্রতিভার ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয় পেনরিথে, বাবার কাছে। নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে আঠারো বছর বয়সে অভিষেকের পর একুশে পা দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলে। ১৯৪৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ঝানু ক্রিকেটারদের ‘অপরাজেয়’ দলটায় একজন লেগ স্পিনার অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে খুব সামান্যই চেনাতে পেরেছিলেন। তবে সাফল্যের শিখর থেকে অজিরা তখন পা হড়কাতে শুরু করেছে। ঘুরে দাঁড়ানোটাও খুব সহজ ছিল না, টেস্ট দলের বেশীরভাগ সদস্যই যে মূল্যবান আটটি বছর হারিয়ে ফেলেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে!
১৯৫৩ সালে তাই যখন ইংল্যান্ড সফর চূড়ান্ত হল, অস্ট্রেলিয়া তখন হন্যে হয়ে তরুণ ক্রিকেটার খুঁজছে। প্রতিভা অন্বেষণের অংশ হিসেবে সে দলে অ্যালান ডেভিডসন, ইয়ান ক্রেইগ, রন আর্চারদের সাথে জায়গা মিলে গেলো বেনোরও। তবে টানা তিন টেস্টে সুযোগ পেয়েও সেটা কাজে লাগাতে না পারায় বাদ পড়ে যান। অস্ট্রেলিয়া অ্যাশেজটা হেরে যায় পুরো দুই দশক পর।
তবে লেগ স্পিনার ডগ রিং, কলিন ম্যাককুলদের অবসর বেনোকে দলে ধারাবাহিক হওয়ার সুযোগ করে দেয়। পরের দু’ বছরও অ্যাশেজ হারা অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গী হয়ে থাকলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করলেন। জ্যামাইকায় একটি সেঞ্চুরি আর লর্ডসে ম্যাচজেতানো ৯৭ রানের ইনিংস উপহার দিলেও পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা আসছিল না কিছুতেই। ‘৫৬ সালের অ্যাশেজের পর ২৩ টেস্টে বেনোর ব্যাটিং গড় দাঁড়ায় ২০.৯৭ আর বোলিংয়ে ৩৪.৪০। নির্বাচকরা অবশ্য তাঁকে জাত চেনানোর সুযোগটুকু দিয়েই যেতে লাগলেন।
সাফল্যের দেখাটা বেনো দেশের বাইরেই পেতে শুরু করলেন, সবচেয়ে প্রতিকূল পরিবেশেই। তৃতীয়বারে অ্যাশেজ হতাশার পর উপমহাদেশ সফরেই জ্বলে উঠলেন। করাচিতেও অস্ট্রেলিয়ার শোচনীয় হারের পর মাদ্রাজ আর কলকাতা টেস্টে যথাক্রমে ৮ ও ১১ উইকেট, ইনজুরিতে জর্জরিত অস্ট্রেলিয়া দল বেনোতে ভর করেই পায় ২-০ ব্যবধানের সিরিজ জয়।
১৯৫৭-৫৮ সালে অস্ট্রেলিয়া দলে বিলম্বিত পুনর্গঠন সম্ভব হয়। ক্রেইগের নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ২৭ বছর বয়সী বেনো তখন দলের সিনিয়র খেলোয়াড়। তৈরি হাতে থাকা নামের প্রতি সুবিচার করে ৩ টেস্টের সিরিজে ৫৪.৮৩ গড়ে করলেন ৩২৯ রান; জোহানেসবার্গের দু’ টেস্টেই পেলেন শতক। ২১.৯৩ গড়ে নেন ৩০ উইকেট! কার্যত একাই অস্ট্রেলিয়াকে সিরিজ জিতিয়ে দেন ৩-০ ব্যবধানে। পরের অ্যাশেজে অসুস্থ ক্রেইগের স্থলাভিষিক্ত হয়ে পেয়ে যান অজিদের দলের অধিনায়কত্বও।
নেতৃত্ব কাঁধে পেয়ে বেনো অস্ট্রেলিয়া দলটা টনিকের মতোই বদলে দিতে শুরু করেন। লম্বা সময় নিজেদের হারিয়ে খুঁজতে থাকা অজিরা যেন এক সুতোয় গাঁথা পড়তে লাগলো বেনোর অধীনে। ওই বছর ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডকে ৪-০ ব্যবধানে হারিয়ে চমকে দেয় অস্ট্রেলিয়া। পরের দু’ বছরও অ্যাশেজের মালিকানা থাকে অজি শিবিরেই।
এর মাঝে আরও একবার উপমহাদেশ সফর করে বেনোর লেগ স্পিন তখন রীতিমতো জাদুর কাজ দিতে শুরু করেছে। ‘৬১ সালের ইংল্যান্ড সফরের সময় কাঁধের ব্যাথায় তিনি হাত তুলে দাঁত ব্রাশ পর্যন্ত করতে পারতেন না। অথচ ম্যানচেস্টারে সেবারই কিনা করে বসলেন ক্যারিয়ারসেরা বোলিং! জয়টা যখন ইংলিশদের জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র, বেনোর ঘূর্ণিঝড়ে ছ’জন ইংলিশ ব্যাটসম্যান সাজঘরের পথে। ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া জিতে যায় ৫৪ রানে।
সুদীর্ঘ ৫০ বছর (১৯২০-৭০) ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখি করা রে রবিনসন তাঁর দেখা সেরা অধিনায়কদের তালিকায় রিচি বেনোকে রেখেছিলেন সবার উপরে! যে তালিকায় ছিলেন ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং, বিল উডফুল, স্যার ডন ব্র্যাডম্যান থেকে শুরু করে চ্যাপেল ভাতৃদ্বয়ও।
‘৬৪ সালে যখন ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন, তখন তিনি টেস্টে দুই হাজার রান আর দুই শতাধিক উইকেটের একমাত্র মালিক। ২৪৮ উইকেটের অস্ট্রেলিয়ান রেকর্ডটা অক্ষত থাকে আরও দুই দশক, ১৯৮১-৮২ সালে ডেনিস লিলি সেটা ভেঙে দেয়ার আগ পর্যন্ত।
অবসরের পর ক্রিকেটের সাথেই থেকে যান সাংবাদিক হিসেবে। কিছুদিন পর বিবিসির হয়ে ধারাভাষ্য কক্ষেই থিতু হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বস্তুনিষ্ঠতার সাথে সূক্ষ্ম রসবোধ তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে নতুন পরিচয়ে।
অস্ট্রেলিয়ার বিতর্কিত ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের পিছনেও কাজ করেছিলেন একজন অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে। পরবর্তীতে ভাষ্যকার হিসেবে যোগ দেন ক্যারি প্যাকারের নাইন নেটওয়ার্কে। অস্ট্রেলিয়া দলে বেনোর প্রভাবটা কোনসময়ই উপেক্ষা করা যায় নি। ক্যাপ্টেন্সি কৌশলে ইয়ান চ্যাপেল তাঁকে গুরুই মানতেন। আর অজিদের লেগ স্পিন ঐতিহ্যে বিল ও’রেলি থেকে শুরু করে শেন ওয়ার্ন হয়ে আজ অবধি যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে গেছেন এই রিচি বেনোই। ব্যাক্তিগত জীবনে যতই শুকনো মেজাজের হয়ে থাকুন না কেন, ক্রিকেটার রিচি বেনোর পোশাকি পরিচয়ে জাঁকজমকটা থেকে যাবে চিরকাল।